বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরতে পারবেন কিনা অথবা আদৌও ফিরবেন কিনা--তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা যেন কমছেই না। হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, ‘তিনি (হাসিনা) দেশের পরিস্থিতি নিয়ে খুবই হতাশ। কারণ গত ১৫ বছরে তার সব পরিশ্রম প্রায় বিফলে যাচ্ছে।’ সম্প্রতি জয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছে টাইম ম্যাগাজিন। সেই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতেই বিশেষ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ম্যাগাজিনটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ক্ষমতাচ্যুত হতে পারেন তা কেউ ভাবতেও পারেনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোটা ইস্যু অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো নানান বৈষম্য ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বাংলাদেশের জনসাধারণের ক্ষোভকে উসকে দেয়। যার ফলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। এখনও ভারতেই অবস্থান করছেন তিনি। আর ওই আন্দোলনে সহিংসতায় প্রায় এক হাজার মানুষ মারা যায়। এরমধ্যেই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। আর এই সরকার সংস্কারের কথা বারবার উচ্চারণ করছেন।
এরই মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারি প্রশাসন এবং জাতীয় সংবিধানকে কেন্দ্র করে ছয় দফা সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
তবে সংস্কারপন্থীদের আশঙ্কা দেশকে দ্রুত সংস্কারের দিকে নিয়ে যেতে না পারলে আওয়ামী লীগ আমলের নানান দুঃসহ স্মৃতি সাধারণ মানুষের মন থেকে মুছে যেতে শুরু করবে।
কারণ সংস্কারপন্থীরা সত্যিই একটি জটিল পরিস্থিতিতে রয়েছেন। অর্থবহ সংস্কার কার্যকর করতে এবং যারা নির্যাতনের জন্য দায়ী তাদের জবাবদিহিতায় আনতে সময় লাগবে। কিন্তু দিকনির্দেশনাহীন একটি দেশে যেখানে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সংগ্রাম করছে, তারা ধৈর্য হারাতে বেশি সময় নেবে না।
গত সপ্তাহে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যার কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৬.৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫.১ শতাংশে এনেছে।
অথচ বাংলাদেশের জিডিপি ২০০৬ সালে ৭১ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২ সাল নাগাদ ৪৬০ বিলিযন ডলারে পৌঁছেছিল। অবশ্য এরপর থেকেই দেশে দুর্নীতি, দমন-পীড়ন, বৈষম্যের হারও পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল। বিশেষ করে সাম্প্রতিক নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু নয় বলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তা গ্রহণযোগ্য ছিল না।
এমন পরিস্থিতিতে নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি অধ্যাপক মুবাশার হাসান বলেন, ‘এই সরকারের বৈধতা রয়েছে, জনসমর্থন রয়েছে, কিন্তু জনমত নেই।’
হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারছেন না উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। তিনি বলেন, ‘হাসিনার প্রত্যাবর্তন সম্ভব। দক্ষিণ এশিয়ার পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে দেউলিয়া মনে হলেও এ দলগুলোকে একেবারে বাতিলের খাতায় ফেলতে পারবেন না। এমনকি যখন তারা দুর্বল অবস্থায় থাকে তখনও না।'
অন্যরা অবশ্য হাসিনার প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে কুগেলম্যানের মতো এত আত্মবিশ্বাসী নন। মুবাশার হাসান বলেন, সারা বাংলাদেশে হাসিনার পোস্টার ছেঁড়া হয়েছে, বিকৃত করা হয়েছে। তাকে স্বৈরাচার হিসেবে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম হাসিনাকে এভাবেই দেখছে।
জয় বলছেন, হাসিনা নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য দেশে ফিরবেন কিনা, সে বিষয়ে ‘কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।’
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম যদি স্থবির হয়ে পড়ে, তাহলে যে হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সুযোগ বাড়বে, সে বিষয়ে সবাই একমত। ঢাকাভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের মতে, ‘আগামী দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হাসিনা ও তার দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কোনও সুযোগ নেই। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হলে এই প্রেক্ষাপট বদলে যেতে পারে।’
