আয়ান মুমিনুল হক নেশায় স্বেচ্ছাসেবী, পেশায় উদ্যোক্তা। বর্তমানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন। পাশাপাশি সিলেট অঞ্চলের মানুষের সেবায় ‘সেভ সিলেট’ নামের একটি সংগঠন পরিচালনা করছেন। বিশাল একটি টিম নিয়ে কাজ করেছেন গত বন্যায়। সিলেট বিভাগের প্রায় প্রতিটি বড় সামাজিক সমস্যার সমাধানে একেকটি প্রজেক্ট বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে তার টিম।
সেভ সিলেটের কার্যক্রম দেশজুড়ে বেশ প্রশংসিত আগে থেকেই। দেশের নানা প্রান্তের মানুষ অনলাইনে অনুদানও করেছেন সেভ সিলেটকে। সেসব অভিজ্ঞতার গল্প শুনবো আজ তরুণ এ তারকার মুখে। সম্প্রতি ঢাকায় সেভ সিলেটের জন্য অ্যাম্বুলেন্স কিনতে এসেছিলেন আয়ান। তখনই কথা হয় তার সঙ্গে।
আয়ান মুমিনুল হক বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারির কারণেই ২০২০ সালের ২৬ মার্চ সেভ সিলেটের যাত্রা। সেভ সিলেটের জন্ম হয়েছিল একটি মিশন নিয়ে। সিলেট বিভাগের এক লাখ অসহায় পরিবারকে মহামারির সময় যেন বাড়িতে রাখা যায়। তারা যেন বাড়ি থেকে বের না হন। যেহেতু সবাই খেটে খাওয়া মানুষ, তাই তাদের যদি বাড়িতে রাখা যায়। তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব। তাই আমরা ‘এক লাখ অসহায় পরিবারের জন্য খাবার’ প্রজেক্ট শুরু করি।’
এমন উদ্যোগ সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা যেন প্রতিটি পরিবারের জন্য কমপক্ষে ১-৩ মাসের খাবারের জোগানের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। সিলেট বিভাগের সবাই এ আহ্বানে এগিয়ে আসেন। এক লাখ ৮ হাজারের বেশি মানুষের পরিবার হয়ে যাই আমরা। মাঠে কাজ করেন সাড়ে ৫ হাজারের বেশি ভলান্টিয়ার। প্রতিটি উপজেলায়, ইউনিয়নে, ওয়ার্ডে ভিন্ন ভিন্ন টিম করতে সক্ষম হই। যার মাধ্যমে খুঁজে খুঁজে ভুক্তভোগী বের করে সাহায্য করতে পেরেছি। ১৫০ দিনের পরিশ্রমের বিনিময়ে আমরা এক লাখ ১৭ হাজারের বেশি পরিবারকে ১-৩ মাসের খাবার প্যাকেট দিতে পেরেছি।’
সংগঠনের সফলতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে লক্ষাধিকের বেশি সদস্য নিয়ে ‘সেভ সিলেট’ বিভাগের সবচেয়ে বড় ও দেশের অন্যতম বড় সামাজিক প্ল্যাটফর্ম হতে পেরেছে। এ প্রজেক্টের জন্য আমরা ‘শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২০’ অর্জন করি। এ ছাড়া ওআইসি ইয়ুথ ক্যাপিটাল ঢাকার অনুষ্ঠানে সম্মাননা লাভ করি, দুবাইয়ে গ্লোব্যাল পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ড ২০২১ এবং থাইল্যান্ডে গ্লোব্যাল ইয়ুথ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০২২ লাভ করি। সব মিলিয়ে আমরা ২৭টি অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেছি। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও বিশ্বের ৩৬টি দেশে টিম রেডি করতে সক্ষম হয়েছি।’
বর্তমান কার্যক্রম নিয়ে আয়ান বলেন, ‘আমরা ২৬৩টি প্রজেক্ট নিয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। এর মধ্যে সিলেট ব্ল্যাড সেন্টারে ৬২ হাজারের বেশি ব্ল্যাড ডোনার আছেন। এ পর্যন্ত দেড় লাখের বেশি মানুষের ব্ল্যাড গ্রুপ টেস্ট করতে পেরেছি। ‘সিলেট ওয়ান্ডার ওমেন’ আরেকটি প্রজেক্ট। যাতে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি নারী আছেন। স্টার্টআপ সিলেট প্রজেক্টের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছি। প্রতি মাসেই ৫ শতাধিক তরুণ-তরুণী নিয়ে সিলেটের বিভিন্ন অডিটোরিয়ামে ট্রেইনারের মাধ্যমে কর্মশালার আয়োজন করি। আমাদের টার্গেট সিলেটকে বাংলাদেশের সিলিকন ভ্যালি বানানো। আমরা এক লাখ মানুষকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’
