মাহবুবুর রহমানের নতুন বই 'যুক্তরাজ্যে বিয়াল্লিশ দিন'

অপূর্ব শর্মা
  ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫০

ভূমিকাঃ স্বাধীনতা পরবর্তী সিলেটের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাসে যে-ক'জন কলমসৈনিক অনন্য উচ্চতায় আসীন হতে সক্ষম হয়েছেন তাদের মধ্যে মাহবুবুর রহমান অন্যতম। এ অঞ্চলের প্রাচীন সংবাদপত্র যুগভেরীতে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয় তাঁর। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। নিজ মেধা প্রজ্ঞা এবং কর্মদক্ষতায় অল্পসময়ে পত্রিকাটির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন তিনি। একই সময়ে সিলেট প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। যুগভেরীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবং প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব তিনি পালন করেন নিষ্ঠার সঙ্গে। সাংবাদিকদের দাপট ও সম্মানের সেই সময়ে নিজস্বতার অনেক আখ্যান রচনা করেন মাহবুবুর রহমান। যা আজও সহকর্মীরা স্মরণ করেন গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। সেই গল্পগুলোর অধিকাংশই চমকজাগানিয়া। অগ্রজদের কাছ থেকে তাঁর নানা ভূমিকার কথা শুনতে শুনতে তাঁকে চেনা এবং জানা দুটোই হয়ে যায়। কিন্তু আমেরিকায় অভিবাসী হওয়ায় নামের সঙ্গে পরিচয়ের এক দশক পর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়। ২০১৫ সালে তাঁর সম্মানে আয়োজিত সিলেটে একটি অনুষ্ঠানে প্রথম আলাপেই তিনি আমাকে আপন করে নেন। কিন্তু সেদিন একটি বারের জন্যেও মনে হয়নি এর আগে তাঁর সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি। মনে হয়েছে, তিনি অনেক-অনেক দিনের পরিচিত। 
সাংবাদিকতার পাশাপাশি প্রবন্ধ, নিবন্ধ এবং কলাম লেখায় মাহবুব ভাইয়ের রয়েছে বিশেষ দক্ষতা। যে-কোনও ঘটনাকে অতি সহজে গল্প এবং নাটকীয়তার মিশেলে তিনি উপস্থাপন করেন মুনশিয়ানার সঙ্গে। তাঁর লেখা পড়তে শুরু করলে এক নিশ্বাসে শেষ না-করে ওঠা কঠিন। কিন্তু যার কলম এমন ক্ষুরধার তাঁর কোনও গ্রন্থ প্রকাশিত না-হওয়া ছিল আশ্চর্যের বিষয়। তাঁকে গ্রন্থ প্রকাশের প্রস্তাবনা দিলে তিনি বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, 'আমার লেখায় এমন-কিছু নেই যা দিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করা যায়।' বাস্তবতা হচ্ছে, তাঁর প্রতিটি লেখায় ইতিহাসের এত এত উপাদান বিদ্যমান যে, তা যদি গ্রন্থভুক্ত করে না রাখা হয় তাহলে ইতিহাসেরই ক্ষতি হবে। কিন্তু, আমি যতই বলি, তিনি সেটা মানতে নারাজ। অনেক চেষ্টার পর তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হই। বের হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ ফ্রিডম ইজ নট ফ্রি। গ্রন্থটি প্রকাশের পর ব্যাপক প্রশংসিত হয়। বইটির গঠনমূলক আলোচনায় তিনি উপলব্ধি করেন যে, লেখাগুলোকে মলাটবন্দি না করলে অনেক-কিছুর মতো এগুলোও