কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় আধুনিকতার প্রভাব

সাহিত্য ডেস্ক
  ১৭ আগস্ট ২০২৫, ২৩:৫৫

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলাম এক মহীরুহ। যিনি শুধু কবি ছিলেন না, ছিলেন এক বিদ্রোহী মনন, এক নবজাগরণের দূত। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা কবিতা যখন এক অনির্দিষ্ট রূপরেখা ও পরিমিত আঙ্গিকের গণ্ডিতে আবদ্ধ; তখন নজরুল তাঁর কবিতায় ভেঙে ফেলেন সেই প্রচলিত কাঠামো। সাহসী ভাষা, নতুন চিন্তাধারা, ধর্ম ও সমাজ নিয়ে অভাবিত দৃষ্টিভঙ্গি, নারীর মর্যাদা ও মানবিকতার গদ্য—সব মিলিয়ে নজরুল হয়ে ওঠেন বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার এক অগ্রদূত। নজরুলের কবিতার আধুনিকতা কেবল কাব্যরীতির দিক থেকে নয় বরং রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও নতুন ধারণার জন্ম দেয়। তাই এ প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করবো নজরুলের কবিতায় আধুনিকতার প্রকাশ, তার রূপান্তর ও বাংলা সাহিত্যে এবং সমাজে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব।

আধুনিকতার তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট
আধুনিকতা শুধু একটি সাহিত্যিক বা নন্দনতাত্ত্বিক পরিভাষা নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ইউরোপে উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে শুরু হওয়া এই আন্দোলনের প্রভাব পড়ে শিল্পকলা, সাহিত্য, সংগীত, স্থাপত্যসহ মানব সভ্যতার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। আধুনিকতা বলতে বোঝানো হয়, প্রচলিত ও প্রথাগত ধারণার অবসান ঘটিয়ে যুক্তিবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাস্তবতা ও আত্ম-অনুসন্ধানের পথকে অনুসরণ করা।

আধুনিকতার মূল বৈশিষ্ট্য
>> ধর্মীয় ও সামন্তবাদী কাঠামোর বিরোধিতা
>> শিল্প ও সাহিত্যে যুক্তি ও বাস্তবতার প্রতিফলন
>> ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও মানবিক অভিজ্ঞতার প্রতি গুরুত্ব
>> ছন্দ ও আঙ্গিকে স্বাধীনতা
>> রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা
>> অনিশ্চয়তা, সংকট ও দ্রোহের চেতনা।

বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূচনা
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা এসেছে উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে। প্রথমে প্রবন্ধ ও গদ্যের মাধ্যমে, পরে কাব্যে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখ সাহিত্যিকরা আধুনিকতার বীজ রোপণ করেন। তবে কাব্যভাষার ক্ষেত্রে নজরুল ইসলামের আগমনের পর আধুনিকতা প্রকৃত অর্থে এক বিপ্লবে রূপ নেয়। ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘আধুনিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। এ আকাঙ্ক্ষা নজরুলের কবিতায় এক প্রতিবাদী ঝংকারে ফুটে ওঠে।’ (বাংলা সাহিত্য ও আধুনিকতা, আনিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমি, ২০০০)

বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত ও ধারা
কবিতায় আধুনিকতার আগমন
বাংলা কবিতার প্রারম্ভিক যুগ ছিল ধর্মীয় আখ্যান ও রূপকথা নির্ভর। পরবর্তীতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কবিতায় অ্যাংলো-স্যাক্সন ধারার প্রবেশ ঘটান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাব্যভাষায় আধ্যাত্মিকতা, প্রকৃতি ও প্রেমের চেতনায় আধুনিকতার সূচনা ঘটান। কিন্তু সমাজের নিচুতলার মানুষ, ধর্মীয় জটিলতা, নারীর স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক চেতনা যেভাবে নজরুলের কবিতায় এসেছে—তা বাংলা সাহিত্যে পূর্ববিপ্লবী।

