জিয়াউর রহমানের লেখা সম্পর্কে মানুষের জানাশোনা হয়তো সীমিত। তাঁর প্রকাশিত প্রথম প্রবন্ধ ‘একটি জাতির জন্ম’ যা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক বাংলার বিশেষ সংখ্যায়, ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ। স্বাধীনতা ও জাতির আত্মপরিচয়ের ঐতিহাসিক মুহূর্তের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে প্রবন্ধটি। যা আজও রয়ে গেছে বিস্ময়ের আড়ালে।
‘একটি জাতির জন্ম’ শুধু একটি রচনা নয়, এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক ও সামাজিক বোধোদয়ের এক অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ প্রতিফলন। যা আমাদের জাতিগত ইতিহাস ও ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য। দীর্ঘদিন যেটি থেকে গিয়েছিল আলোচনার অন্তরালে এবং জিয়াউর রহমান শুধু একজন রাষ্ট্রনায়ক নন বরং জাতির নবজাগরণের দিকনির্দেশকও।
জাতির জন্ম ও মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ইতিহাসের একটি বৈপ্লবিক অধ্যায়। যা বহু বছরের শোষণ, বঞ্চনা ও অবিচারের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম। স্বাধীনতা একবারে অর্জিত হয়নি বরং এটি ছিল দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও সংকল্পের ফলাফল। প্রবন্ধে জিয়াউর রহমান সেটাই উল্লেখ করেন, ‘স্বাধীনতা একটি জাতির আত্মার পুনর্জাগরণ।’ অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার লড়াই নয়, এটি সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও নৈতিক মুক্তির যাত্রা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম ছিল নিঃসন্দেহে বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র উদাহরণ। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণমূলক নীতির বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণ এক হয়ে দাঁড়ায়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়।
এই সংগ্রাম ছিল আত্মপরিচয় রক্ষার লড়াই; যেখানে ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সহনশীলতা জাতির ভিত্তি। মুক্তিযুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে একটি স্বাধীন দেশের ভিত্তি স্থাপন হয়। যা শুধু ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয় বরং একটি জাতির মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার যজ্ঞ।
তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি নতুন জাতীয়তার ধারণা প্রতিষ্ঠা করে। পূর্ববঙ্গের জনগণ নিজেদের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে শুরু করে, যা পূর্বের ‘পাকিস্তানি’ জাতিগত ধারণার বিপরীত। এই জাতীয়তাবাদ কেবল ঐতিহাসিক বোধ নয় বরং জনগণের মধ্যে সামগ্রিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন গড়ে তোলে। শুধু মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক বিজয় নয়, এটির গভীর প্রভাব দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চেতনায় অটুট থেকে যায়। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও নায়কেরা আজও দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রাষ্ট্রনায়কত্বের অর্থ ও গুরুত্ব
প্রবন্ধে জিয়া রাষ্ট্রনায়কত্বকে কেবল রাজনৈতিক পদাধিকারী হিসেবে নয় বরং একজন আদর্শিক নেতা ও জাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। রাষ্ট্রনায়ক হলেন সেই ব্যক্তি; যিনি দেশের গঠন ও উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও দর্শন জাতির ইতিহাসে গৌরব ও প্রেরণার উৎস।
একজন রাষ্ট্রনায়কের নেতৃত্ব শুধু প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ নয় বরং জাতির হৃদয়ে প্রেরণা জাগানো, নৈতিক আদর্শ স্থাপন এবং দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা করা। প্রবন্ধে উল্লেখিত রাষ্ট্রনায়কের চরিত্র ও দর্শন, যেমন দূরদর্শী চিন্তাবিদ হিসেবে তাঁর কর্মময় জীবন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত।
এ ছাড়া রাষ্ট্রনায়কত্বের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো জনমত ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা। একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক তার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারেন এবং তা পূরণের জন্য দায়বদ্ধ থাকেন। প্রবন্ধে রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্বকে জাতির জন্য ‘দিকনির্দেশক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যা রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতায় দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। এ অংশ থেকে বোঝা যায়, রাষ্ট্রনায়কত্বের প্রকৃত অর্থ হলো নেতৃত্বের এমন নীতি ও কর্মপদ্ধতি, যা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য পথপ্রদর্শক।
জাতীয় ঐক্যের অপরিহার্যতা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগত বিভাজন দেশের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, ‘জাতীয় ঐক্য ছাড়া দেশের স্থায়ী উন্নয়ন অসম্ভব।’
একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক বিশ্বাস, সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও অবিশ্বাস বিদেশি হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক দাঙ্গা, ও দলীয় রাজনীতির কূপমণ্ডূকতা জাতীয় ঐক্যের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় ঐক্য কেবল রাজনৈতিক সীমানায় সীমাবদ্ধ নয় বরং তা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বন্ধনকেও শক্তিশালী করে। বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা ও সামাজিক গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সমন্বিত জাতীয় পরিচয় গঠন করা দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য অপরিহার্য।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্মিলিত কাজ না হলে দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়। প্রবন্ধের এ অংশ থেকে বোঝা যায় যে, জাতীয় ঐক্য দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও উন্নয়নের ভিত্তি, যা সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
সামরিক অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক ভারসাম্য
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা অনেক সময় বিতর্কিত। স্বাধীনতার পর সামরিক হস্তক্ষেপ ও বিভিন্ন অভ্যুত্থান দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। প্রবন্ধে জিয়াউর রহমান বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন, ‘সামরিক বাহিনী রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও রাজনৈতিক ভারসাম্য অপরিহার্য।’ সামরিক অভিজ্ঞতা দেশের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় অপরিহার্য হলেও রাজনীতির সঙ্গে সামরিক শক্তির সমন্বয় প্রয়োজন। সামরিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্যের অভাবে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।
সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকলেও জনমতের সম্মান ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সামরিক বাহিনী সরাসরি হস্তক্ষেপ করলে তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। প্রবন্ধে এই ভারসাম্যের অভাব দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সুতরাং সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সুসমন্বয় ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য নয়, দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য।
তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব ও দায়িত্ব
তরুণ প্রজন্ম হলো দেশের ভবিষ্যৎ, যাদের নেতৃত্ব ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া জাতির উন্নয়ন অসম্পূর্ণ। প্রবন্ধে জিয়াউর রহমান তরুণদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পৃক্ততার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। ‘তরুণদের জন্য উচ্চ আদর্শ, সততা ও দায়িত্ববোধ অপরিহার্য। তরুণ প্রজন্ম যদি দুর্নীতি ও স্বার্থপরতা থেকে দূরে থাকে, তবে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়নে তা সহায়ক হবে।’ প্রবন্ধের এ অংশ থেকে বোঝা যায়, বর্তমান সময়ে তরুণদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা। তরুণরা নতুন ভাবনা, উদ্যম ও জ্ঞান নিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। তরুণ নেতৃত্ব বিকাশ দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাদের মধ্যে নৈতিকতা, সততা ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা দেশের রাজনীতিতে নতুন দিকনির্দেশনা যোগ করবে। এই প্রক্রিয়ায় তরুণরা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও নতুন চিন্তাধারা দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। সম্প্রতি ৫ আগস্টের পর এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে। অদূর ভবিষ্যতে এ স্বপ্ন পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত হবে বলে আশা রাখা যায়।
‘একটি জাতির জন্ম’ প্রবন্ধে জিয়াউর রহমান কেবল একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মকথা বলেননি বরং একটি জাতির আত্মিক জাগরণ, সাংস্কৃতিক পুনরুদ্ধার ও ভবিষ্যৎ নির্মাণের দর্শনও তুলে ধরেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ কেবল অতীত নয়, এটি একটি চলমান চেতনা। যা জাতীয় ঐক্য, রাষ্ট্রনায়কত্ব, রাজনৈতিক ভারসাম্য ও তরুণ নেতৃত্বের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নবায়িত হতে থাকবে।
এ প্রবন্ধে তিনি ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, একটি জাতির সাফল্য কেবল তার স্বাধীনতায় নয় বরং সেই স্বাধীনতার আদর্শকে ধরে রেখে, তা প্রজন্মান্তরে চর্চা করার মধ্যেই নিহিত। অতএব ‘একটি জাতির জন্ম’ প্রবন্ধটি কেবল ঐতিহাসিক দলিল নয়। এটি একটি জাতির বিবেক ও দিকনির্দেশনার সংহতি; যার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের পরিচয়, সম্ভাবনা ও পথচলার চেতনায় আলোকিত হতে পারে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক।