আনিকার বিয়ে হয়েছে চার মাস। এখন তার নতুন সংসার। অথচ সেই সংসার ছেড়ে আসতে হলো। বাবা-মায়ের বড় মেয়ে আনিকা। ওরা দুই বোন। ছোট বোন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে। সংসারের দায়িত্ব এখন আনিকার মাথায়। বিয়ের আগেই সব বলে দিয়েছে স্বামী হাবিবকে। কটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ৩০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে আনিকা। নিজের হাত খরচের টাকা রেখে বাকি টাকা বাবার কাছে দিয়ে দেয় আনিকা।
আনিকা শ্বশুরবাড়িতে বিয়ের আগেই বলে দেয় সবকিছু জেনে যদি বিয়ে করতে চায় হাবিব তাহলে আনিকা রাজি। কারণ আনিকাকেই এই পরিবার চালাতে হবে। হাবিরের বাবা, মায়ের একটাই কথা তারা শিক্ষিত, ভালো পরিবারের একটা ভদ্র মেয়ে চায় ছেলের বউ হিসেবে। তাদের যথেষ্ট আছে। ঢাকায় বাড়ি আছে নিজেদের। গাড়িও আছে। তাছাড়া আনিকা দেখতেও সুন্দর। বলতে গেলে তারা আনিকার বাবা, মায়ের হাত ধরে বিনয়ের সাথে আনিকাকে চায়।
আনিকার বাবা মায়ের যতটুকু সামর্থ্য তার চেয়ে বেশি দিয়ে বেশ ভালো ভাবেই বিয়ে দেয় মেয়ের। হাবিবের বাবাও বড় করে অনুষ্ঠান করে ছেলের বিয়ে দিল। আনিকার মা হাবিবের মায়ের হাত ধরে বলে, আমার মেয়ে তেমন রান্না পারে না। আপনি মা। এখন ধীরে ধীরে শিখিয়ে নিবেন। হাবিবের মা বলেছিল, চিন্তা করবেন না। কাজের লোক আছে। আনিকা শিখে নিবে আস্তে আস্তে।
সেদিন আনিকার মায়ের মন ভরে যায় আনন্দে। এতো ভালো শাশুড়ি পেয়েছে তার মেয়ে। তাকে অবশ্য সারাজীবন কথা শুনতে হয়েছে শ্বশুর বাড়ি থেকে। আনিকার ফুফু, দাদী এরা সবসময়ই বলে, আনিকার মা শশুর শাশুড়িকে দেখেনি। আসলে এটা সত্য নয়। আনিকার বাবা এনজিওতে চাকরি করতো। কিছু দিন পর পর বদলি হতো। আনিকার মাও তার স্বামীর সাথেই থাকতো। আর আনিকার দাদা, দাদী বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না।
অসম্ভব ভালো ব্যবহার পেয়েছে এই কয়দিনে আনিকার মা হাবিবের পরিবার থেকে। মনেই হয় না এতো ব্যবধান দুই পরিবারের। বিয়ের দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। শশুর সবসময় খেয়াল রাখতো আনিকা ঠিকমতো খাচ্ছে কিনা? কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা? অফিসে যাওয়ার জন্য তাদের গাড়িও দিত।
সমস্যা শুরু হলো আনিকা যখন মাসের বেতন পেয়ে আগের মতোই বাবার হাতে দিয়ে এলো। তবে আনিকা বেতন পেয়ে শশুর বাড়িতে নাস্তা খাবার কিনে আনলো। ধীরে ধীরে শুরু হলো সমস্যা। আনিকা এটা করো ওটা করো। আনিকা করতো সবকিছু। কারণ সে জানে এট শ্বশুর বাড়ি। অফিস থেকে এসে যতটুকু পারে আনিকা করে। বাসায় সারাদিনের বাঁধা কাজের লোক বাদ দেয় আনিকার শাশুড়ি। ছুটা লোক রাখে।তিন বেলা তিনজন কাজের লোক আছে।
কিছু দিন পর আনিকার খালা শাশুড়ি এসে আনিকাকে বলেন, তোমার হাত খালি কেন? হাত খালি থাকলে মেয়েদের হাত পুরুষ মানুষের মতো লাগে। নিজে টাকা জমিয়ে হাতের জিনিস করবে। আনিকা বুঝতে পারে কী বলা হচ্ছে তাকে। অথচ আনিকার মা প্রথমেই বলে দিয়েছিল, আমাদের কোনো স্বর্ণ দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আজ একথার অর্থ হলো, হয় নিজের চাকরির টাকায় করো। না হয় বাপের বাড়ি থেকে আনো।আনিকা কিছু না বলে বাথরুমে এসে কাঁদে।
কিছু দিন পর অফিস যাওয়ার সময় আনিকাকে আর গাড়ি দেওয়া হয় না। একাজ ওকাজ আছে বলা হয়। শুধু অফিস থেকে আনবে। তাও মাঝে মাঝে বাদ দেয়। আনিকা হাবিবকে বলে, আমার গাড়ি লাগবে না। আমি গরীব ঘরের মেয়ে। বাস, রিকশায় চড়ে অভ্যস্থ। হাবিব বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে চাইলে, আনিকা নিষেধ করে। কারণ সে চায় না এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি হোক। সবাই বলবে, নতুন বউ এসেই বাবা মায়ের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করছে।
এক মাস না হতেই শুরু হয় অফিসে খাবার নিয়ে যাওয়া নিয়ে সমস্যা। প্রায়ই অফিসে খাবার নিতে পারে না আনিকা। দুপুরে বাহির থেকে খাবার এনে খায়। অফিসের কলিগরা দেখে। আগের আনিকা আর আজকের আনিকা কতো ভালো আছে। আনিকা চুপ করে থাকে। আনিকা বাসায় নাস্তা কিনে না নিলে বাসায় নাস্তা খাওয়ারও কিছুই থাকে না।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আনিকার ছোট ছোট চাওয়াগুলোও হাবিব পূরণ করে না। যাই চায় বলে এটা লাগবে না। ওটা ভালো না। অল্প দিনেই আনিকার কাছে নতুন সংসারে অসহ্য হয়ে ওঠে। সামান্য চাওয়াগুলোকে হাবিব আনিকার চাহিদা বেশি বলে।
আনিকা হাবিবকে একদিন নাস্তা আনার কথা বললে, হাবিব উত্তর দেয় একটু আগে রাতে ভাত খেলে। এখন নাস্তা লাগে নাকি? স্বামীর কাছে স্ত্রীর যেন কোনো দাবি বা চাওয়া পাওয়ার থাকতে পারে না। আসলে তারা চায় আনিকা নিজের টাকা দিয়ে নিজেই চলুক। অথচ স্বামীর কোনো অভাব নেই। ভালো চাকরি করে সে।
প্রথমে আনিকার শ্বশুর নিজে হাবিবকে শুক্রবার হলেই বলতেন, আনিকাকে নিয়ে ঘুরতে যাও। এক মাস পরে বলেন, সপ্তাহে একদিন ছুটি পায় ছেলেটা বাসায় রেস্ট নিক। এমনকি বাহিরে গেলেও প্রায়ই আনিকার খাবারের বিল দিতে হয়। হাবিব ইচ্ছা করে শুধু কার্ড নিয়ে বের হয়। হাবিবাকে যদি বাসায় ফিরে বলে, বিলের টাকা দিবে না আমাকে? হাবিব বলে, ওটা কী দিতে হবে? আনিকা আর কিছুই বলে না।
হাবিবের কিছু মানসিক সমস্যা আছে। এটা আনিকা বুঝতে পারে। হাবিব তার ছোট ভাইয়ের সাথেও আনিকার ছবি তোলা বা বেশি কথা পছন্দ করে না। আনিকার মামতো ভাই একদিন হাবিবের কাছে জানতে চায়, আনিকা আপু কোথায়? এটা নিয়েও হাবিব কথা শোনায় আনিকাকে। সে কেন জিজ্ঞেস করে? আনিকা হাবিবকে বলে, আমার ঐ ভাই আমার সাত বছরের ছোট। হাবিব বলে, তাতে কী? ও তো নিজের ভাই না। আনিকা অবাক হয়। খারাপ লাগলেও আর কথা বাড়ায় না।
আনিকার বাবা মা খুব অসুস্থ থাকে। বাবার হার্টের সমস্যা। তাই সবকিছু বলে না। কিন্তু মেয়ের মুখ দেখে মা অনেক কিছু বুঝতে পারে। কিছু কিছু কথা মা’কে মনের কষ্টে বলেও আনিকা। সেদিন আনিকার খুব মাথা ব্যাথা করছে। হাবিবকে ঔষধের কথা বললে বলে, এটও কী আমার আনতে হবে? আনিকা রাগ করে কিছু বলে না। শাশুড়ি মাকে শুধু বলে যায় আমি আজ বাবার বাসায় যাচ্ছি। দুই দিন থাকবো। আমার মায়ের শরীর ভালো না। সেদিন আনিকার শ্বশুর শুনিয়ে দেয়, তুমি তো রান্না পারো না। যেয়ে কী লাভ? আনিকা শুধু বলে, আমি গিয়ে ডাক্তার দেখাবো। আগেও এগুলো আমিই করতাম। আমি ছাড়া কেউ করার নেই।
সেদিন অফিস থেকে ফিরে মায়ের বাসায় আনিকার জ্বর আসে। অথচ মনের কষ্টে সে হাবিবকে বলে না। মা বুঝতে পারে কিছু হয়েছে। আনিকা কিছু বলার আগেই হাবিব আনিকার মা’কে ফোন করে আনিকা সম্পর্কে অনেক কিছু বলে। আনিকার মা হাবিবকে বুঝায় যে আনিকা আসলে কথা বলবে।
আনিকাকে তার মা বোঝায়। ধৈর্য ধরতে বলেন। ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এই সাান্ত¦না দেন। তিনিও জানেন মেয়েদের জীবন এতোটা সহজ নয়। অনেক উঁচু নিচু পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে। মেয়েদের জীবন বিয়ের পরে হঠাৎ করেই যেন বদলে যায়। জীবন যেন অচেনা পথে মোড় নেয়। যে মানুষটার জন্য সবকিছু ছেড়ে চলে আসে একটা মেয়ে। সেই মানুষটাই যদি আপন না। সেখানে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই মিলে না।