হয়তো ছাইচাপা পড়ে যেত। একইসঙ্গে তিনি উদ্বুদ্ধ হন, দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রকাশে। কিন্তু মুশকিলের ব্যাপার হলো, যে বিষয়ে গ্রন্থ প্রকাশে তিনি আগ্রহী সে বিষয়ের পান্ডুলিপিটি নেই তাঁর কাছে। এটি ধারাবাহিকভাবে যুগভেরীতে প্রকাশিত হয়েছে। তা-ও আজ থেকে চারদশক পূর্বে। যুক্তরাজ্য ভ্রমণের ইতিবৃত্ত নিয়ে লেখা, 'যুক্তরাজ্যে বিয়াল্লিশ দিন।' তিনি নিজেই বলেন, 'এটি কঠিন কাজ। তবে, তোমার পক্ষে অসম্ভব নয়।' তাঁকে ভরসা দিলাম, আশ্বস্ত করলাম এই বলে, 'আমার যত কষ্ট-ই হোক না কেন, যুক্তরাজ্যে বিয়াল্লিশ দিন অবশ্যই গ্রন্থাকারে বের হবে।' শুরু হলো কাজ। কিন্তু জরাজীর্ণ এবং প্রায় বিনষ্ট হয়ে যাওয়া অনেক পাতা থেকে উদ্ধার করে লেখাগুলোকে কম্পোজের পর্যায়ে নিয়ে আসা সত্যিই অনেক কঠিন ছিল। পান্ডুলিপি তৈরি করে পাঠালাম। পাঠশেষে তিনি বললেন, অনেকগুলো প্রশ্নবোধক যুক্ত করে দিয়েছি। তুমি দেখে নিয়ো। সম্পদনার দায়িত্ব তোমাকে পালন করতে হবে। অসংগতিগুলোও দূর করতে হবে তোমাকেই। 
গ্রন্থটি ভ্রমণাভিজ্ঞতা নিয়ে হলেও এতে রয়েছে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাঙালিদের জীবন-বাস্তবতার বিশ্লেষণ। দূর থেকে দেখা বিলেত এবং কাছ থেকে দেখা বিলেতের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক রয়েছে, তা উঠে এসেছে মাহবুব রহমানের লেখায়। এ কথা বলাই যায়, মাহবুবুর রহমান বিলেতকে দেখেছেন পাখির চোখে। এবং সেই দেখা এবং জানাকে উপস্থাপন করেছেন নির্মোহভাবে। তবে, এটা ভাবলে বিস্ময় জাগে, কোনও ধরনের পূর্ব-পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি ছাড়াই যুক্তরাজ্যে বিয়াল্লিশ দিন লিখেছেন তিনি। নোট ছাড়া শুধুমাত্র স্মৃতিকে অবলম্বন করে ভ্রমণের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আখ্যান বিবৃত করা মোটেই সহজ কাজ নয়। স্মৃতিশক্তি কতটা প্রখর হলে এমনটি সম্ভব, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মূলত সহকর্মী এবং স্বজনদের অনুরোধেই যুক্তরাজ্যে বিয়াল্লিশ দিন লিখতে শুরু করেন মাহবুবুর রহমান। লেখা প্রকাশের পর পাঠকদের অনুভূতি তাঁকে আকৃষ্ট করে নতুন পর্ব লেখায়। মোট ২৮টি পর্ব লিখেছিলেন। এরপর আর কোনও পর্ব ছাপা হয়নি পত্রিকায়। ১৯৮৫ সালের ৩০ আগস্ট যুগভেরীর প্রাণপুরুষ আমীনূর রশীদ চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যুতে পরিসমাপ্তি ঘটে তাঁর লেখার। কোনও ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ হয়ে যায় ভ্রমণবৃত্তান্ত। যার ফলে আরও অনেক-কিছু জানা থেকে বঞ্চিত হন পাঠকরা।  
যুক্তরাজ্য বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখের সামনে উন্নত এবং আধুনিক জীবনের যে প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, সেজন্য ঠিক কতটা সংগ্রাম করতে হয় অভিভাসীদের, সেটিই মূলত ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন তাঁর প্রতিটি লেখায়। ইস্ত্রি করা জীবনের পেছনের বিষাদ-বেদনা তিনি তুলে এনেছেন কালির আঁচড়ে।
