ইরান ও ইসরাইলের শত্রুতা এখন সরাসরি সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল করছে। পারমাণবিক কর্মসূচি, সিরিয়া-লেবাননে মিলিশিয়া সমর্থন ও জেরুজালেম ইস্যুতে বৈরিতা বেড়েছে। ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, সাইবার যুদ্ধ ও গোয়েন্দা লড়াই পরিস্থিতি তীব্র করেছে। এটি শুধু দুই দেশের মধ্যে নয়, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও আরব দেশগুলোর ভূমিকাও জটিল করছে।
ইরান-ইসরায়েল নিয়ে আজকের শীর্ষ ১০ খবর নতুনধারা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
১.হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্স লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল
ইরানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মাদরেজা জাফরঘান্দি বলেছেন, চলমান সংঘাতে ইসরায়েলি বাহিনী দেশটির ছয়টি অ্যাম্বুলেন্স এবং তিনটি হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে। এসব হামলায় দুজন স্বাস্থ্যকর্মী এবং এক শিশু নিহত হয়েছেন।ইরানের ফার্স নিউজ এজেন্সির বরাতে আল–জাজিরা এ খবর জানিয়েছে।
এদিকে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ১৩ জুন সংঘাত শুরুর পর থেকে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দেশটিতে ২৪ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের বিরসেবা শহরের সোরোকা হাসপাতালে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েলের দেওয়া তথ্যের বরাতে আল–জাজিরা জানায়, ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সোরোকা হাসপাতালের ছাদের একাংশ ধসে পড়েছে। সেই সঙ্গে ভেঙে গেছে হাসপাতাল ভবনের বাইরের দেওয়ালের কাঁচ।
এর আগে, ১৩ জুন রাতে ইসরায়েল ইরানের মাটিতে আগ্রাসন শুরু করে। লক্ষ্যবস্তু হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। ঘরবাড়িতে সরাসরি আঘাত হানার ফলে বেসামরিক নাগরিকরাও প্রাণ হারান। এরপর তেহরান ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালায়।
পরের দিনগুলোতে ইসরায়েলের আক্রমণের বিরুদ্ধে ইরানও ধারাবাহিকভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। উভয় পক্ষই হতাহতের খবর দিচ্ছে এবং বেশ কয়েকটি স্থাপনার ক্ষতি স্বীকার করেছে।
২.ইরানে হামলায় এ পর্যন্ত নিহত ৪৩০, আহত ৩৫০০: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়
ইসরায়েলের সঙ্গে গত ১৩ জুন সংঘাত শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ইরানে অন্তত ৪৩০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৫০০ মানুষ। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে স্থানীয় নূর নিউজ এজেন্সি হতাহতের হালনাগাদ এ তথ্য প্রকাশ করেছে। খবর বিবিসির।
ইরানের পক্ষ থেকে গত কয়েকদিনের মধ্যে নিহতের সংখ্যা নিয়ে এই প্রথম সরকারি তথ্য প্রকাশ করা হলো।
সর্বশেষ গত রোববার ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ইসরায়েলি হামলায় দেশটিতে মোট ২২৪ জন মানুষ নিহত হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি অধিকার সংগঠনের সংবাদমাধ্যম হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট নিউজ এজেন্সি বলেছে , নিহতের সংখ্যা ৬৫৭ জন।
৩.মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক অবস্থানে হামলা চালাতে প্রস্তুত থাকবে ইরান: আরাঘচি
ওয়াশিংটন ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে যোগ দিলে তেহরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক অবস্থানে প্রতিশোধমূলক হামলা চালাতে প্রস্তুত থাকবে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি এনবিসি নিউজকে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন।
রুশ বার্তা সংস্থা তাসের প্রতিবেদন অনুসারে, মার্কিন আক্রমণ আসলে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীকে লক্ষ্যবস্তু করবে কিনা - সাংবাদিক জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যখন যুদ্ধ হয়, তখন উভয় পক্ষই একে অপরকে আক্রমণ করে। এটা বেশ বোধগম্য এবং আত্মরক্ষা প্রতিটি দেশের বৈধ অধিকার।'
তবে আরাঘচি উল্লেখ করেন, 'সবকিছু বন্ধ করার জন্য ওয়াশিংটন থেকে তেল আবিবে কেবল একটি টেলিফোন কলের প্রয়োজন।'
এর আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, ইরানের পারমাণবিক সমস্যা কূটনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করার জন্য এবং তেহরানের ওপর মার্কিন হামলা প্রতিরোধ করার জন্য আমেরিকা ইরানকে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ সময় দিতে প্রস্তুত।
৪. ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর এবং সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের হামলা
ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ডস কর্পস (আইআরজিসি) ঘোষণা করেছে, তারা ইসরায়েলের বেন গুরিওন বিমানবন্দর এবং সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে।
ইসরায়েলে হামলা সম্পর্কিত ১৫তম বিবৃতিতে শনিবার (২১ জুলাই) আইআরজিসি জানায়, তারা ট্রু প্রমিজ অপারেশন ৩-এর ১৮তম ধাপ শুরু করেছে। এ হামলায় শাহেদ ১৩৬-এর মতো অসংখ্য আত্মঘাতী ও যুদ্ধ ড্রোন; সেই সঙ্গে নির্ভুল কঠিন-জ্বালানি এবং তরল-জ্বালানি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
বিবৃতি অনুসারে, আইআরজিসি বেন গুরিওন বিমানবন্দর এবং সামরিক অপারেশনাল লজিস্টিক সেন্টারগুলোতে পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যবস্তু সফলভাবে ধ্বংস করেছে।
এতে আরও বলা হয়, অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানি ড্রোনগুলোকে আটকাতে ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে ইসরায়েলিরা আশ্রয়কেন্দ্রে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
ইসরায়েলি সরকারের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, সর্বশেষ আক্রমণের সময় দশটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ছয়টি তাদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে।
৫.যুদ্ধে ইসরায়েলের দৈনিক ব্যয় ২০ কোটি ডলার, অর্থনৈতিক চাপে নেতানিয়াহু।
ইরানের বিরুদ্ধে পূর্ব কোনো ঘোষণা ছাড়াই একতরফা যুদ্ধ শুরু করে ইসরায়েল। বিশ্লেষকেরা হিসাব করে দেখেছেন, গত ১৩ জুন শুরু করা এই যুদ্ধে ইসরায়েলের ব্যয় দৈনিক প্রায় ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি ডলার। আর এর বেশির ভাগ অংশই ব্যয় হচ্ছে মূলত ইরানি হামলা ঠেকাতে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রাথমিক এক হিসাবে দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, ইরানকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলের যুদ্ধ দেশটির দৈনিক আনুমানিক ২০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় হচ্ছে। এই বিপুল অঙ্ক, এই সংঘাত কত দিন চলবে, তার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে। এসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিদিনই ১০ লাখ ডলার থেকে শুরু করে কয়েক কোটি কোটি ডলার পর্যন্ত খরচ হচ্ছে।
ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘ডেভিডস স্লিং’ ও ‘অ্যারো—৩’ এর মতো ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি আগত ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে খরচ হচ্ছে ৭ লাখ থেকে ৪০ লাখ ডলার পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত ইরানের ছোড়া ৪ শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে বারবার ব্যবহার করতে হচ্ছে এগুলোকে।
এ ছাড়া, ইরানে ইসরায়েলের হামলার খরচও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ইরানের ১ মাইল দূরত্ব পাড়ি দিয়ে হামলা চালাতে ইসরায়েলি এফ-৩৫ জেট প্রতি ঘণ্টায় খরচ করছে প্রায় ১০ হাজার ডলার। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে জেডিডিএএম ও এমকেএইটি ফোর-এর মতো নির্ভুল বোমার দাম।
সব মিলিয়ে, ইসরায়েলি অ্যারন ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক পলিসি ধারণা দিয়েছে, এ যুদ্ধ এক মাস স্থায়ী হলে ইসরায়েলের মোট ব্যয় দাঁড়াতে পারে প্রায় ১২০০ কোটি ডলার। থিংক ট্যাংকটির অর্থনীতিবিদ জিভ একস্টাইন বলেন, এই যুদ্ধ গাজা বা হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধে তুলনায় অনেক বেশি ব্যয়বহুল। সবচেয়ে বড় খরচটা হচ্ছে গোলাবারুদ—আক্রমণাত্মক এবং প্রতিরক্ষামূলক, উভয় ক্ষেত্রেই।
এই আর্থিক চাপের কারণে স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধের পক্ষে জনমত বাড়ছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখনো যুদ্ধ থামানোর ইঙ্গিত দেননি। তিনি ইরানের পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিকে চূড়ান্তভাবে অকার্যকর না করা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে।
এদিকে, ইসরায়েলি পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রয়েছে এমনকি কিছু ক্ষেত্রে সূচকও বেড়েছে—তবে বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। প্রকৌশলীরা হিসাব করে বলছেন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পুনর্গঠনে খরচ হবে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। এখন পর্যন্ত কয়েক শ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং পাঁচ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
