বাংলা কবিতার জগতে এক বিশিষ্ট নাম কবি হেলাল হাফিজ। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে তিনি নিজের কাব্য চেতনার মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে এক আলোকিত অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। তাঁর কবিতায় যেমন প্রেমের গভীর আবেগময়তা রয়েছে, তেমনি রয়েছে সমাজ-রাজনীতির প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিবাদের স্পষ্ট উচ্চারণ।
হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনা জেলার এক সাহিত্যপ্রবণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব কেটেছে এক নিভৃত মফস্বল পরিবেশে। ছোটবেলা থেকেই তিনি সাহিত্যের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিলেন। পরিবারের অনুপ্রেরণায় ও সেই সময়ের সাহিত্যিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে তাঁর কাব্যচর্চার প্রতি ঝোঁক বাড়ে। শৈশবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ তাঁকে কবি হওয়ার পথে পরিচালিত করে। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার পর তিনি নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর নেত্রকোনা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। যদিও তিনি একাডেমিক পড়াশোনায় অতটা মনোযোগী ছিলেন না। কিন্তু, তাঁর মন ছিল সাহিত্যের গভীরে। ছাত্রজীবনেই বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা লেখার মাধ্যমে তাঁর সাহিত্যজগতে প্রবেশ ঘটে। ১৯৭২ সালে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ তাঁকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং তরুণদের মনে জমে থাকা হতাশা ও বিক্ষোভ কবিতাটিতে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়। তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা, স্বাধীনতার চেতনা ও হতাশার কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে এই কবিতা। হেলাল হাফিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরই তা পাঠকমহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো প্রেম, বেদনা, বিদ্রোহ ও সমাজের প্রতি গভীর এক প্রশ্নচিহ্ন বহন করে। বহু প্রতীক্ষার পর ২০১৯ সালে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা ৭১’ প্রকাশিত হয়। এটি তাঁর প্রথম গ্রন্থের তুলনায় কম প্রচারিত হলেও পাঠকদের মধ্যে সমাদৃত হয়।
তাঁর কবিতাগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য হল শব্দের মধ্যে গভীর অর্থবহ ব্যঞ্জনা তৈরি করা, যা সহজে পাঠকের হৃদয়ে ছাপ ফেলে। হেলাল হাফিজের কবিতার ভাষা সরল কিন্তু গভীর। তাঁর কবিতায় প্রতিটি শব্দের ভেতর লুকিয়ে থাকে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। প্রেমের কবিতায় তিনি যেমন আবেগের গভীরতা ছুঁতে সক্ষম হয়েছেন, তেমনি তাঁর বিদ্রোহী কবিতাগুলোতে সমাজ ও রাজনীতির প্রতি তীক্ষ্ণ মন্তব্য করেছেন। তাঁর কবিতা প্রেম, ব্যথা, একাকীত্ব ও স্বাধীনতার সংগ্রামের এক অপূর্ব মিশ্রণ। কবির ব্যক্তিজীবন ছিল নানা চড়াই-উতরাইয়ে ভরা। এক সময় তিনি দীর্ঘ সময় ধরে আর কোন কবিতা লেখেননি। আর্থিক অনটন ও একাকীত্ব তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তবে, সেসব সমস্যার মধ্যেও তিনি কবিতা লেখা ছাড়েননি এবং সাহিত্যিক অবদান রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাঁর জীবনের এই দিকটি অনেকের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য হেলাল হাফিজ পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ অন্যান্য সম্মাননায় তিনি ভূষিত হয়েছেন।
তাঁর কবিতাগুলো শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্রশংসিত। হেলাল হাফিজ বাংলা সাহিত্যের এমন একজন কবি, যিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে প্রেম, প্রতিবাদ ও বেদনার এক অনন্য ধারা সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কবিতার শব্দগুলো শুধু কাগজে নয়, মানুষের হৃদয়ে জ্বলন্ত আগুন হয়ে ধরা দেয়। তাঁর কাব্যিক উচ্চারণ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সাহস জোগাবে এবং বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
দ্রোহ ও প্রেমের কবি হেলাল হাফিজ শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। যে কবি তাঁর শব্দের আগুনে আমাদের জাগিয়ে রাখতেন, যাঁর কবিতায় ছিল দ্রোহের শাণিত ছাপ এবং প্রেমের কোমলতা- তিনি চলে গেলেন এক করুণ অসহায়ত্ব নিয়ে। শাহবাগের সুপার হোস্টেলের একটি ওয়াশরুমে, দরজা ভেঙে, তাঁকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। মাথায় আঘাত, রক্তক্ষরণ- এবং এর মধ্যে কোন সহমর্মী হাত ছিল না, ছিল না কোন সাহচর্যের ছায়া। এক যুগান্তকারী কবি, যিনি তাঁর শব্দের শক্তিতে যুগের পর যুগ প্রজন্মকে আলোড়িত করেছেন, তিনি কি এভাবেই বিদায় নেওয়ার যোগ্য ছিলেন? আজকের এই ক্ষত, এই শূন্যতা, আমাদের প্রশ্ন করে- কবি বেঁচে থাকতে কেন আমরা তাঁকে জীবনের আলো দিতে পারিনি? কেন আমরা তাঁকে সঙ্গ দিতে পারিনি? এক বার ভাবুন, যদি আমরা বেঁচে থাকা মানুষগুলোর সত্তাকে যথাযথ মূল্য দিতাম, তাহলে কি এমন দিন দেখতে হতো? হায়, আমরা বাঙালি জাতি- মৃত্যুর পর আমরা ফুল দেই। কিন্তু, জীবনে ভালবাসা দিতে পারি না। এখন আমরা তাঁর স্মৃতিতে ভাসব। টকশোতে বসে তাঁর কবিতার প্রশংসায় মুখর হব। বইমেলায় তাঁর নামে আয়োজন হবে, প্রবন্ধ লেখা হবে, স্মারক সংখ্যা বের হবে। অথচ জীবনের শেষ দিনগুলোতে তাঁর সেই নিঃসঙ্গতা, সেই অসহায়ত্ব- এসব নিয়ে আমরা ভাবিনি। এই দৃশ্য আমাদের জন্য এক নির্মম শিক্ষা। আমরা কি শুধু মৃত্যুর পরই সন্মান করতে জানি? জীবনের চাহিদাগুলো আমরা উপেক্ষা করি, অথচ মৃত্যুর পর শোকের অভিনয়ে আমরা পারদর্শী। হেলাল হাফিজের মৃত্যু শুধু একজন কবির বিদায় নয়; এটি আমাদের অনুভূতির দীনতা, সমাজের অবক্ষয়ের এক নির্মম চিত্র। আমরা কি এক বারও থামব না, ভাবব না- জীবিত মানুষটিকে ভালবাসতে, সন্মান করতে কেন এত কার্পণ্য করি?