নজরুল আগমনের সময়কাল ও প্রেক্ষাপট
নজরুল যখন কাব্যচর্চা শুরু করেন; তখন ভারত উপনিবেশবাদে জর্জরিত। একদিকে ব্রিটিশ শাসনের দমননীতি, অন্যদিকে সমাজের গোঁড়ামি ও কূপমণ্ডুকতা। এ প্রেক্ষাপটে নজরুলের কবিতা হয়ে ওঠে মুক্তির বার্তা।
‘আমি চির-বিদ্রোহী বীর-
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি চির-উন্নত শির!’
এ ঘোষণায় শুধু আত্মবিশ্বাস নয়, এক ঐতিহাসিক চেতনার সূত্রপাত ঘটে।

পূর্বসুরি ও সমকালীনদের মধ্যে অবস্থান
রবীন্দ্রনাথ যেখানে আবেগে আচ্ছন্ন কাব্যভাষার নির্মাতা; সেখানে নজরুল বাস্তবতা ও প্রতিবাদের কবি। জীবনানন্দ দাশ আধুনিকতার এক নির্জন পাঠক আর নজরুল হলেন জনতার কবি; যিনি চিৎকার করে জাগিয়ে তোলেন জনগণকে। ড. রফিকুল ইসলাম মন্তব্য করেন—‘নজরুলের কাব্য যেন আধুনিকতার এক বিস্ফোরণ, যেখানে ছন্দের বাঁধন ভেঙে সে বেরিয়ে আসে দ্রোহের সুরে।’ (নজরুল: জীবন ও সাহিত্য, রফিকুল ইসলাম, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৪)

নজরুলের আধুনিক কাব্যভাষার সূচনা
‘বিদ্রোহী’, ‘সাম্যবাদী’, ‘মানুষ’, ‘নারী’, ‘চাকরি’, ‘আনন্দময়ীর আগমনে’—এমন বহু কবিতার মধ্যে নজরুল তাঁর কাব্যচর্চায় নতুন ভাষা ও গতি এনেছেন। আরবি-ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ, ধ্বনি-নির্ভর কাব্যরীতি, আঞ্চলিক উচ্চারণের সাহসী ব্যবহার, ছন্দের পরীক্ষাধর্মী প্রয়োগ ঘটেছে। যেমন ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়—
‘বল বীর-
বল উন্নত মম শির!’
এ ধ্বনি ও ঘোষণার মাঝে রয়েছে আধুনিকতার গর্জন।

আধুনিক বাংলা কবিতার ধারায় প্রভাব
নজরুলের কাব্যধারা শুধু তাঁর সময় নয়, পরবর্তী কবি-লেখকদের মধ্যেও এক অসাধারণ দিকনির্দেশনা তৈরি করে। তাঁর বিদ্রোহ ও মানবতাবাদ নতুন প্রজন্মকে মুক্তচিন্তা, সাহিত্য-স্বাধীনতা ও সমাজ পরিবর্তনের সাহস দেয়। সূর্যসেন গুপ্ত বলেন, ‘নজরুল বাংলা কবিতাকে এক কথায় বিপ্লবী করে তুলেছেন। ছন্দে, ভাষায়, ভাবনায় তিনি আধুনিকতার পথিকৃৎ।’ (আধুনিক বাংলা কবিতা, সূর্যসেন গুপ্ত, দেব সাহিত্য কুটির, ২০০৫)

নজরুলের কবিতায় আধুনিকতার অনুষঙ্গ
বিষয়বস্তু ও দর্শন
নজরুলের কবিতা বিষয়বস্তুর দিক থেকে মৌলিক ও সময়-চেতনায় দৃপ্ত। প্রেম, বিদ্রোহ, মানবতা, সাম্যবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, নারীর অধিকার, আত্মদর্শন—সবই তাঁর কবিতার মূল উপাদান। প্রতিটি কবিতা যেন একটি সমাজবিপ্লবের ইশতেহার। ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় নজরুল ঘোষণা করেন—
‘আমি চির-সাম্যবাদী—
আমি নেই কোন জাতিতে, নেই কোন বর্ণে,
নেই কোন ধর্মে।’
এ উচ্চারণ আধুনিক যুগের ‘মানবিক গ্লোবালিজম’-এর নিদর্শন। তিনি শুধু কল্পনার কবি নন, দৃষ্টিশক্তির কবি। এই দৃষ্টিশক্তিই তাকে আধুনিকতার চূড়ায় নিয়ে যায়।

