সত্য ঘটনাকে কিছু কল্পনার মিশ্রণে এক সুতায় গেঁথেছি: কবি মনিজা রহমান

সোহানা নাজনীন
  ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩:৪৫

‘আমার লেখা কাহিনিগুলো অধিকাংশই বাস্তব, আমার দেখা মানুষ এরা। স্কুলে, পার্কে, জিমে, আমি খুব মনোযোগ দিয়ে প্রতিটা মানুষ খেয়াল করি, পর্যবেক্ষণ করি, তাদের কথা শুনি। তাদের জীবনের গল্প ও কাহিনীগুলো মনে দাগ কাটার মত। অবশ্যই আমি দেশান্তরি জীবন যাপন করছি; যা আমার সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছে। কারণ, এখানে জীবন বৈচিত্রময়, প্রতিনিয়ত সংগ্রামের সাথে মুখোমুখি হচ্ছি; যার সাথে বাংলাদেশের জীবন যাপনের কোন মিল নেই। এই শহরে সব দেশের নানা ভাষার মানুষ থাকে, তাদের সাথে পরিচিত হচ্ছি, তাদের কথা লিখতে পারছি, যেটা বাংলাদেশে থাকলে সম্ভব হত না। আমার ভাষা, সাহিত্য, গদ্য, পদ্য আরো ঋদ্ধ হয়েছে প্রবাসে থাকার কারণে।’
শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনাকালে কথাগুলো বলেন লেখক, সাংবাদিক, কবি মনিজা রহমান। গত বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) আমেরিকার একটি বাংলা অনলাইনে ‘টক অফ দ্য উইক’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মনিজা রহমান।
শুরুতেই ৭১’-এর বীর যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো হয়। এরপর অনুষ্ঠানে শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে কথা হয়। অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় ছিলেন ফরিদা ইয়াসমীন। পরিচালনা ও পাশাপাশি আলোচনায় ছিলেন এইচবি রিতা।
শুরুতেই ফরিদা ইয়াসমীন লেখালেখির শুরুটা জানতে চাইলে মনিজা রহমান বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই লেখালিখির অভ্যাস। আমার মতে, লেখক হবার আগে প্রথমে পাঠক হতে হয়। ছেলেবেলা কেটেছে পুরান ঢাকায়, সেখানে লাইব্রেরিতে প্রচুর সময় কেটেছিল বই আনা-নেওয়ার মাধ্যমে। তখন থেকেই ইচ্ছা জন্মায় এক দিন লিখব। কলেজে পড়ার সময় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রের সাথে যুক্ত হই। বই নিয়ে পর্যালোচনা করতে যেয়ে, বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে আলোচনার সময় আমি টের পাই, আমার নিজের ভিতরের ভাললাগা সম্পর্কে। আমি মনে করি, যে যেটাতে আনন্দ পায়, সেটার মাধ্যমে জীবনে কোন কৃত্তিমতা থাকে না। দুঃখবোধ, বিষন্নতা কেটে যায়। আমার চিন্তা, ভাবনা, দেখা এসব লেখায় প্রকাশ করার চেষ্টা করি।’
