ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে। ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, ওয়াশিংটন এখন আর স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে না।
সম্প্রতি ব্লুমবার্গ নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হাকাবিকে প্রশ্ন করা হয়—যুক্তরাষ্ট্র কি এখনো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করে? জবাবে তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় না।'
ডোনাল্ড ট্রাম্পের মনোনীত এই প্রাক্তন আর্কানসাস গভর্নর আরও বলেন, ভবিষ্যতে যদি কখনো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথা চিন্তা করা হয়, তাহলে তা যেন ইসরায়েলের কোনো ভূখণ্ড ব্যবহার না করে হয়। এমনকি তিনি পরামর্শ দেন, 'একটি মুসলিম দেশের অংশবিশেষ নিয়ে' ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করা যেতে পারে।
বিবিসিকে দেওয়া আরেক সাক্ষাৎকারে হাকাবি বলেন, 'মুসলিম দেশগুলোর মোট ভৌগোলিক এলাকা ইসরায়েলের তুলনায় ৬৪৪ গুণ বড়। তাই যদি সত্যিই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি কারও আগ্রহ থাকে, তবে তারা হয়তো কিছুটা জায়গা দিতে পারে।'
বিশ্লেষকেরা বলছেন, হাকাবির বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী মধ্যপ্রাচ্যনীতি থেকে মুখ ফেরানোরই স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষপাতী ছিল, ট্রাম্প প্রশাসন প্রথম মেয়াদেই সে নীতিকে উপেক্ষা করেছিল। দ্বিতীয় মেয়াদে সেই অবস্থান এখন আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে।
হাকাবির বক্তব্য প্রসঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি। তবে মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকদের মতে, এই মন্তব্যটি মার্কিন প্রশাসনের মূলনীতির বড় পরিবর্তনের প্রতিফলন।
জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর কনটেম্পোরারি আরব স্টাডিজের গবেষক ও ফিলিস্তিনি আলোচকদের সাবেক উপদেষ্টা খালেদ এলগিন্ডি বলেন, 'এই প্রশাসন ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডগত ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব উভয়কেই মুছে দিতে চায়। ট্রাম্পের আগের মেয়াদে তারা এমন একটি ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র’-এর ধারণা দিয়েছিল, যার সার্বভৌমতা থাকবে না। এখন তারা সেটির ভানও করছে না।'
ওয়াশিংটন ডিসির আরব সেন্টারে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল প্রোগ্রামের প্রধান ইউসুফ মুনায়ার বলেন, হাকাবির বক্তব্যে নতুন কিছু নেই। তিনি বলেন, 'যা হাকাবি বলছেন, তা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর নীতির প্রতিফলন, যা বহু বছর ধরেই চলে আসছে। বিভিন্ন প্রশাসনের সময়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নিয়ে যত কথাই বলা হোক, কার্যত সবসময় তা দুর্বল করা হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'হাকাবির বিশেষত্ব হলো— তিনি অন্যদের মতো মুখে কৌশলী না হয়ে সরাসরি বলে ফেলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা চায় না। তিনি নির্লজ্জভাবে সেটি প্রকাশ করেন।'
হাকাবির আগ্রাসী অবস্থান নতুন কিছু নয়। ২০০৮ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে তিনি বলেছিলেন, 'ফিলিস্তিনি বলে কিছু নেই।'
বিশ্লেষকদের মতে, গাজা সংকটের মধ্যেই এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে।
গবেষক খালেদ এলগিন্ডি বলেন, 'এই অবস্থান ইউরোপ ও আরব বিশ্বের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। তারা এখনো দুই রাষ্ট্র সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের বাইরে যেতে চায় না।'
এদিকে, হাকাবির বক্তব্য প্রকাশের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংগঠন ‘আদদামির’সহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের ছয়টি দাতব্য সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, এসব প্রতিষ্ঠান ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের সহায়তা করে থাকে।
তবে আদদামিরের মূল কাজ হচ্ছে দখলকৃত পশ্চিম তীরে আটক ফিলিস্তিনিদের আইনি সহায়তা দেওয়া। মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ, সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন’ (পিএফএলপি)-কে সহায়তা করে আসছে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন পিএফএলপিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
২০২২ সালেই ইসরায়েল এই অভিযোগে পশ্চিম তীরে আদদামির কার্যালয়সহ কয়েকটি সংস্থায় অভিযান চালিয়েছিল।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান যে এখন একপাক্ষিকভাবে ইসরায়েলপন্থী হয়ে উঠেছে, হাকাবির বক্তব্য তারই প্রকাশ্য প্রমাণ।