তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবে গোটা বিশ্ব বদলে গেছে। এখন ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কিত প্রায় সবকিছুতেই প্রযুক্তির হাওয়া।
কোনো চেনা বন্ধুকে দেখছেন, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গড়ে ভালো আয়-রোজগার করছে। সমৃদ্ধি এসেছে তার জীবনযাত্রায়। আপনার নিজেরও প্রযুক্তিগত কোনো আইডিয়া বা বুদ্ধি আছে। কিন্তু সেটা কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না।
বিশেষত প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো, আইনি বিষয়াদি সামাল দেওয়া ইত্যাদি আপনাকে চিন্তিত করে রাখছে।
স্টার্টআপ বা নতুন ব্যবসার ক্ষেত্রে তরুণদের এমন দুশ্চিন্তা দূর করতে ভারতের হায়দরাবাদের প্রাণকেন্দ্রে হাইটেক সিটিতে গড়ে উঠেছে ‘টি-হাব’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
আইডিয়াবাজ বা উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত, ব্যবস্থাপনা এবং আইনি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে স্টার্টআপের এই ‘আঁতুড়ঘর’।
সম্প্রতি ভারত সফরকারী বাংলাদেশের সাংবাদিক প্রতিনিধি দল টি-হাব পরিদর্শন করে। প্রতিষ্ঠানটির তরুণ কর্মকর্তা চন্দ্রলেখা চৌধুরী প্রতিনিধি দলকে সাজানো-গোছানো টি-হাব ভবন ঘুরিয়ে তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তর ধারণা দেন।
উদ্ভাবনী চিন্তাকে উৎসাহ দিতে তেলেঙ্গানা রাজ্য সরকারের সহায়তায় ২০১৫ সালে টি-হাব কার্যক্রম শুরু করে। এটি মূলত স্টার্টআপ, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম, করপোরেট, সরকার ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতার পথটি করে দেয়।
চন্দ্রলেখা জানান, ব্যবসায়িক মডেলগুলিকে পরিচর্যা করে আরও ভালো অবস্থানে নিতে কাজ করে টি-হাব। অপারেশন শুরুর পর এ পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি স্টার্টআপ নিয়ে কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া এটি বিনিয়োগ পেয়েছে দুই হাজার কোটির রুপির মতো।
এসময় তিনি ‘মনিত্রা’ নামে একটি ডিভাইস দেখান প্রতিনিধি দলকে। তিনি জানান, এটি হার্ট পর্যবেক্ষণের ডিভাইস। বুকে রেখে হার্টের পালস রেটসহ সম্ভাব্য সমস্যা আগাম জানা যাবে এর মাধ্যমে। যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হাসপাতালে যাওয়া বা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারেন। যদিও এটিকে শতভাগ সঠিক ধরে নেওয়া যাবে না। ‘মনিত্রা’ ভারতের বাজারে মিলছে।
রাজ্য সরকার সহায়তা করলেও টি-হাবের প্রতিদিনের কার্যক্রম পরিচালনা করে একটি পেশাদার টিম। যাদের সবার গড় বয়স ৩৮ বছর। এদের নিয়োগ হয় অনেক যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে। এই টিম গোটা দিনের রিপোর্ট তুলে ধরে বোর্ড অব ডিরেক্টরসের কাছে। এই বোর্ডে সরকারের একজন মাত্র প্রতিনিধি আছেন।
টি-হাবের সংশ্লিষ্টরা জানান, এই প্লাটফর্মের মূল উদ্দেশ্য তরুণ উদ্যোক্তাদের স্টার্টআপকে উৎসাহিত করা এবং তাদের কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করা। তারা বিজনেস আইডিয়া নিয়ে টি-হাবে এলে এই প্লাটফর্ম উদ্যোক্তাদের পণ্য তৈরি ও সেবা সরবরাহ পর্যন্ত পৌঁছে দেবে।