মনিজা রহামান গল্প কবিতা দুইটাই লিখেন। গল্প ও কবিতার মধ্যে কোনটা তাকে বেশি টানে? এই প্রশ্নে তিনি জানান, নিজ প্রয়োজনে দেশান্তরি হয়ে আমেরিকায় আসার পর নিজেকে আত্মপরিচয়বিহীন মানুষ মনে হয়েছিল। আমার আরেকটা সত্তা হচ্ছে লেখকসত্তা, তাকে আঁকড়ে ধরি। বর্তমানে স্কুলে শিক্ষকতা করলেও আমার ভালবাসার জায়গাটা হচ্ছে লেখালিখি। এখানে অভিবাসীদের জীবন অনেক বৈচিত্রময়, যা নিয়ে লেখা দরকার। বিভিন্ন সময়ের নিজস্ব অনুভূতিগুলোও আমি লেখায় তুলে ধরি। যখন বিষণ্ণতায় থাকি, যন্ত্রণায় থাকি, স্মৃতি কাতরতায় থাকি তখন কবিতা লিখি। কবিতা আমাকে নির্ভর বোধ এনে দেয়। এছাড়া, জীবনের নানা জটিলতা যেমন মা-বাবা পরিজন ছেড়ে এ দেশে এসে এখানের সাথে মানিয়ে নেয়া, ভিন্ন সংস্কৃতিতে খাপ খাইয়ে নেবার সংগ্রামকেই আমি লেখায় তুলে ধরি।
কবিতা ও গল্প দুইটা ভিন্ন মাধ্যম বলে মনে করেন এইচবি রিতা, যেখানে সংক্ষেপে একটি আবেগ, উপলব্ধি বা ঘটনা ফুটিয়ে তুলতে কবিতা শক্তিশালী, আর গল্প বিস্তারিতভাবে একটি বিষয়কে তুলে ধরে। এই দুই মাধ্যমে লেখার সময় ভারসাম্য বজায় রাখা নিয়ে জানতে চান এইচ বি রিতা। মনিজা রহামান বলেন, ‘অনেকেই বলেন, আমার কবিতা অনেকটা গল্পের মত লাগে, আবার গল্পকে মনে হয় যেন কবিতা। হয়তো দুইটার মিশ্রণ হয় বলেই এমন হয়। বাংলাদেশে অনেক দিন ধরে কণ্ঠশীলন নামে একটা সংগঠনের সাথে ছিলাম, সেখানে কবিতা আবৃত্তি করতাম। আবৃত্তি করার সময় বেছে নেয়া কবিতার মতই আমি লিখতে চেষ্টা করতাম। আমার কবিতা পড়ে অনেকেই প্রভাবিত হয়, নিজের জীবনের সাথে মিল খুঁজে পায়। সহজভাবে কোন ধারণা তুলে ধরতে পারি, এটাই আমার সার্থকতা, যা সাধারণ পাঠক পড়ে নিজেকে মেলাতে পারে। লেখালিখিটা আসলে অনেক ধ্যান কিংবা মেডিটেশনের মত, অনেক গভীরে নিজের অবচেতন মনের সাথে যুক্ততা স্থাপন করে তারপর লেখার ভাষা আসে। একজন কবি অথবা লেখক তো ঈশ্বরের কণ্ঠ, নিজের মধ্যে ডুব না দিলে লেখা আসে না।’
মনিজা রহমানের জানান, তার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাস এবং প্রিয় কথা সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
কথা সাহিত‍্যিক আসলে কাকে বলা হয়, ফরিদা ইয়াসমীনের এমন প্রশ্নে মনিজা রহমান বলেন, ‘গল্প ও উপন্যাস, দুই দিকেই যারা পারদর্শী তাদেরকেই আমি কথা সাহিত্যিক বলি। ফিচার, আর্টিকেল, প্রবন্ধ, রিপোর্ট- এসবের সাথে সাহিত্যের একটা পার্থক্য আছে। তবে, গল্পের বেলায় আমি খুব পর্যবেক্ষণ করি, কথা বলি মানুষের সাথে, তাদের কাহিনি বা গল্প শুনি। সব ঘটনা তো নাটকীয় হয় না, শেষটা আমি কল্পনা করে নিই। যেমন আমার স্পামডোনার গল্পটা আমি পেয়েছিলাম পরিচিক একজনের থেকে। ঘটনার সাথে স্পামডোনারের কি হল, জানা ছিল না। সেটা আমি কল্পনায় বসিয়ে নিয়েছি। নিজেকে কথা সাহিত্যিক হিসাবে দাবী করি না, কিন্তু কথা সাহিত্যটা আমার প্রধান ভাল লাগার জায়গা এবং আমি এটাই হতে চাই।’