ভাষা ও শব্দচয়নে নতুনত্ব
নজরুলের ভাষা চমকপ্রদ ও বিপ্লবী। বাংলা কবিতার মূলধারার বাইরে গিয়ে তিনি আরবি-ফারসি, হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত শব্দ মিশিয়ে এক নতুন ভাষারীতির সৃষ্টি করেন। তাঁর শব্দচয়ন একটি সচেতন রীতিবিপ্লব। উদাহরণস্বরূপ:
‘নিখিল আরব হিন্দুস্থানে মোরা গাই এক গান
এক মঞ্চে গেয়ে উঠুক হিন্দু-মুসলমান’
(এক জাতি, সঞ্চিতা)
এই সংমিশ্রিত ভাষা তাঁর কবিতায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আধুনিক রূপ তুলে ধরে।

ছন্দ ও গঠনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
নজরুল ছন্দ নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন। মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, গদ্যছন্দ, এমনকি মিশ্র ছন্দেও তিনি কবিতা লিখেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় আমরা ছন্দের বাঁধন ছাড়াও ধ্বনিময়তা ও ছন্দের নতুন প্রবাহ দেখি।
‘আমি সেই দিন হব শান্ত, যেদিন উঠিবে লোকে
অন্ধকারের পৃথিবীতে আলোর দীপ্তি ফুঁকে।’
এই রূপান্তর সাহিত্যে তাঁর আধুনিক ভাবনার প্রতিফলন।

অলংকার ও রূপকল্প
নজরুল প্রতীকের ব্যবহারেও ছিলেন অভিনব। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত প্রতীক যেমন- শিখা, বজ্র, ধ্বজা, তূর্য, ভৈরব, কাল, কামাল পাশা—সময় ও সমাজের বাস্তব সংকেতের মতো কাজ করে। তিনি শুধু চিত্রকল্পের কবি নন—তিনি প্রতীকময় যুক্তির কবি।

নজরুলের কাব্যে সামাজিক সচেতনতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা
নজরুলের কবিতা শুধু আবেগময় নয়; তা যুক্তি, সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অনুরাগী। সমাজের যে অংশটি চিরকাল চুপ থেকেছে, নির্যাতিত হয়েছে—তাদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন নজরুল। ‘মানুষ’ কবিতায় তিনি বলেন—
‘গাহি আমি সেই হৃদয়ের গান
যেখানে মেলে না ভেদাভেদে পরান।’
এই মানসিকতা তাঁকে করে তোলে আধুনিক মানবতাবাদের প্রতিনিধি।

ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি
নজরুল নিজে মুসলিম হয়েও হিন্দু পুরাণ, সংস্কৃতি, দেবতা, ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন অবলীলায়। আবার ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায় তিনি হিন্দুদের ঈশ্বরীর আগমন উপলক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক ভাষ্য গড়েছেন। একইসঙ্গে ‘খাতুন’ বা ‘মাদার’ কবিতায় মুসলিম আধ্যাত্মিকতাও তিনি তুলে ধরেছেন। ড. আবুল আহসান চৌধুরী লেখেন—‘নজরুলের ধর্মচিন্তা কোনো গোঁড়ামির ধার ধারে না, তাঁর কবিতা বহুধর্মীয় সেতু নির্মাণের প্রয়াস।’ (নজরুল: জীবন, সাহিত্য ও দর্শন, আবুল আহসান চৌধুরী, বাংলা একাডেমি, ২০০৭)

নারী, প্রেম ও মানবতা বিষয়ক আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলা সাহিত্য দীর্ঘদিন ধরেই পুরুষকেন্দ্রিক ও পুরুষের চোখে রচিত। সেখানে নজরুল নারীর কণ্ঠস্বর, স্বাধীনতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটি বাংলা কাব্যে এক বিপ্লব। ‘নারী’ কবিতায় তিনি লেখেন—
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
এই বক্তব্য একসময়ে সাড়া ফেলেছিল। কারণ এটি ছিল সাহসিকতা ও আধুনিক মানবিক চেতনার প্রতিফলন।

