ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ মার্কিন শুল্ককে স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, ভারতের সাধারণ মানুষ ও লাখো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জন্য দীপাবলির উপহার হিসেবে আশীর্বাদরূপে এসেছে এই ব্যাপক শুল্কের বোঝা। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক ঘোষণার চাপ থেকে ভারতীয়দের কিছুটা স্বস্তির জন্য কর হ্রাসের ঘোষণা দিয়েছে। একইসঙ্গে, বিগত কয়েকদিনে একাধিকবার তিনি দেশি পণ্যে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য সবাইকে আহ্বানও জানিয়েছেন।
দিল্লিতে স্বাধীনতা দিবসের আয়োজনে দেওয়া ভাষণে দোকান মালিক ও ব্যবসায়ীদের 'স্বদেশি' বা 'মেইড ইন ইন্ডিয়া' (ভারতে তৈরি) সাইনবোর্ড টাঙানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমাদের স্বনির্ভর হতে হবে। এটা আমরা করব বাধ্য হয়ে নয়, বরং আত্মসম্মানের কারণে। বিশ্বে অর্থনৈতিক স্বার্থপরতার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদের দুর্দশা নিয়ে চোখের জল ফেলব না। আমরা সব বাঁধা ডিঙিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো, যেন কেউ আমাদেরকে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে।
রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি তেল ও অস্ত্র ক্রয়ের কারণে ভারতীয় পণ্যের ওপর বাড়তি ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। আগের অন্যান্য শুল্কের সঙ্গে মিলে পরিমাণটি মোট দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে। সেটা কার্যকর হওয়ার কারণে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে হোয়াইট হাউজের অন্যতম মিত্র এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শুল্কের বোঝা বহন করছে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। উল্লেখ্য, ভারত হচ্ছে বিশ্বের পঞ্চম ও এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।
বাড়তি মার্কিন শুল্কের কারণে, পোশাক থেকে হীরা এবং চিংড়ি পর্যন্ত বিপুল পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহ করার সঙ্গে জড়িত লাখো ভারতীয়র জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। তবে ভারতের রফতানি নির্ভর শিল্প থেকে স্বনির্ভরতার আহ্বানকে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মোদির পাল্টা জবাব হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা।
ভারতীয়দের প্রতি মোদির বার্তা খুব স্পষ্ট- দেশে পণ্য উৎপাদন করে দেশেই খরচ করুন।
তবে পুরো বিষয়টি এতো সহজ নয়। বহু সরকারি ভর্তুকি ও প্রণোদনা সত্ত্বেও ভারতের জিডিপিতে উৎপাদন খাতের অংশ বহু বছর ধরে ১৫ শতাংশে স্থবির হয়ে আছে। তবে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত কর সংস্কার বাস্তবায়ন হলে মানুষের হাতে সরাসরি নগদ অর্থের যোগান বৃদ্ধি পাবে, যা অন্তত কিছুটা ক্ষতি সামলাতে পারে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সে পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই, চলতি বছরের বাজেটে ঘোষিত এক হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের আয়কর সুবিধার পর মোদি এখন পণ্য ও পরিষেবা কর (গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স বা জিএসটি) কাঠামোয় বড় পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করছেন।
আট বছর আগে প্রবর্তিত জিএসটি বিভিন্ন স্তরের কর জটিলতা দূর করতে প্রবর্তিত হয়েছিল। তবে জিএসটি প্রক্রিয়ায় ছাড়ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন থ্রেশহোল্ডের কারণে এর জটিলতা আরও বেশি বলে অভিযোগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বারংবার এটি সংস্কারের দাবি তুলেছেন।
তাদের দাবির কারণেই হোক আর মার্কিন বাস্তবতার মুখেই হোক, মোদি বলেছেন, দুই স্তরের সরলীকৃত জিএসটি প্রস্তাব উপস্থাপন করবে ভারতীয় অর্থমন্ত্রণালয়।
মার্কিন ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান জেফরিসের বিশ্লেষণে ধারণা করা হয়, চলতি বছর এপ্রিল থেকে ভারতে কার্যকর আয়কর হ্রাসের সঙ্গে মিলিয়ে জিএসটি সংস্কার (প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারের সমান) ভোগব্যয় বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
ভারতের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি ব্যক্তিগত ভোগব্যয়, যা জিডিপির প্রায় ৬০ শতাংশ। গ্রামীণ অর্থনীতি ভালো ফসলের কারণে শক্তিশালী থাকলেও নগর এলাকায় চাকরিতে ছাঁটাই ও নিম্ন মজুরির কারণে পণ্য ও সেবাগ্রহণের পরিমাণ কমেছে।
বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান মরগান স্ট্যানলির মতে, মোদির আর্থিক প্রণোদনা বা কর ছাড় উদ্যোগে জিডিপি বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতি কমবে। বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতার মধ্যে এ পদক্ষেপ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
কর ছাড় থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেতে পারে সাধারণ ভোগ্যপণ্যের খাত, যেমন স্কুটার, ছোট গাড়ি, পোশাক এবং সিমেন্ট। সাধারণত দীপাবলির আগে এসব পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়।
বিশ্লেষকদের ধারণা, উদ্বৃত্ত কর আদায় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাড়তি লভ্যাংশ থেকে রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করা যাবে। সুইস বিনিয়োগ ব্যাংক ইউবিএস মনে করছে, জিএসটি ছাড় করপোরেট বা আয়কর হ্রাসের চেয়ে বেশি কার্যকর হবে, কারণ এটি ক্রয়ের সময় সরাসরি ভোগব্যয়ে প্রভাব ফেলবে।
মোদির প্রণোদনার কারণে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হারও আরও কমাতে পারে। দেশটির আর্থিক কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই সুদের হার ১ শতাংশ কমিয়েছে, যা ঋণপ্রবাহ বাড়াতে পারে। আগামী বছরের শুরুতে পাঁচ লাখ সরকারি কর্মচারীর বেতনবৃদ্ধিও অর্থনীতিকে গতিশীল রাখবে।
বিনিয়োগকারীরাও এ উদ্যোগে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। চলমান শুল্ক সংকটের মধ্যেও আগস্টে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল থেকে সার্বভৌম ঋণমান উন্নতি ঘটেছে ভারতের। প্রায় ১৮ বছর পর এই অগ্রগতি দেখলো দেশটি। এই তালিকায় অগ্রগতির কারণে কোনও দেশের সরকারের জন্য ঋণ গ্রহণের খরচ কমাতে ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
তবে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সংস্কার ত্বরান্বিত হলেও, ভারতের প্রবৃদ্ধি নেমে গেছে। আর বাইরের সংকটও প্রশমিত হয়নি।
রুশ জ্বালানি তেল ক্রয়কে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটন-দিল্লি কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি বিগত সপ্তাহগুলোতে কেবল আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি, দুপক্ষের মধ্যে হতে যাওয়া বাণিজ্য আলোচনাও স্থগিত করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যত বিশ্বের বৃহত্তম ও দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশদুটোর মধ্যে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার সমান, যা কয়েক মাস আগেও কল্পনা করা কঠিন ছিল।