দেশটির সবচেয়ে বড় তেল শোধনাগার সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অবকাঠামো খাতেও কাজ স্থগিত রয়েছে। ইসরায়েলি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর কারনিত ফ্লাগ ওয়ালস্ট্রিট জার্নালকে বলেন, যুদ্ধ কত দিন স্থায়ী হবে, তা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, যদি এক সপ্তাহ চলে, সেটা এক কথা। কিন্তু যদি দুই সপ্তাহ বা এক মাস চলে, তাহলে পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে যাবে।
৬.‘ইরানে হামলার পরিকল্পনা পূর্বপরিকল্পিত’
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা ইরানের ওপর হামলার জন্য 'বছরখানেক আগে থেকেই' প্রস্তুতি নিচ্ছিল। শনিবার (২১ জুন) বিবিসির লাইভ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রধান ইয়াল জামির বলেছেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় এই প্রস্তুতির বিষয়ে সব তথ্য যতটা সম্ভব গোপন রাখা হয়েছে।
জামির বিস্তারিত তথ্য না জানিয়েই বলেছেন, এই অভিযান সম্ভব হয়েছে 'অপারেশনাল ও কৌশলগত পরিস্থিতির কারণে'। দেরি করলে পরিস্থিতি হারানোর ঝুঁকি ছিল এবং ইসরায়েল দুর্বল অবস্থায় পড়তে পারত।
তিনি আরও বলেন, প্রথমেই একটি শক্তিশালী ও অপ্রত্যাশিত হামলার কারণে আমরা অসাধারণ ফলাফল অর্জন করেছি।
এদিকে মার্কিন ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন তথ্য আছে যা থেকে ধারণা করা যায় যে ইরান চাইলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারে।
তিনি গত মার্চ মাসে সিনেট কমিটির শুনানিতে মিডিয়ার বিরুদ্ধে তার বক্তব্য বিকৃত করার অভিযোগ করেন। তুলসী গ্যাবার্ড সেই সময় বলেছিলেন, গোয়েন্দা সম্প্রদায় বিশ্বাস করে না যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে।
অন্যদিকে ইরান বারবার জোর দিয়ে বলেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং দেশটির ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার সার্বভৌম অধিকার রয়েছে।
৭.যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলায় যুক্ত হলে মার্কিন জাহাজে হামলার হুমকি হুথিদের
ইসরায়েল ইরানে হামলা চালালে এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্র যুক্ত হলে, লোহিত সাগরে মার্কিন জাহাজগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করবে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। শনিবার এমন হুমকি দিয়েছেন গোষ্ঠীটির সামরিক মুখপাত্র।
গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও হুথি বিদ্রোহীরা একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে, যার অধীনে উভয় পক্ষ একে অপরের উপর হামলা না করার অঙ্গীকার করে।
তবে নতুন করে ইরান ইস্যুতে উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ায় হুতিরা সতর্ক বার্তা দিয়েছে যে, ওয়াশিংটন যদি ইসরায়েলের পাশে থেকে ইরানে হামলায় জড়ায়, তাহলে লোহিত সাগরে মার্কিন নৌযানগুলোকে আর নিরাপদ রাখা হবে না।
৮.ইসরায়েলি হামলায় ইরানে আরও এক পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় ইরানে আরও একজন শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। নিহত বিজ্ঞানীর নাম ইসার তাবাতাবাই গোমশেহ। তিনি তেহরানের স্বনামধন্য শরিফ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক বিজ্ঞপ্তিতে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত সপ্তাহের শেষের দিকে নিজ বাড়িতে স্ত্রী মনসুরেহ হাজিসালেমসহ নিহত হয়েছেন তাবাতাবাই। এর আগে দেশটির সরকারি সূত্রে নয়জন শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানীর মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছিল। এ নিয়ে নিহত বিজ্ঞানীর সংখ্যা দাঁড়ালো ১০ জনে।
এ তালিকায় রয়েছেন ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান ফেরেদুন আব্বাসি, তেহরানের ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি এবং শহীদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দুল হামিদ মিনুচেহর, আহমদ রেজা জুলফাগারি ও আমির হোসেইন ফেঘি। এছাড়া আকবর মোতাল্লেবিজাদেহ, আলী বাকাই কারিমি, মনসুর আসগারি এবং সাঈদ বোর্জি নামের বিজ্ঞানীরাও নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের চ্যানেল-১২ টেলিভিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অপারেশন নার্নিয়া’ (Operation Narnia) নামে এক গোপন অভিযানের মাধ্যমে নয়জন ইরানি পরমাণুবিজ্ঞানীকে একযোগে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এরপর আরও একজন বিজ্ঞানীকেও হত্যা করা হয়। ইসরায়েলি গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, এই অভিযান ছিল অত্যন্ত গোপনীয় এবং এতে বিশেষ প্রযুক্তির ‘গোপন অস্ত্র’ ব্যবহারের ইঙ্গিতও রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিজ্ঞানীরা সবাই নিজ নিজ বাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থায় নিহত হয়েছেন। এতে প্রমাণিত হচ্ছে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির মূল ব্যক্তিদের অবস্থান সম্পর্কে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা সুনির্দিষ্ট তথ্য হাতে পেয়েছিল। ইসরায়েলের উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ধ্বংস করা এবং এর মস্তিষ্কদের নির্মূল করা।