ব্যাপক রাজনৈতিকীকরণ হওয়া আমলাতন্ত্রও এই সরকারের সংস্কার বাধাগ্রস্ত করতে চেষ্টা করছে বলেন উল্লেখ করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল শহিদুল হক। তিনি বলেন, ‘সংস্কারে বাধা দিতে হেন প্রচেষ্টা নেই,যা এই প্রশাসন করছে না। তারা এই সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। ফলে দৃশ্যমান কোনও উন্নতি না হলে মানুষ ধৈর্য হারাবে।’
জয়ও এই আশাতেই আছেন। বর্তমান ‘অরাজক’ পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার যদি এক বছর বা ১৮ মাস দেশ পরিচালনা করতে চায়, তাহলে ঠিক আছে।’
হাসিনার পতনের পর পুলিশ ও সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক হামলার অভিযোগ উঠলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপ-পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘কোনও দাঙ্গা হয়নি। বড় আকারের আক্রমণ দেখিনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি।’
এছাড়া এই সময়ে বাংলাদেশকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। গত মাসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে হোয়াইট হাউজে দেখা করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সমর্থন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মেজর জেনারেল শহিদুল হক বলেন, ‘মার্কিন সমর্থনই অন্তর্বর্তী সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।’
তবে অচলাবস্থা চলতে থাকলে অস্থিরতাও বাড়তে থাকবে। যদিও জয় তার মায়ের দমন-পীড়নের কিছু ভুল স্বীকার করেছেন। তবে তিনি জোর দিয়ে দাবি করছেন, অন্তত অর্ধেক হত্যাকাণ্ড জঙ্গিরা ঘটিয়েছে; যারা সম্ভবত ‘বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা’ থেকে অস্ত্র পেয়েছিল।
তবে জয়ের এই দাবির সপক্ষে বলার মতো কোনও প্রমাণ নেই। বরং মিনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, ‘পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং আন্দোলন দমনের আদেশ দেওয়ার অসংখ্য ভিডিও রয়েছে।’
এছাড়া দলের সদস্যদের মধ্যেই সমর্থন ধরে রাখতে পারাটা এখন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর দলের প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় নেতা দেশ ছেড়েছেন। ফলে সাধারণ সদস্যদের ভোগান্তি বেড়েছে। মুবাশার বলেন, ‘শেখ হাসিনা যেভাবে চলে গেলেন, তা একরকম বিশ্বাসঘাতকতাই।’
এছাড়া দেশের অর্থ লুটপাটের জন্য আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ছে। হাসিনা শাসনের ১৫ বছরে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীরা প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে পাচার করেছেন। ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট জয়ের বাংলাদেশের ব্যাংক হিসাবও ফ্রিজ করেছে। তবে তিনি দুর্নীতির সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘আমাদের দেখান, টাকা কোথায়? অভিযোগ করা সহজ।’
এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হলে দলটিকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন অনেকেই।
অবশ্য টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই দাবিকে হাস্যকর বলেছেন জয়। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দলকে কীভাবে নিষিদ্ধ করবেন? এটি আইনিভাবেও সম্ভব নয়।’
এমনকি সংস্কারপন্থী ও বিরোধী দলগুলোও নিশ্চিত নয় যে, একসময় ব্যাপক তৃণমূল সমর্থন পাওয়া একটি দলকে নিষিদ্ধ করে জাতীয় স্বার্থের কোনও লাভ হবে কি না। বরং বর্তমানে তাদের মূল লক্ষ্য গত কয়েক দশক ধরে চলে আসা প্রবল রাজনৈতিক প্রতিশোধের এই চক্র থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা। তবে প্রতিশোধপরায়ণ হাসিনার অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব কিনা, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
জিল্লুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে তার ব্যক্তিত্বের পূজা। দলটি শেখ মুজিবের কন্যার বিকল্প কল্পনা করতে পারে না।
আর তার নাতি? জয় শেখ হাসিনার বিকল্প হতে পারবেন কিনা,এই প্রশ্নের জবাবে জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘যদি তিনি বাংলাদেশের জনগণের নেতা হিসেবে নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে না পারেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই।’
তার এই মন্তব্যে একমত পোষন করে মুবাশার হাসানও বলেন, তরুণদের মধ্যে জয়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ নেই। আর মানুষের মতামত গুরুত্বপূর্ণ।’
অবশ্য জয় এখনও রাজনীতিতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেননি। টাইম ম্যাগাজিনকে তিনি বলেন, ‘আমার কখনও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়, কে জানে? আমি এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেইনি।’