কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে চলছে চিকিৎসকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। দীর্ঘ ছয় বছর মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চললেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে একেবারেই নেতৃত্বহীন। কবে নতুন নেতৃত্ব পাবে জানে না কেউ। জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেলে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা নেতারা।
জানা যায়, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সবশেষ নির্বাচন হয় সংগঠনটির। ওই সময় ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সভাপতি ও ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল মহাসচিব নির্বাচিত হন। এই নেতৃত্ব দুই বছরের পরিবর্তে সাত বছর ক্ষমতা দখল করে রাখে।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য কমিশন গঠন করে এই কমিটি। পরে বিএমএ মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, বিএমএর কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ও নির্বাচন ২১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্যের কমিশনে সভাপতি হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ডা. শাহ মনির হোসেন এবং সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সাবেক পরিচালক ডা. মো. বেলাল হোসেন। নির্বাচন কমিশন অ্যাসোসিয়েশনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা ও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবেন।
পরে এই কমিটি ৩ জুলাই ২০২৪ তারিখে তফসিল ঘোষণা করে। কিন্তু জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীসময়ে এই নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করে সরে যায়। নির্বাচন আর হয়নি। সেই মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির হাতেই রয়ে যায় ক্ষমতা। কিন্তু তারাও তো নেই।
তাহলে কীভাবে চলছে বিএমএ? ২৭ মার্চ সরেজমিনে দেখা যায়, নেতাদের রুম বন্ধ। অফিস বেশ সুনসান। অফিসের নোটিশ বোর্ডে ১ মার্চ ২০২৫ তারিখের একটি নোটিশ। ভিতরে কয়েকজন কর্মকর্তা আছেন। তারা চালিয়ে নিচ্ছেন চিকিৎসা পেশাজীবীদের জাতীয় এ সংগঠন।
স্বাস্থ্যে পুরোনো নেতৃত্ব, পদায়ন-পদোন্নতি নিয়ে অসন্তোষ ড্যাবে
অফিসে কথা হয় সহকারী ম্যানেজার মো. ইয়াসিন আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সভাপতি জেলে আছেন। সাধারণ সম্পাদক পলাতক। সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. পারভেজ ও দপ্তর সম্পাদক ডা. শহীদ মাঝে-মধ্যে আসেন।’
এত বড় প্রতিষ্ঠান চলে কীভাবে? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই চালাই। এখানে মূল কাজ তো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন। আমাদের দোকান ভাড়া, অডিটোরিয়াম ও রেস্ট হাউজের ভাড়া থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয়।’
আমি বিএমএ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলাম। গত আগস্টেই রিজাইন দিয়েছি। শুধু আমি না, পুরো কমিটিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আপাতত কমিটি নেই।- বিএমএ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পদত্যাগী সভাপতি অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন
সাধারণ সম্পাদক পলাতক হলে নোটিশ বোর্ডে তার স্বাক্ষরিত নোটিশ কীভাবে? জবাবে মো. ইয়াসিন আলী বলেন, ‘এট স্ক্যান স্বাক্ষর। স্যারদের অনুমতি নিয়ে দেওয়া হয়েছে। জরুরি প্রয়োজন হলে হোয়াটসঅ্যাপ বা বিভিন্ন মাধ্যমে স্যারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।’
এ নিয়ে বিএমএ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পদত্যাগী সভাপতি অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, ‘আমি বিএমএ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলাম। গত আগস্টেই রিজাইন দিয়েছি। শুধু আমি না, পুরো কমিটিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আপাতত কমিটি নেই।’
তাহলে এখন বিএমএর নেতৃত্বে কে? ‘কেউই নেই। নির্বাচন হলে নতুন কমিটি হতো, তাদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর হতো। কিন্তু যেহেতু নির্বাচন হয়নি সবশেষ নির্বাচিত কমিটি দায়িত্বে আছে।’
কমিটির কেউ তো উপস্থিত নেই, তাহলে কীভাবে চলে? জবাবে অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, ‘উপস্থিত নেই ঠিক, কোথায় আছে আমিও জানি না। তবে অফিসিয়ালি তারা এখনো সভাপতি-সম্পাদক।’
তারা তো তাদের মেয়াদ শেষ করেছেন আরও সাত বছর আগে, এখন থাকেন কীভাবে? জবাবে তিনি বলেন, ‘দুই বছর থাকার কথা। কিন্তু তারা কীভাবে থাকলো, থাকা যায় কি না, আমার জানা নেই। তবে বলা যায়, এখন নেতৃত্বশূন্য বিএমএ।’
বিএমএ গত ছয় বছরে নির্বাচন দেয়নি। স্বৈরাচারের দোসররা জোরপূর্বক দখল করেছিল, তারাই আছে। একজন জেলে আরেকজন পলাতক। বাকিরাও পলাতক। যাওয়ার আগে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করেছে। তারাও তো স্বৈরাচারের দোসর। পতনের পর তারাও পদত্যাগ করেছে।- ড্যাব সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আল রশিদ
এ নিয়ে বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আল রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিএমএ গত ছয় বছরে নির্বাচন দেয়নি। স্বৈরাচারের দোসররা জোরপূর্বক দখল করেছিল, তারাই আছে। একজন জেলে ও আরেকজন পলাতক। বাকিরাও পলাতক। যাওয়ার আগে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করেছে। তারাও তো স্বৈরাচারের দোসর। পতনের পর তারাও পদত্যাগ করেছে।’
তাহলে এখন কী হবে এই জাতীয় পেশাজীবী সংগঠনটির? জবাবে ড্যাব সভাপতি বলেন, ‘এটা একটি জটিল প্রক্রিয়া। আমরা যদি গিয়ে দায়িত্ব নিই তাহলে নিউজ হবে দখল করেছে। বিএমএ খুবই সেনসেটিভ জায়গা। এজন্য আমরা একটু ওয়েট অ্যান্ড সিতে আছি। যদি জাতীয় নির্বাচন হতো, আমাদের জন্য ভালো হতো। বিএমএতে এককভাবে কিছু করলে হবে না। সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘জামায়াতের চিকিৎসকদের সংগঠন এনডিএফকে সম্পৃক্ত করবো কি করবো না, এটা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আমাদের দ্বন্দ্ব আছে। এ কারণে আমরা এটা বন্ধ রেখেছি। সব প্রসেস করা আছে। এক হাজার সদস্যের স্বাক্ষরসহ একটা তলবি সভা ডেকে সেখানে অ্যাডহক কমিটি করার প্রবিধান আছে। সেটাও করা আছে। সদস্যদের স্বাক্ষরও আমরা নিয়েছি। কিন্তু এই মুহূর্তে করবো কি করবো না, এটা নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় আছি। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে স্লো যাচ্ছি।’
১৯৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের চিকিৎসকরা মিলে পাকিস্তান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের চিকিৎসকরা পাকিস্তান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (পূর্বাঞ্চল) গঠন করেন। ১৯৭১ সালে নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন রাখা হয়। বাংলাদেশের চিকিৎসক পেশাজীবীদের জাতীয় সংগঠন এটি। সোসাইটিস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট ১৮৬০ দ্বারা নিবন্ধিত। ৬৬টি শাখায় এর কার্যক্রম চলে। কেন্দ্রীয় ও শাখা কমিটির মাধ্যমে সংগঠনটি পরিচালিত হয়।