কথা সাহিত‍্যিকদের লেখার স্টাইল সম্পর্কে এইচবি রিতা যুক্ত করেন, ‘কথা সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে জীবনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা ও তা থেকে লব্ধ অনুভবগুলোকে গল্পের ভেতর দিয়ে তুলে আনা। তাদের একটা আলাদা লেখার স্টাইল আছে, বর্ণনার বেলায় কোথাও কোথাও অভিনবত্ব চোখে পড়ে। যেমন শরৎচন্দ্র, তার সময় সমাজের জটিল আবর্ত, নারীর মনস্তত্ত্ব- এসব থাকা সত্ত্বেও গল্পটা কিন্তু তিনি খুব সহজ করেই বলতেন। কোথাও তিনি লিখেছেন, ‘মনে-মনে বলিল কিন্তু মুখে কহিল’-এ স্টাইল সম্পূর্ণ তার নিজের। প্রতিটা কথা সাহিত‍্যিকেরই নিজস্ব স্টাইল থাকে।’
এ প্রেক্ষিতে মনিজা রহমান সহমত হয়ে যুক্ত করেন, ‘হ‍্যাঁ! সবার লেখায় নিজস্ব একটা স্টাইল থাকে, সাহিত‍্য চর্চার মাধ‍্যমেই ধীরে ধীরে এটা তৈরি হয়।’
মনিজা রহমানের প্রকাশিত মোট বইয়ের সংখ্যা ১৫টি। এর মধ্যে গল্পগ্রন্থ বেশি। শুরুর দিকে বিভিন্ন প্রত্রিকায় লেখা মনিজা রহমানের কিছু ফিচার দিয়ে বই প্রকাশ হলেও সেগুলোকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ লেখা বলে মনে করেন না। কবিতা আর গল্প দিয়েই সামনের দিনগুলোতে লেখার কথা ভাবেন মনিজা। আগামী বছর একটা কবিতার বই বের করার ইচ্ছা আছে বলে জাননন।
কবিতায় দুর্বোধ‍্য শব্দের ব‍্যবহারে লেখক পাঠকের মধ‍্যে দ্বন্ধ ও লেখার ক্ষেত্রে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? পাঠকের মন জয় করা নাকি নিজের ভেতরের সত্তাকে প্রকাশ করা- এ নিয়ে জানতে চান এইচবি রিতা। মনিজা রহমান বলেন, ‘কবিতায় নিজের সত্তাকে প্রকাশ করার যে আনন্দ, পাঠক সেটা পড়ে যখন আরো আনন্দ পায় তখন নিজের ভাললাগা দিগুণ হয়। আমি চাই না কেউ আমার কবিতা পড়ে শব্দের মানে বোঝার জন্যে অভিধান নিয়ে বসুক। সময়কে ধারণ করে শব্দ বাক‍্যের প্রয়োগ যথাযথ হতে হবে। আমার কতটুকু কঠিন শব্দ জানি সেটা প্রকাশের জন্যে আমার লেখালিখি না। ভাললাগা ও ভালবাসা থেকেই লিখি আমি।’
বর্তমানে অসংখ‍্য সাহিত‍্য পাতা চেখে পড়ে; যা নিঃসন্দেহে সাহিত‍্য বিকাশের একটি পথ। তবে, কিছু পত্রিকার সাহিত‍্য পাতাগুলির লেখা মানসম্পন্ন হলেও কিছু সাহিত‍্য পাতা পাঠকের নজর কাড়ে না। একটা সময় ছিল যখন লেখকরা তাদের একটা লেখা কোন পত্রিকার সম্পাদকের কাছে মেইল করে মাসের পর মাস তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করতেন কখন, ছাপা হবে। এখন আমরা কখনো কখনো রাতে লিখে পর দিনই সেটা পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই। এই দ্রুত প্রকাশ ও প্রচারের বিষয় কি সাহিত‍্য চর্চাকে ব‍্যাঘাত ঘটচ্ছে কিনা, এইচবি রিতার এমন প্রশ্নে মনিজা রহমান বলেন, ‘লেখালিখি করার আগে একটা প্রস্তুতি দরকার। কেউ হটাৎ করে লেখালিখি শুরু করবে এটা ঠিক না। আগের দিনের মত বহু প্রতিক্ষার পর পাওয়া সেই আনন্দ আর নেই। এখানে নিউইয়র্কে অনেক পত্রিকা, সব পত্রিকাতেই লেখা যাচ্ছে, যা এখন কোন বড় ব্যাপার না। তাই, সাধারণ মানুষ বুঝে উঠতে পারে না যে কারা আসল লেখক বা কবি, আর