প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘ফুলের মূল্য’ একটি করুণ রসের গল্প। তাতে গভীর জীবনবোধের অবিনশ্বর স্বাক্ষর রয়েছে। যেন লেখকের হৃদয়বৃত্তির অনুপম প্রকাশ। গল্পের পটভূমি বিলাত। কাহিনির সূত্রপাত লন্ডনের এক নিরামিষ ভোজনশালায়। কিন্তু সেখানে প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষে নিযুক্ত এক সৈনিকের জীবন বিয়োগের কাহিনি।
তেরো কিংবা চৌদ্দ বছরের এক ইংরেজ বালিকা গল্পটির নায়িকা। অশ্রুসজল অপরূপ ভালোবাসার সাম্রাজ্যে প্রভাতকুমার যেন কিছুক্ষণের জন্য তাঁর নিজস্ব স্বভাবধর্ম বিস্মৃত হয়েছেন! গল্পের শান্ত করুণ পরিবেশকে মুহূর্তের জন্যও উচ্চকিত করেনি। গল্পের গায়ে মমতার আশ্চর্য প্রলেপ, মাধুর্যের অপরূপ আস্বাদ মেখে দিয়েছেন। মানুষের হৃদয়বৃত্তির প্রকাশ যে দেশকাল নিরপেক্ষ; গল্পটিতে সেই সত্যই সোচ্চার হয়েছে।
‘ফুলের মূল্য’ গল্পের ম্যাগি এক বুক-চাপা বেদনার নীরব প্রতিমা। স্নেহে সজল, কর্তব্যে অবিচল বালিকাটি শুধু করুণার পাত্রী নয়, শ্রদ্ধারও পাত্রী। নিদারুণ দুঃখের হাত থেকে বৃদ্ধা মাকে বাঁচাতে তার প্রয়াস ও পরিকল্পনার কথা এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।
ছলনা যে কখনো কখনো সততাকে লজ্জা দিতে পারে, গল্পটিতে তারই পরিচয় পাওয়া যায়। তবে লেখকের সহানুভূতি ও সমবেদনার স্পর্শে গল্পটি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। গল্পে ভাইয়ের প্রতি এক বোনের ভালোবাসা উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। বলতে গেলে, ‘ফুলের মূল্য’ গল্পটি হৃদয় ধর্মের অনুরূপ আলেখ্য। বিদেশে মৃত ভাইয়ের কবরে ফুল দেওয়ার জন্য ম্যাগি তার কষ্টার্জিত একটি শিলিং গল্পবক্তার হাতে তুলে দিয়েছে। বক্তা অনায়াসে শিলিংটি ফেরৎ দিতে পারতেন।
কিন্তু তিনি ভাবলেন: ‘এই যে ত্যাগের সুখটুকু, ইহা হইতে বালিকাকে বঞ্চিত করি কেন? এই যে শ্রমলব্ধ শিলিংটি, ইহার দ্বারা বালিকা যেটুকু সুখ স্বচ্ছন্দতা ক্রয় করিতে পারিত, প্রেমের নামে সে তাহাই ত্যাগ করিতে উদ্যত হইয়াছে। সে ত্যাগের সুখটুকু মহামূল্য, সে সুখটুকু লাভ করিলে উহার বিরহ তপ্ত হৃদয় কিঞ্চিৎ পরিমাণে শীতল হইবে। তাহা হইতে বালিকাকে বঞ্চিত করিয়া লাভ কি?’
বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় একটি উল্লেখযোগ্য নাম। বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় উপন্যাস রচনা করলেও ছোটগল্পেই প্রভাতকুমারের প্রতিভার সার্থক বিকাশ ও প্রকাশ। ছোটগল্পকার হিসেবে একমাত্র রবীন্দ্রনাথের পরেই তাঁর স্থান। অবশ্য শুধু জনপ্রিয় বললে তাঁর প্রতিভাকে খাটো করে দেখা হয়, তিনি শক্তিমান লেখক।
গল্পের আঙ্গিকের দিক থেকে এবং নির্ভার ও নিটোল গল্প রচয়িতা হিসেবে আজও তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কথাশিল্পী হিসেবে ছিলেন অন্যদের চেয়ে আলাদা, আপন স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। ফলে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে প্রভাতকুমারের ছোটগল্পে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও প্রভাতকুমারের ছোটগল্পের গুণগ্রাহী ছিলেন।
তাঁর গল্পের প্রধান গুণই প্রবহমানতা। তাছাড়া আছে প্রীতিপূর্ণ স্নিগ্ধরস। তিনি যখন তাঁর সেই বিখ্যাত ‘ফুলের মূল্য’ গল্পটি লেখেন, ওই সময় ভারতবর্ষে ফুল কেনাবেচা হতো না। এমনিই এখানে-সেখানে প্রচুর ফুল পাওয়া যেত। ওই সময় মানুষ এই ফুল দিয়েই ভালোবাসা জানাতো। এখন ভালোবাসার ফুলে আর্থিক মর্যাদা যোগ হয়েছে। কিন্তু ফুলের সেই সুবাস একই রয়ে গেছে। এই সুবাস আজ ছড়িয়ে পড়ুক সব মানুষের ঘরে।
ফলে এ কথা নিঃশঙ্কোচে বলা যায় যে, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘ফুলের মূল্য’ ছোটগল্পটি প্রমাণ করেছে ফুল একটি অমূল্য সম্পদ। কখনো কখনো অর্থের বিনিময়ে তাকে কেনা যায় না। এমনকি অর্থমূল্য দিয়ে ফুলকে বিবেচনা করা যায় না।