এই ঘটনায় ইরানের জনমনে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। দেশটির সর্বোচ্চ নেতাসহ শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে এর প্রভাব নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
৯.প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে ইরানের ড্রোন হামলায় ‘বিস্মিত’ ইসরায়েল
ইরানের দুটি ড্রোন ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে দেশটির উত্তরাঞ্চলে ও দক্ষিণাঞ্চলে পৃথক হামলা চালিয়েছে। যা অনেকটা অবাক করেছে ইসরায়েলকে। হামলার বিষয়টি স্বীকার করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, এটি একটি বিরল ঘটনা, যেখানে ইরানের একমুখী আক্রমণাত্মক ড্রোন সফলভাবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের খবরে বলা হয়, আজ শনিবার ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে জর্ডান সীমান্তসংলগ্ন বেইত শেইন শহরে একটি ড্রোন আঘাত হানে। এতে একটি দুইতলা বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। জরুরি উদ্ধারকর্মীরা জানান, বিস্ফোরণে বাড়িটির পাশে বড় ধরনের গর্ত সৃষ্টি হয়েছে, জানালা ও দরজা উড়ে গেছে।
ইসরায়েলের জরুরি সেবা সংস্থা মাগেন ডেভিড আডম (এমডিএ) জানিয়েছে, তারা ধ্বংসস্তূপের ভেতর তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে। হতাহত কারও খোঁজ পায়নি।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর তথ্যমতে, ইরানের দ্বিতীয় ড্রোনটি ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের একটি খোলা এলাকায় আঘাত হানে। এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
ইসরায়েল ইরানে হামলা শুরু করার পর থেকে ইরান যে বিপুলসংখ্যক ড্রোন ছুড়েছে, তার মধ্যে বেশির ভাগই লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর আগেই প্রতিহত করা হয় বলে দাবি ইসরায়েলি বাহিনীর।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, ইরানের সর্বশেষ হামলায় অন্তত ছয়টি ড্রোন ছিল। এর মধ্যে কয়েকটি ড্রোন আরাভা মরুভূমি ও গোলান মালভূমিসহ অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছানোর আগেই ঠেকানো হয়।
ইসরায়েলের এক সামরিক কর্মকর্তার মতে, গত সপ্তাহে ইসরায়েল ইরানে হামলা শুরু করার পর থেকে ইরান হামলার জন্য হাজারের বেশি ড্রোন পাঠায়। যা লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর আগেই নিষ্ক্রিয় করা হয়।
১০.ইসরায়েলের হামলায় ইরানে পরমাণু বিকিরণের শঙ্কা, প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান
ইরানের উপস্বাস্থ্যমন্ত্রী আলী জাফারিয়ান জানিয়েছেন, ইসরায়েলের ধারাবাহিক হামলায় পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ক্ষতি হলে সৃষ্ট বিকিরণজনিত ক্ষয়ক্ষতির শিকারদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান।
তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো পর্যন্ত ইসরায়েল কোনো অনানুষ্ঠানিক বা অপ্রচলিত অস্ত্র ব্যবহার করেছে বলে কোনো প্রতিবেদন পাইনি। তবে যদি পারমাণবিক চুল্লিগুলো লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় এবং সেখান থেকে কোনো ধরণের বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তার মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত আছি। যদিও আমরা আশাবাদী যে পরিস্থিতি সেই স্তরে পৌঁছাবে না।’
জাফারিয়ান আরও জানান, এখন পর্যন্ত তিনটি হাসপাতাল ইসরায়েলি হামলার শিকার হয়েছে এবং কেরমানশাহ হাসপাতাল সম্পূর্ণরূপে খালি করে ফেলা হয়েছে।
‘এই সবই বেসামরিক লক্ষ্যবস্তু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উচিত ইসরায়েলকে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা বন্ধ করার জন্য চাপ দেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত দেড় বছরে গাজায় তারা কিছুই করতে পারেনি, তাই আমরা খুব বেশি প্রত্যাশা করি না।’
তিনি আরও নিশ্চিত করেন, ‘গত আট দিনের ইসরায়েলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৪৩০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন এবং ৩,৫০০-রও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।’