বাংলাদেশের যাচ্ছেতাই মার্কা, অনুজ্জ্বল, গা-ছাড়া ও দায়িত্ব-জ্ঞানহীন ব্যাটিংয়ের তীব্র সমালোচনার পাশাপাশি আজ দুপুর থেকে এ প্রশ্নটিও সবার মুখে মুখে।
সবার জানা, অক্টোবরে ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ আছে এবং দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট বোর্ড সফর নিশ্চিতের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েও দিয়েছে। আগামী ২১ অক্টোবর ঢাকার শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে শুরু বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম টেস্ট।
ক’দিন আগে অবসরের ঘোষণা দেওয়া সাকিব হোম অব ক্রিকেটের সেই টেস্ট ম্যাচটি খেলেই অবসরে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন; কিন্তু তার সে ইচ্ছে পূরণের সম্ভাবনা খুব কম। কারণ একটাই; ক্রিকেটার সাকিবের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সংশয় না থাকলেও ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদ সাকিবের নিরাপত্তা প্রদানে সংশয় বিসিবি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের।
কঠিন সত্য হলো, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানের দেশে ফেরা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা মেলেনি। তাই ধরে নেওয়া হচ্ছে কানপুরে কয়েক ঘণ্টা আগে শেষ হওয়া টেস্ট ম্যাচটিই বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার ও সবচেয়ে বেশি জয়ের রূপকার, নায়ক ও স্থপতি সাকিব আল হাসানের বিদায়ী টেস্ট।
বলে রাখা ভালো, ক্রিকেটার সাকিবকে নিরাপত্তা প্রদানে কোনো বাধা নেই বিসিবি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। প্রথমে বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ ও পরে ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ জানিয়েছেন, তারা ক্রিকেটার সাকিবের নিরাপত্তা দিতে সচেষ্ট ও বদ্ধপরিকর।
কিন্তু ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাকিবের নিরাপত্তা প্রশ্নে বিসিবি সভাপতি আর ক্রীড়া উপদেষ্টা একই সুরে কথা বললেন।
খেলোয়াড় হিসেবে সাকিবের নিরাপত্তার প্রসঙ্গে ক্রীড়া উপদেষ্টা বলেন, ‘সাকিব আল হাসানের পরিচয় দুটি। একটি খেলোয়াড় হিসেবে, অন্যটি রাজনৈতিক পরিচয়। আওয়ামী লীগের প্যানেল থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচন করেছিলেন। মানুষের মধ্যে এই বিষয়ে দুটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। এখন খেলোয়াড় হিসেবে একজন খেলোয়াড়কে যতটুকু নিরাপত্তা দেওয়া দায়িত্ব, সেটা অবশ্যই আমরা দেব। তিনি দেশে এলে সেটা আমরা দেব। রাষ্ট্রের জায়গা থেকে রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিককেই নিরাপত্তা দিতে বাধ্য এবং সেটা তারা দেবেন।’
কিন্তু ছাত্র জনতার উত্তাল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লিগের সংসদ সাকিবের নিরাপত্তা প্রশ্নে ক্রীড়া উপদেষ্টার কথা, ‘জনগণের পক্ষ থেকে যদি নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকে, সে নিরাপত্তা কেউ কাউকে আসলে দিতে পারবে না। শেখ হাসিনাকেও নিরাপত্তা দেওয়া যায়নি। তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। তো সে জায়গা থেকে রাজনৈতিক বিষয়টা (সাকিবের) পরিষ্কার করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।’
ক্রীড়া উপদেষ্টা রাজনৈতিক বিষয়ে সাকিবের অবস্থান পরিষ্কার করার কথাও বলেন। মাশরাফির উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, ওনাকে (সাকিব) ওনার জায়গাটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন, রাজনৈতিক জায়গা থেকে। ওনার যে রাজনৈতিক অবস্থান, সেটা নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। মাশরাফি বিন মর্তুজা মনে হয় এরই মধ্যে সে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন।’
ওপরের কথোপকোথনে পরিষ্কার, সাকিব নিজের অবস্থান পরিষ্কার না করলে তার নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকার নিজেদের অবস্থানে অটুট থাকবে।
এখন আগামী তিন সপ্তাহে সাকিব যদি নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন, মিডিয়া, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলে দেন, ‘আমি একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলাম বা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম। সেটা যতটা আমার নিজের ইচ্ছেয়, তার চেয়ে অনেক বেশী আওয়ামী লীগ নেত্রী ও শীর্ষ নেতৃবৃন্দের ইচ্ছেয়। আমার আর রাজনীতি করার ইচ্ছে নেই। আমি মূলত ক্রিকেটার। বাকি জীবন ক্রিকেটার পরিচয়েই থাকতে চাই এবং ক্রিকেট নিয়েই কাটাতে চাই।