প্রেমের ক্ষেত্রে আধুনিকতা
নজরুলের প্রেমের কবিতায় কাব্যিকতা থাকলেও সেখানে রয়েছে দেহ-মন, আত্মা-ইন্দ্রিয়ের গভীর সংযোগ। তিনি নারীর শরীরকে কেবল কামনার নয়, শক্তির ও সৌন্দর্যের আধার হিসেবে দেখেছেন। ‘কুল নারী’ ও ‘চন্দ্রবদনী’ প্রভৃতি কবিতায় এই দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট।

মানবতা ও বিশ্বচেতনা
নজরুল যুদ্ধ, ক্ষুধা, গরিব, উপনিবেশ, সাম্রাজ্যবাদ—সবকিছুর বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। তাঁর কবিতায় মানবতা কোনো একক জাতি বা ধর্মের নয় বরং একটি সর্বজনীন চেতনা।
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে মিশে গেছে সকল বর্ণ, সকল মানুষ।’
এটি আধুনিক কবিতার অন্যতম চেতনাবোধ।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল—আধুনিকতার তুলনামূলক পাঠ
বাংলা কবিতার দুই মহীরুহ—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। দুজনেই আধুনিকতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তবে তাদের পথ ও পন্থা ছিল ভিন্ন।
উপাদান: রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল
বিষয়: প্রেম, প্রকৃতি, আধ্যাত্মিকতা, বিদ্রোহ, সাম্য, মানবতা
ছন্দ: মূলত ব্রাহ্ম ধারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিপ্লব
ভাষা: পরিশীলিত, আভিজাত্যপূর্ণ প্রাণবন্ত, সংগ্রামী, লোকভাষা
দর্শন: নৈতিক, আদর্শবাদী বাস্তববাদী, জাগ্রত।

পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ
রবীন্দ্রনাথ নিজেই নজরুলকে উৎসাহিত করেছিলেন। নজরুলও তাঁর ‘রবিহারা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন।
‘শক্তির দেবতা তুমি, ধ্যানেরও গুরু তুমি,
তুমি পথের প্রদীপ, তুমি প্রভাতের সুর।’

আধুনিকতার দুটি রূপ
রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা ছিল সুসংহত সৌন্দর্যের সাধনায় আর নজরুলের আধুনিকতা ছিল ছিন্নমূলের আর্তনাদে। এই দুটি রূপ মিলে বাংলা আধুনিক কবিতাকে করেছে সম্পূর্ণ।

নজরুল-পরবর্তী কবিদের ওপর প্রভাব
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা পরবর্তী প্রজন্মের কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে আধুনিকতার বীজ বপন করেছে। বিশেষত ৫০ থেকে ৭০-এর দশকে যেসব কবি বাংলা কবিতায় মানবতাবাদ, বিপ্লব, প্রেম, নারী-চেতনা ও গণমুখিতা নিয়ে কাজ করেছেন—তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নজরুলের প্রভাবের ধারক।

শামসুর রাহমান
নজরুলের বিপ্লবী চেতনা ও সাম্যবাদী ভাবধারা শামসুর রাহমানের কবিতায় এক প্রগতিশীল রূপ লাভ করে। ‘স্বাধীনতা তুমি’ বা ‘বন্দী শিবির থেকে’ কবিতাগুলোর ভাষা ও ভঙ্গিতে নজরুলীয় ধ্বনি রয়েছে। শামসুর রাহমান বলেছেন, ‘আমার কবিতা চিরকাল চেয়েছে মানুষের মুক্তি’।

আল মাহমুদ
আল মাহমুদের কবিতায় লোকজ শব্দ ও ছন্দের ব্যবহার, ইতিহাস ও ধর্মীয় চেতনার সম্মিলন নজরুলের কবিতার প্রভাবেই পরিণত হয়েছে।