ভালো লাগার প্রসঙ্গ উঠলেই প্রথমে মনে পড়ে ওদের গতির কথা। কত দ্রুত তাদের জীবনটা। কি পুরুষ কি মহিলা, কি তরুণ কি বৃদ্ধ, সবার জীবনটাই চলছে দ্রুতলয়ে। গতিময় ছন্দময়। জীবনযাত্রায় কোনও আলস্য নেই। নেই মন্থরতা। 
এই গতি যেমন কর্মে তেমনই পথচলায়, তেমনই জীবনের নানা ক্ষেত্রে। সময়টা যেন এখানে বেঁধে দেওয়া। একটি মুহূর্তও যেন বৃথা যেতে পারে না। জীবন ও সময় চলছে পাশাপাশি।
এই কথাগুলোর মধ্যেই নিহিত আছে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাঙালির কথকতা। দূর থেকে দেখা বিলেত এবং যাপনের মধ্য দিয়ে দেখা বিলেত যে এক নয়, সে কথা শুরু থেকে শেষ অবধি নানান ব্যাখ্যায় উপস্থাপন করেছেন তিনি। পরিচিতজনের জীবনের ছোটোখাটো গল্প, তার যুদ্ধ-অগ্রগতি সংক্ষেপে তুলে ধরলেও এর মধ্য দিয়ে প্রায় সকলের কথাই তিনি বলার চেষ্টা করেছেন।
প্রত্যেক প্রবাসীর জীবনই সংগ্রামমুখর। প্রাত্যহিকতার প্রতিটি পদে পদে যে-বিরুদ্ধতাকে মোকাবেলা করে তাদের এগিয়ে চলা, তা সত্যিই অতুলনীয়। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেকালের বিলেতপ্রবাসী বাঙালিদের দুর্ভোগের কথা সহজে উপলব্ধি করা যাবে না। বিপৎসঙ্কুল পরিবেশ পরিস্থিতি ওই সময় মোকাবেলা করেননি এমন প্রবাসী হয়তো একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারপরও উন্নত জীবনের জন্য, পরিবার-পরিজনের জন্য দিনরাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রবাসীরা তৈরি করেছেন নিজের পায়ের তলার মাটি। আজ ২০২৪ সালের যে-সময়টায় যুক্তরাজ্যে বিয়াল্লিশ দিন গ্রন্থের ভূমিকা লিখছি তখন বর্ণবাদ আন্দোলনে ব্রিটেনের পরিস্থিতি অশান্ত। লেখক নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন ভ্রমণকালীন। তাঁর ভাষ্যে শুনে নেওয়া যাক সেদিনের ঘটনা।
সময় তখন বিকেল। সন্ধ্যা নামবে একটু পরেই। রচডেইল শহরের এক পাবলিক টয়লেটের কাছে গাড়ি এসে থামল। প্রাকৃতিক কর্ম সারার জন্য আমি ও শুকুর আলী দু'জনেই গাড়ি থেকে নেমে টয়লেটে ঢুকলাম। প্রশস্থ টয়লেট। একসাথে কয়েকজন কাজ সারতে পারেন। আমরা যখন ঢুকি তখন টয়লেটে কেউ ছিল না। কিন্তু আধ মিনিটের মধ্যেই কোত্থেকে একসঙ্গে আট-ন'জন যুবক এসে ঢুকে পড়লো। তাদের কেউ নির্দিষ্ট জায়গায়, কেউ জলের সিঙ্কে, যে-যেভাবে পারে প্রস্রাব করতে শুরু করলো। শুধু তা-ই নয়, এসঙ্গে আমাদের দু'জনকে লক্ষ্য করে অশ্রাব্য অশ্লীল  কথাবার্তা বলতে থাকলো। চার দেয়ালের মাঝে এরূপ আচমকা আচরণে আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। একটা শব্দও মুখ থেকে বেরুলো না। শুকুর আলীও নীরবে কাজ শেষ করে বের হয়ে এলেন। আমিও বাইরে এলাম। একইসঙ্গে ওরাও। বাইরে এসে ওদের এক যুবক আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো, আমাদের দু'জনের ভাগ্য নাকি আজ খুব ভালো। তা না-হলে...। তা না-হলে তারা যা করতো তা মুখেও আনা যায় না। কী