অসহায়দের জন্য তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, ‘অসহায় মানুষকে বিনা মূল্যে আতিথেয়তার জন্য প্রায় ২ বছর আগে শুরু করেছিলাম ভ্রাম্যমাণ রেস্টুরেন্ট ‘সরাইখানা’। ১০৩ সপ্তাহ ধরে নিয়মিত চলছে এ প্রজেক্ট। সিলেট হেলথ সেন্টার প্রজেক্টের মাধ্যমে বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। যার মাধ্যমে বছরে ৫২ হাজার মানুষ উপকৃত হবেন।’
পরিবেশ রক্ষায় দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন নিয়ে তিনি বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষার জন্য ‘মিশন থ্রি মিলিয়ন ট্রিস’ প্রজেক্ট শুরু করি। ৩০ লাখ শহীদের রুহের মাগফেরাতের জন্য ৫ বছরে ৩০ লাখ গাছ রোপণ করার কাজ করছি। প্রায় লক্ষাধিক গাছ লাগাতে সক্ষম হয়েছি। এ ছাড়া দুর্যোগ মোকাবিলা ও পরবর্তী সহায়তার জন্য ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম’ করেছি। গত বন্যায় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় সাড়ে ৮ কোটির বেশি ত্রাণ-সাহায্য পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন উপজেলায়। পুনর্বাসনের জন্য এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫৫টির বেশি ঘর, বাথরুম বানিয়ে দিয়েছি।’
সামাজিক এ উদ্যোক্তা বলেন, ‘মাত্র ১৩ বছর বয়সেই উদ্যোক্তা হওয়ায় জীবনের সব টিউশন ফি নিজেই দিতে পেরেছি। মাত্র ১৭ টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করে ১৬ বছর বয়সেই সেলফমেইড মিলিয়নিয়ার হয়েছি। পরে ২৩ বছর বয়সে নিজের সম্পদের পরিমাণ কোটি টাকা হয়। এটি নিয়ে ভবিষ্যতে একটি বই লেখার প্ল্যান আছে। কারণ যারা উদ্যোক্তা হতে চান, তাদের জন্য খুবই উপকারী হবে স্টোরিটি।’
শিক্ষা বিস্তারেও কাজ করছে সেভ সিলেট। এ প্রসঙ্গে আয়ান বলেন, ‘বিনা মূল্যে শিক্ষার জন্য ‘বাংলা ইউনিভার্সিটি’ নামে একটি ডিজিটাল উদ্যোগ নিয়েছি। ২০১৩ সাল থেকে কাজ শুরু হলেও ২০১৫ সালে অনলাইন ভিত্তিক যাত্রা শুরু হয়। পরে অফলাইন ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে বছরে প্রায় চার হাজার তরুণ-তরুণীকে বিনা মূল্যে ট্রেনিংয়ের সুযোগ দিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বের সব বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে বিনা মূল্যে শিক্ষা দেওয়াই হচ্ছে এর মূল লক্ষ্য।’
উদ্যোক্তা তৈরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর প্রায় ৪ হাজার তরুণ-তরুণীকে বিনা মূল্যে ৫২টি ভিন্ন ভিন্ন কারিগরি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে রেখেছি। যাতে মানুষ উপকৃত হয়ে নিজেকে ও নিজের পরিচিতদের সাহায্য করতে পারেন। আমাদের ট্রেনিং সেন্টারে বিনা মূল্যে ট্রেনিং পেতে হলে তিনটি কাজ করতে হবে। নিজ বাসায় বা যে কোনো বাসায় একটি গাছ লাগাতে হবে। একজন মানুষকে রক্ত দিতে হবে। আপনি যা শিখবেন, তা আপনার পরিচিত ১০ জনকে শেখাতে হবে। ৫২টি কোর্সের মধ্যে কম্পিউটারের ৭টি ভিন্ন কোর্স ছাড়াও ইংরেজি, আইইএলটিএস, বিসিএস প্রিপারেশন, সেলাই, নার্সিং, সেলফ ডিফেন্সসহ এমন কোর্স আছে, যাতে যে কেউ আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী হতে পারেন।’
তরুণদের উদ্দেশ্যে আয়ান বলেন, ‘নিজের জীবনের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন করুন। বড় স্বপ্ন দেখুন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রতিদিন পরিশ্রম করুন ও লেগে থাকুন। যদি টিকে থাকতে পারেন, তাহলে দিনশেষে আপনিই হবেন বিজয়ী। তাই জীবনে হার না মেনে সংগ্রাম করতে থাকুন। সমাজের মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতির জন্য যতটুকু পারেন; কাজ করুন। শান্তির জীবন পেতে চাইলে অন্যের উপকারে আসুন। এটিই হচ্ছে সফলতা।’