নির্মলেন্দু গুণ ও রফিক আজাদ
তাঁদের কবিতায় ‘নাগরিক বিদ্রোহ’, ‘প্রতিবাদী প্রেম’ ও রাজনৈতিক বোধ নজরুলের আধুনিক চেতনার উত্তরসুরী। আবুল আহসান চৌধুরী বলেন—‘নজরুল ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি যিনি ‘মানুষ’ শব্দটিকে সবচেয়ে বেশি উচ্চারণ করেছেন। তাঁর সেই উচ্চারণই পরবর্তীদের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে রইল।’

সমকালীন দৃষ্টিকোণে নজরুলের আধুনিকতা
একবিংশ শতাব্দীতে যখন বিশ্বজুড়ে চলছে ধর্মীয় বিভাজন, নারী নিপীড়ন, বাকস্বাধীনতার সংকট—তখন নজরুল হয়ে ওঠেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।

‘আমি মুসলমান, তুমি খ্রিষ্টান,
তবু ভিন্ন নয়, এক গোত্র আমরা সকলই মানব সন্তান।’
এই জাতীয় শ্লোকসম উচ্চারণ বিশ্বমানবতার প্রতীক।

শিক্ষায় প্রভাব
বাংলাদেশের পাঠ্যসূচিতে নজরুলের কবিতা আজও এক অনুসরণীয় নীতি ও নৈতিকতার ভিত্তি হিসেবে স্থান পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গবেষণায় নজরুল আধুনিকতার প্রধান উৎস হিসেবে আলোচিত।

সংস্কৃতি ও গণচেতনায় প্রভাব
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন—সব ক্ষেত্রেই নজরুলের কবিতা মানুষের অনুপ্রেরণা ছিল। ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নজরুল জাতীয় চেতনার কবি, তাঁর আধুনিকতা কোন কালের গণ্ডিতে আটকে রাখার নয়।’ (নজরুল-জীবন ও সাহিত্য, রফিকুল ইসলাম)

সমালোচনা ও বিতর্ক
নজরুলের আধুনিকতা বিষয়ে সাহিত্য সমাজে একাধিক বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেন, তাঁর কবিতা আবেগে প্রখর কিন্তু শিল্পরীতিতে অসম; আবার কেউ বলেন, তিনি ছন্দের সঠিক প্রয়োগে সফল ছিলেন না। তবে অধিকাংশ গবেষক একমত—তাঁর সাহসিকতা, বিষয় বৈচিত্র্য ও মানবিকতা আধুনিক সাহিত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মন্তব্য করেন, ‘নজরুল শিল্পী হিসেবে ত্রুটিপূর্ণ হতেই পারেন, কিন্তু চিন্তায় ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিলেন যুগান্তকারী।’

কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা কেবল কাব্যরসের বাহন নয় বরং এক সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ। আধুনিকতার বহুমাত্রিক রূপ-ভাষায়, ভাবনায়, আদর্শে, প্রতিবাদে, প্রেমে, ধর্মে ও মানবতায়—সব দিক থেকেই নজরুল বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা।

তিনি দেখিয়েছেন সাহিত্য শুধু মনের খোরাক নয়—এটি সমাজ বদলের হাতিয়ার। তাঁর কবিতায় বাঙালি খুঁজে পেয়েছে আত্মপরিচয়, আত্মমর্যাদা ও বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন। আজকের সমাজেও সেই আধুনিকতার বার্তা নতুন প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে রয়েছে।

তথ্যসূত্র:
১. রফিকুল ইসলাম, নজরুল: জীবন ও সাহিত্য, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৪
২. আবুল আহসান চৌধুরী, নজরুল: জীবন, সাহিত্য ও দর্শন, বাংলা একাডেমি, ২০০৭
৩. আনিসুজ্জামান, বাংলা সাহিত্য ও আধুনিকতা, বাংলা একাডেমি, ২০০০
৪. কাজী নজরুল ইসলাম, সঞ্চিতা, দোলনচাঁপা, সঞ্চয়িতা, প্রলয়োল্লাস, সার্বভৌম ইত্যাদি রচনাবলি
৫. সূর্যসেন গুপ্ত, আধুনিক বাংলা কবিতা, দেব সাহিত্য কুটির, ২০০৫
৬. মুনীর চৌধুরী, সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব, ১৯৬০
৭. কাজী আবদুল ওদুদ, সাহিত্য চিন্তা, ১৯৪৮।