অসভ্য! শুকুর আলী ছাড়বার পাত্র নন। যুবকের কথা শুনে তার মুখ লাল হয়ে গেল। প্রচন্ড রাগে তার শরীর কাঁপছিল। শুকুর আলীও যুৎসই একটি জবাব দিয়ে দিলেন। আমি ততক্ষণে গাড়িতে এসে বসে পড়েছি। শুকুর আলীর জবাব পেয়ে কয়েকজন যুবক গাল দিয়ে তাঁর দিকে ছুটে এলো। শুকুর আলীও ভয় পাওয়ার পাত্র নন। আহবান  জানালেন আসার জন্য। এদিকে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেছে। এদের ন'জনের সঙ্গে আমরা দু'জন কী করে পারবো! শুকুর আলীর পাকিস্তানি বন্ধুটি কি সাহায্য করবেন? পেছনের আসনে সে বন্ধুটি নড়েচড়ে বসলেন। শুকুর আলী গাড়ির দরজার কাছে এসে পৌঁছেছেন। গাড়ি সদর রাস্তায়। রাস্তায় লোহার বেড়ার পরেই ফুটপাত। ফুটপাতে ওরা ন'জন। ইতোমধ্যে দু'তিন জন বেড়া টপকাবার জন্য লাফ দেওয়ার কসরত করছে। কিন্তু না। বেড়া টপকালো না।
একটা সময় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং আতঙ্কের মধ্যে দিন অতিবাহিত করতে হতো প্রবাসীদের। যে-কোনও সময় আক্রান্ত হবার ভয় ছিল। ঘুম থেকে উঠে দড়জা খুলেও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো। সেইদিন নিজেরাই বদল করেছেন প্রবাসীরা। ব্রিটেনের মূলধারার রাজনীতিতে অভিবাসীদের শক্ত অবস্থান দৃশ্যপটে এনেছে পরিবর্তন। 
মাত্র ৪২ দিনে এত অভিজ্ঞতা তিনি সঞ্চয় করেছেন যা সাধারণ কারও পক্ষে কোনওভাবেই সম্ভব নয়। তবে, এই অভিজ্ঞতা বা দেখা নিয়ে তিনি কিছু লিখবেন না বলে মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু সহকর্মী ও স্বজনরা তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, অন্যের দেখা এবং তাঁর দেখার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। তিনি যদি লেখেন তাহলে পাঠকরা বিলেতকে জানতে পারবে ভিন্নভাবে। গ্রন্থের শুরু থেকে শেষ অবধি সেই ভিন্নতার স্বাদ দিতে চেষ্টা করেছেন তিনি। শুধু উপস্থাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি লেখক, ঘটনার বিশ্লেষণ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা উপস্থাপন সেই সঙ্গে অল্পকথায় পটভূমি তুলে ধরে পাঠককে আগ্রহী করে তুলেছেন। 
অনেকের ভ্রমণকাহিনি একঘেয়েমিতে ভরপুর থাকে। তৃতীয় চোখে দেখার সক্ষমতা থাকে না সবার। কিন্তু মাহবুবুর রহমানের মধ্যে তা এতটাই প্রথর যে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মনে হবে লেখাগুলো স্বতন্ত্রতায় সমুজ্জ্বল। প্রাসঙ্গিক তো বটেই। গ্রন্থটিকে এক সাংবাদিকের বিলেত ভ্রমণের অনন্য আখ্যান বললে অত্যুক্তি হবে না মোটেই। আজ যখন লেখক সেই সময়কে ফিরে দেখেন তিনি নিজেও বিস্মিত হন। উনচল্লিশ বছরে এই গ্রন্থে আলোচ্য অনেক ব্যক্তি যেমন প্রয়াত হয়েছেন তেমনই সুরমা এবং টেমসে গড়িয়েছে অনেক জল। কিন্তু লেখক সেই সময়টাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিতে। পাঠকরা সেই সময়ে ফিরে গিয়ে এই সময়ের সঙ্গে ব্রিটেনের মিল-অমিল খুঁজে নিতে পারবেন অনায়সে। এখানেই মাহবুবুর রহমানের সার্থকতা।