কে চর্চা ছাড়াই হটাৎ গজিয়ে ওঠা লেখক। অনেকেই অন্যের কবিতা না পড়েই অভিনন্দন জানাচ্ছেন, ভাল-মন্দ সমালোচনা করছেন না। আসলে প্রকৃত লেখক কে, তা সবাই  নিজেও জানে হয়তো মুখে বলছে না। এই যে আজকের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানটিতে আপনারা আমাকে ডেকে এনেছেন, নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পেরেছেন যে, মনিজা রহমান প্রকৃতপক্ষে লেখালেখির চর্চায় জড়িত বা চেষ্টা করে যাচ্ছেন।’
প্রবাসে চাকরি করে, ঘর সংসার, বাজার, ডাক্তার, সন্তান সামলিয়ে এই সাহিত‍্য চর্চার জন‍্য নির্দিষ্ট সময় বের করা-সহজ কাজ নয় বলে মনে করেন ফরিদা ইয়াসমীন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়টি হল, বাংলাদেশে প্রবাসের লেখকরা দ্বিতীয়‌ সারিতেই থেকে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মনিজা রহমান বলেন, ‘নিজের আয়নায় আমি একজন লেখক। তারপরেও আমি একজন মা, একজন স্ত্রী, কারো কন্যা ছিলাম। তবুও, নিজের আয়নায় আমি একজন লেখক হতে চাওয়া মনিজা রহমান। আমি নিজেকে কখনো প্রাবাসী লেখক ভাবি না। তবে, ডায়াস্পোরা ব্যাপারটা থেকেই যায়। একটা সমাজ থেকে আরেকটা ভিন্ন সমাজে আসার পর কিছু পরিবর্তন আমাদের মধ্যে ঘটবেই। এ দেশকে নিজের দেশ মনে করেই এগিয়ে যাচ্ছি।’
সাহিত্যে এত ভাল লাগা নিয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিষয়ে কেন গেলেন? ফরিদা ইয়াসমীনের এ প্রশ্নে মনিজা রহমান জানান, আমাদের দেশে নিজের ইচ্ছামত কোন কাজ করা সম্ভব না। আমার আব্বা চাইতেন বিসিএস পরিক্ষা দিয়ে বড় কোন অফিসার হব। বাবার স্বপ্ন অনুয়ায়ী আমি অর্থনীতি নিয়ে পড়া শুরু করলেও এক সময় বুঝতে পারি, এটা আমার জায়গা না। তখন পত্রিকায় লেখা শুরু করি, বাংলাদেশে ক্রীড়া সাংবাদিকতায় আমিই প্রথম পেশাদার নারী ক্রীড়া সাংবাদিক। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ প্রথম বারের মত বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছিল, তখন আমি ইত্তেফাক পত্রিকার ক্রীড়ালোক পাতায় পাঠকের পাতায় নিয়মিত চিঠি লিখতাম। মেয়েদের ক্রিকেট খেলা তখন বাংলাদেশে কেবলমাত্র শুরু, ধানমন্ডি ক্রীড়া কমপ্লেক্সে তারা অনুশীলন করত, ওখানে যেয়ে ওদের ব্যাপারে একটা প্রতিবেদন করেছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম যে, আমি ব্যাংকার, অফিসার হতে চাই না, আমি লেখক হতে চাই। স্পোর্টস রিপোর্টে কিছু সাহিত্য চর্চার সুযোগ ছিল, তাই আমি এটাকে বেছে নিয়েছিলাম। অর্থনীতির মত বিষয়ে পড়ালেখা করেও নারী হিসাবে ক্রীড়া সাংবাদিকতার মত একটা অপেশাদার কাজে আসলাম।
সব শেষে নিজের লেখা ‘আমি যাবো না’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান মনিজা রহমান। এভাবেই শেষ হয় সেদিনের শিল্প সাহিত‍্য পর্বটি।