১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা। জানা যায়, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউসের সামনে বটতলায় চটের ওপর ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার শুরু করেন। এই ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই।
চিত্তরঞ্জন সাহার এই উদ্যোগ থেকে প্রেরণা লাভ করে কালের পরিক্রমায় রূপ নিয়েছে আজকের মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা। যা বাংলা একাডেমী চত্বর থেকে সম্প্রসারিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে। পৃথিবীর নানা দেশেই বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। বইমেলা মানেই লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের মিলনমেলা।
বিশ্বের ৭টি সেরা ও বৃহৎ বইমেলার মধ্যে রয়েছে: আবুধাবি আন্তর্জাতিক বইমেলা, বুক এক্সপো আমেরিকা (বিইএ), ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা, গুয়াদালাজারা আন্তর্জাতিক বইমেলা, হংকং বইমেলা, লন্ডন বইমেলা ও নয়াদিল্লি বইমেলা।
আবুধাবি আন্তর্জাতিক বইমেলা : সাহিত্য পঞ্জিকার বড় মেলাগুলোর মধ্যে নতুন এই বইমেলাটি বছরে একবার অনুষ্ঠিত হয়। সাহিত্য ও ঐতিহ্য রক্ষার্থে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার সহযোগে আবুধাবি কর্তৃপক্ষ এই মেলায় আয়োজন করে। এর মাধ্যমে আরব আমিরাত প্রকাশনা জগতের বৈশ্বিক প্রধান কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে চায়। বইয়ের শর্ত এবং অনুমতিপত্র ক্রয়ের দরাদরির জন্য এই মেলার গুরুত্ব অনেক। এছাড়াও আরবের ভাষা, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকান প্রকাশকদের জন্য এটি সর্বেশ্রষ্ঠ বইমেলা।
বুক এক্সপো আমেরিকা (বিইএ) : অন্যান্য বইমেলার মতো বিইএ প্রতিবছর কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় হয় না, সারাদেশে ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠিত হয়। এটি আমেরিকার সবচেয়ে বড় বার্ষিক মেলা, যা চারদিনব্যাপী চলমান থাকে। যদিও প্রতিবছর এর জায়গা পরিবর্তিত হয়, তবুও গ্রীষ্মের শুরুতে কোনো প্রধান শহরে এটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এটি প্রথমে শুরু হয়েছিল আমেরিকান বই বিক্রেতা সংঘ সম্মেলন এবং ১৯৪৭ এর বাণিজ্য প্রদর্শনীর মাধ্যমে৷ এর অন্যতম উদ্দেশ্য আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশককে সামনে নিয়ে আসা। বই কেনার খুচরা বিক্রেতা, এমনকি লাইব্রেরিয়ান এবং লেখকদের সুবিধানুযায়ী এ বইমেলা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়।
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা : অংশগ্রহণকারীর সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে বইয়ের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ বাণিজ্য মেলা হলো জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। এই মেলায় কতজন ঘুরতে আসলো তার দিকেও সকলের নজর থাকে। প্রতিবছর অক্টোবরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বেচাকেনা হয় একদিন এবং পাবলিক ইভেন্টগুলো থাকে পাঁচদিনব্যাপী। এটি সাধারণত একশোরও বেশি দেশ থেকে আগত প্রায় সাত হাজার অংশগ্রহণকারীর সাথে এক মিলিয়নেরও বেশি দর্শককে নিয়ে সাহিত্য পঞ্জিকার গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে। ১৯৪৯ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা শুরু হয়। এখানে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে খুচরা বেচাকেনা হয় না; বরং লেখক, প্রকাশক এবং পুস্তক বিপণনকারীদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক তৈরিই এই মেলার উদ্দেশ্য।
গুয়াদালাজারা আন্তর্জাতিক বইমেলা : মেক্সিকান শহর গুয়াদালাজারা স্প্যানিশ ভাষার প্রকাশনা জগতের প্রধান অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে। এ মেলাটি বইয়ের জগতের পেশাদারদের জন্য সবচেয়ে ভালো বাণিজ্যিক পরিবেশ নিশ্চিত করে, তেমনি পাঠকদের মনেও এটি এক অনন্য অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। ১৯৮৭ সাল থেকে প্রতি বছর গুয়াদালাজারা বিশ্ববিদ্যালয় এই মেলার আয়োজন করে আসছে, যার ব্যাপ্তি এখন মেক্সিকান শহর গুয়াদালাজারার প্রায় ৪০০০০ মিটার স্কয়ার জায়গা জুড়ে। এটি সাধারণত নভেম্বরের শেষের দিকে এবং ডিসেম্বরের শুরুতে নয়দিন ধরে চলে।
হংকং বইমেলা : সাধারণত জুলাই মাসে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম হংকং বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এটি হংকং ট্রেড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল কর্তৃক আয়োজিত এশিয়ার সর্ববৃহৎ বইমেলা। এটি হংকং এর প্রধান একটি অনুষ্ঠান, যার দর্শক সংখ্যা প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। এই বইমেলার লক্ষ্য হংকং-এর ভৌগোলিক পটভূমির অন্তঃস্থল থেকে সাহিত্য সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার। বিশ্বসাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ বইগুলোসহ প্রকাশনা জগতের সাম্প্রতিক নানান উদ্ভাবনমূলক বিষয়ও এ মেলায় বিশেষভাবে স্থান পায়। এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি বইমেলা হিসাবে সাম্প্রতিকতম প্রযুক্তিগত এবং মাল্টিমিডিয়ার নানান উদ্ভাবন যেমন এখানে দেখতে পাওয়া যায় তেমনি দর্শকরা বই কেনার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও জড়িত হতে পারে।
লন্ডন বইমেলা : প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে প্রতি বছর লন্ডন বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। লন্ডন বইমেলা প্রকাশকদের জন্য আয়োজিত একটি বিশেষ ইভেন্ট থেকে আজকের এই পর্যায়ে এসেছে। ইভেন্টটির মূল উদ্দেশ্য ছিল, ছোট প্রকাশকদের কাজ তুলে ধরার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। বর্তমানে লন্ডন বইমেলা একটি বিশাল আন্তর্জাতিক আয়োজন হয়ে উঠেছে। অন্তত ইউরোপের ক্ষেত্রে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার পরেই এর স্থান। বেশ কয়েকবার স্থান পরিবর্তনের পর গত কয়েক বছর ধরে অলিম্পিয়ায় এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
নয়াদিল্লি বিশ্ব বইমেলা : কলকাতার পরে ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বইমেলা হলো নয়াদিল্লি বিশ্ব বইমেলা। প্রায় দুই শতাধিক অংশগ্রহণকারী নিয়ে ১৯৭২ সালে প্রথম এ বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে এটি ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট দ্বারা বছরে একবার আয়োজিত হয়। প্রতি বছর এক হাজারেরও বেশি অংশগ্রহণকারী সমেত আয়োজিত এ বইমেলা এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ইংরেজি ভাষার বইমেলা হিসাবে স্বীকৃত। বছরের প্রথম দিকে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়, যা আঠারোটি ভাষায় কাজ করা প্রায় বারো হাজার প্রকাশকের দেশীয় প্রকাশনা জগতের জন্য বিশাল এক ক্ষেত্রে প্রস্তুত করে। এমনিভাবে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আগত দর্শক ও প্রকাশকরা মিলে এটিকে সত্যিকারের একটি বিশ্বব্যাপী ইভেন্ট করে তুলেছে।
তথ্যসূত্র : Ribbonfish