স্টার্টআপের জন্য আশীর্বাদ রূপে আবির্ভূত টি-হাব এখন কেবল হায়দরাবাদ নয়, গোটা ভারতের উদ্যোক্তাদের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টি-হাব এখন ব্লকচেইন, আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই), বিগ ডাটা, মেশিন লার্নিং (এমএল), ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), মোবিলিটির মতো ডিপ টেকে নজর দিচ্ছে।
ব্যর্থতার শঙ্কা নয়, ‘আইডিয়া’ বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেয় টি-ওয়ার্কস দেশে প্রায়ই ড্রোন বা বিলাসবহুল গাড়ির কার্বন কপি বানানোর খবর মেলে। চিকিৎসা, প্রযুক্তি, কৃষি-খাদ্য প্রভৃতি খাতেও নতুন নতুন উদ্ভাবনের খবর মেলে। কিন্তু সেসব উদ্ভাবিত পণ্য আর বাজারে আসে না।
সরকারি বা বেসরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না থাকার ফলে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় উদ্ভাবনী সেসব আইডিয়া। এজন্য অন্য তরুণরাও ব্যর্থতার শঙ্কায় আর উদ্ভাবন নিয়ে ভাবতে চান না।
অথচ এক্ষেত্রে একদম ব্যতিক্রম প্রতিবেশী ভারত। তারা উদ্ভাবনী চিন্তার তরুণ-তরুণীদের উৎসাহিত করতে গড়েছে ‘টি-ওয়ার্কস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। যার মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের ‘আইডিয়া’কে পণ্য আকারে বাজার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়।
টি-ওয়ার্কসের অবস্থান টি-হাবের পাশেই। বাংলাদেশের সাংবাদিক প্রতিনিধি দল টি-ওয়ার্কসে যখন পা রাখে, তখন সেখানে দুর্গাপূজার ষষ্ঠী উদ্যাপন চলছিল। প্রতিষ্ঠানের নিচের ফ্লোরেই কর্মীরা নাচ-গানের মাধ্যমে উদ্যাপন করছিলেন উৎসব। কর্মস্থলে এমন পরিবেশ অভাবনীয়ই লাগছিল।
টি-ওয়ার্কসের ডিরেক্টর (পার্টনারশিপ, পিপল অ্যান্ড কালচার) বীরা চাপ্পি প্রতিনিধি দলকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দেখান।
তিনি জানান, যেসব স্বপ্নবাজ নির্মাতা ও উদ্ভাবক ব্যর্থতাকে ভয় পান না, তাদের কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে ২০১৭ সালে টি-ওয়ার্কস গড়ে তোলে তেলেঙ্গানা রাজ্য সরকার। আর টি-হাবের পাশে নতুন এ ভবন উদ্বোধন হয় চলতি বছরের মার্চে। ভবনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, দিনের বেলা বিদ্যুৎ বেশি লাগে না। প্রচুর আলো-বাতাস ভবনে ঢোকার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ইকোসিস্টেমকে সর্বোচ্চ কাজে লাগায়।
বীরা চাপ্পি বলেন, এখানে কেউ কোনো আইডিয়া বা সমস্যার সমাধান নিয়ে এলে সেটা বাস্তবায়নে পূর্ণ সহযোগিতা করা হয়। টি-ওয়ার্কসে আছে আধুনিক সব মেশিন। কেউ কোনো আইডিয়া বা ডিজাইন নিয়ে এলে তার যদি ন্যূনতম অভিজ্ঞতাও থাকে, সেই কাজটি এগিয়ে নিতে তাকেই মেশিন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। না পারলে সেখানেই তাকে সহযোগিতা করা হয়। কাগজ থেকে শুরু করে কাঠ, স্পঞ্জ, লোহা সব কিছুর ডিজাইন কাটিং হয় টি-ওয়ার্কসে।
এসময় তিনি জানান, কোনো তরুণ-তরুণী কোনো উদ্ভাবন বা আইডিয়া নিয়ে এলে তাকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত সহায়তা আমরা দেওয়ার চেষ্টা করি। সেটা আর্থিক বা মেশিনারিজ যেটাই হোক।
বীরা চাপ্পি জানান, সম্প্রতি মহাকাশ অভিযানের জন্য রকেট প্রস্তুতের সময় হঠাৎ একটি যন্ত্রের সমস্যা দেখা দেয়। আকাশযাত্রার এক সপ্তাহ আগে এই জটিলতায় চিন্তায় পড়ে যায় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা-ইসরো। তারা শরণাপন্ন হন টি-ওয়ার্কসের। দুই প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টায় সেই যন্ত্রাংশ তৈরি হয়ে যায় সফলভাবে।