ধারণা করা হচ্ছে, সাকিবের পক্ষ থেকে এমন এক বিবৃতি আসলে হয়ত উত্তপ্ত পরিস্থিতি নরম হতে পারে; কিন্তু সাকিব যতক্ষণ পর্যন্ত এমন কিছু বলবেন না, ততক্ষণ পর্যন্ত এটাই প্রতীয়মান থাকবে যে সাকিব ক্রিকেটার পরিচয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিচয়টাও ধরে রাখতে চান এবং আওয়ামীলীগের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী।
খুব স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার সেই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত সাকিবকে নিরাপত্তা দিতে চাইবে না। তাতে ছাত্র জনতার সেন্টিমেন্টে জোর আঘাত লাগবে। তারা ফুসে উঠতে পারে। আবার তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও দায়ের করা হয়েছে। এতেই বোঝা যায়, তাকে নিয়ে কতটা ক্ষোভ বিরাজ করছে ছাত্র-জনতার মনে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মাঠের বাইরের কর্মকাণ্ডে মাঝেমধ্যে নিন্দিত ও সমালোচিত হবার পর ক্রিকেটার সাকিব সব সময়ই সমাদৃত। জনপ্রিয়। তার মেধা, যোগ্যতা নিয়ে কারোই সন্দেহ নেই। তাকে ধরা হয় বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার। কেনইবা তা গণ্য হবে না, সাকিবতো একটানা এক যুগের বেশি সময় কোন না কোন ফরম্যাটেই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের তকমা গায়ে এঁটে ছিলেন।
সাকিবের অর্জন, কৃতিত্ব আর প্রাপ্তিও আকাশছোঁয়া। সব ফরম্যাটেই বাংলাদেশের পারফরমারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জয়ের নায়ক, রুপকার ও স্থপতি সাকিব। তাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মানে টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সর্বাধিক ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারও উঠেছে সাকিবের হাতে।
কাজেই ক্রিকেটার, পারফরমার সাকিব অনেক বড়। পারফরমেন্স ও কৃতিত্বের মানদন্ডে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সবার ওপরেই তার স্থান।
কিন্তু কঠিন সত্য হলো সেই দেশসেরা এবং জাতীয় দলের প্রধান চালিকাশক্তি সাকিবের এখন দেশে ফেরা, স্বাভাবিক চলাফেরায় আছে বড় ধরনের বাঁধা।
সে বাঁধার জন্মদাতা কিন্তু সাকিব নিজেই। তিনিতো আর তার ভক্ত, সমর্থক আর টিম বাংলাদেশের সাপোর্টারদের মত নিয়ে বলে কয়ে রাজনীতিতে জড়াননি। নিজের ইচ্ছায় আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছেন এবং জিতে মাগুরা-১ থেকে সংসদ সদস্যও হয়েছেন।
সেই আওয়ামী লিগ সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণ, সীমাহীন দূর্নীতি, অন্যায়-অবিচার, নিপিড়ন, ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছাত্র জনতার তীব্র আন্দোলনের সময় সাকিব নিশ্চুপ ছিলেন। দেশের ছাত্র-জনতার সেই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের প্রতি এতটুকু সমর্থন ব্যক্ত করেননি। তা নিয়েই রাজ্যের অসন্তোষ আন্দোলনকারী দেশের ছাত্র-জনতার মধ্যে।
সর্বোপরি সাকিব একজন আওয়ামীলীগার। আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি। তার দল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত। খুব স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলনকারীদের কাছে সাকিব এখন শেখ হাসিনার দোসর। তাই তার প্রতি ক্ষোভ-বিদ্বেষ পোষণ করা অস্বাভাবিক নয়। তাই আওয়ামী লীগের টিকেটে সংসদ সদস্য হওয়া রাজনীতিবীদ সাকিবকে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে ভাবতে হচ্ছে সরকারকে। এখন সাকিবই পারেন সরকারের ভাবনা পাল্টাতে। ক্রীড়া উপদেষ্টা কিন্তু সাকিবকে সে সুযোগও দিয়েছেন। নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে সাকিব কি সে সুযোগ নেবেন?
সাকিব যদি নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে না পারেন, তাহলে শুধু জাতীয় দল থেকে বের হয়ে যাওয়াই নয়, বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটও তাকে ছাড়তে হবে। তেমনটা হলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতিরও মুখোমুখি হবেন তিনি।
যেমন এ বছরই বিপিএল এবং ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলা হবে না তার। এটা সবাই জানে যে, প্রতিবারই বিপিএলে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া ক্রিকোরদের অন্যতম সাকিব। বিপিএলে চারবারের ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট। জানা গেছে, প্রতিবার বিপিএলে সাকিবের দর ওঠে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা।
আবার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে শেষ দুই বছর মোহামেডান ও শেখ জামালের হয়ে প্রিমিয়ার লিগ খেলতে এসে সাকিব গড়পড়তা ১ কোটি টাকা করে পারিশ্রমিক পেয়েছেন। দেশে ফিরে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে না পারলে নিশ্চিত তিনি আর্থিক দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।