অতিক্রান্ত কৈশোরে শঙ্খ ঘোষের কবিতা তেমন পড়িনি। প্রিয় কবির তালিকায়ও তার নাম ওঠেনি। কিন্তু নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখা ‘কবিতার ক্লাস’ যখন মন ভরাতে পারেনি ছন্দ শেখার কাজে, তখন সারাক্ষণের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ালো ‘ছন্দের বারান্দা’। বইটির লেখক আমার কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করেনি সেদিন। কেবল অসামান্য আগ্রহে পাঠ ও পুনর্পাঠ করেছি এবং রপ্ত করেছি ছন্দের নানান প্রকৃতি। কিন্তু তারও অনেকদিন পরে যখন হঠাৎ চোখে পড়ায় কিনে নিলাম ‘নিঃশব্দের তর্জনী’- তখন মনে হয় অন্তরের গহিন গভীরে টের পেলাম কবিতা কীভাবে শব্দে রচিত হয়েও নিঃশব্দে বিচরণ করতে পারে পাঠক হৃদয়ে। আর এই পরম উপলব্ধির কারণেই টের পেলাম কবিকে বিষম ঝাঁপ দিতে হয় গভীর আড়াল থেকে। টের পেলাম কবির মজ্জার ভেতরে থাকে একটা অহম বা আত্মসম্মানবোধ এবং মুখ ঘুরিয়ে উদাসীনভাবে সরে দাঁড়ানোর শক্তি। ‘এখন আমরা দাম্ভিক গর্বিত নই, নির্জীব কিন্তু উদাসীন নই, লুব্ধ কিন্তু লিপ্ত নই’। এই অদ্ভুত অসামান্য কথাগুলো যতই দিন গড়িয়েছে ততো বেশি উপলব্ধির গভীরে প্রোথিত হয়েছে। আর চারপাশের লেখালেখি করা লোকের শব্দের অতি গর্জন, প্রকাশের আতিশয্য এবং প্রাপ্তির লোভ যখন আমার নজরে আসে, আমি তো বারবার মনে করি একটি অসামান্য প্রবন্ধের কথা। তা হলো শঙ্খ ঘোষের ‘নিঃশব্দের তর্জনী’।
‘রাত্রে ঘুমোবার আগে ভালোবাসবার আগে
প্রশ্ন কর কোন দল তুমি কোন দল’
কবি শঙ্খ ঘোষ নিজেকে সকল দলাদলির বাইরে রেখে আজীবন উঁচু করে ধরে রেখেছেন নিঃশব্দের তর্জনী। আর আমি ভাবতে থাকি সেই স্মৃতিপাঠ- ‘মৌন জানে শুধু মানুষের বুক, দুয়ের মধ্যে সম্পর্কেই আছে মৌনের বীজ’। যেমন, লেখক বলেছিলেন সেই বীজ কেবলই ফিরে পেতে চায় এই মৌনের নির্যাস, যাকে আমরা বলতে পারি যাপন। নীরবতার মধ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য কবিতা ধারণ করে এক সুঠাম স্বর, যা গতির ভেতরে ধরে রাখে যতির স্থান। তেমন কবিতা আমি লিখতে পেরেছি কিনা জানি না, তবে এটাই তো কবিতার আরাধনা, যা চিহ্নিত করে গিয়েছেন কবিদের কবি শঙ্খ ঘোষ।
রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দের পরবর্তী সময়ে আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম কবি তিনি। গদ্য আর পদ্য- সাহিত্যের দুই ক্ষেত্রেই শঙ্খ ঘোষ নিজের ছাপ রেখে গিয়েছেন অসামান্য দক্ষতায়।
‘সংগোপনের মন বুঝবার মন-
কীসের ওপর ভর করেছ হদিশ তো নেই তারও
দাহর পরে দাহই অনুক্ষণ।’
শঙ্খ ঘোষ ‘নিঃশব্দের তর্জনী’ গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছিলেন যে, কবিতা শেষ পর্যন্ত একটা সৃষ্টির কাজ। তাই, যখনই দেখতে পাওয়া যায় যে কোনো একটি লেখা হয়ে উঠছে একেবারে নতুন সৃষ্টি, সে একটি অন্যরকম অভিজ্ঞতা, যা হয়ত প্রথম জেগে ওঠে কবির মনে, তখনই তাকে তিনি কবিতা বলতে চান। সে কারণেই কবিতা পড়ার সময় আমরা কবিতার রূপটুকু লক্ষ্য করতে চাই এবং লক্ষ্য করি সেই রূপের অন্তরালে ভেতরে ভেতরে জেগে ওঠা কবির ব্যক্তিত্বটুকু। উচ্চকিত নন, তবু সরব- এটাই হয়ত তার বৈশিষ্ট্য।
শঙ্খ ঘোষের প্রতিটি রচনা অনন্য রসবোধ ও বৈদগ্ধের আকর, পাঠকের মনে প্রশান্তি নিয়ে আসে। প্রশান্তির সাথে সাথে বিপ্লবী চেতনারও স্ফুরণ ঘটায়, যেমন দেশভাগের সময় গর্জে উঠেছিল শঙ্খ ঘোষের কলম। একের পর এক কালজয়ী কবিতা সৃষ্টি করে গিয়েছেন তিনি আমৃত্যু। বাঙালির মধ্যবিত্ত মননের স্বরূপ তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন অসামান্য মুনশিয়ানায়। নিজেকে নিয়ে সাধারণ্যের দ্বন্দ্ব, জীবনকে ঘিরে যাপিত আলো-অন্ধকার, বঞ্চনা আর ভালোবাসার পরিচিত গণ্ডিই কেমন অচেনা হয়ে ধরা দেয় তার কবিতা ও গদ্যে।
বিশ শতকের তিরিশ দশকের পঞ্চপাণ্ডবদের কথা বহুলালোচিত। পরবর্তী সময়ে পঞ্চাশের দশকেও এই বাংলা কবিতাকে শিরে ধারণ করে এগিয়েছিলেন যে পাঁচ যোদ্ধা, ভারতের বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবিতার পঞ্চপাণ্ডব ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু এবং শঙ্খ ঘোষ। পবিত্র সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী ‘রবীন্দ্রনাথের পরে, শঙ্খ ঘোষ এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত নিয়মিতভাবে চেষ্টা করে গেছেন তাদের সাহিত্য সংক্রান্ত লেখালেখির মাধ্যমে নিজেদের ভাবনা-জগতের মধ্যে একপ্রকার মিথস্ক্রিয়া নির্মাণের।’
‘শব্দ থেকে পালানো’ প্রবন্ধটি আমাকে তার প্রতি আরও বেশি উৎসুক করে তোলে। এখানে তিনি দাদাবাদ এবং আরাগঁ’র অনুকরণবৃত্তির মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতায় যে এবস্ট্রাকশনের প্রচেষ্টা চলেছে তার পেছনের কারণ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হন। আর তিনি মনে করেন যে, শুধু কৌতুক, অবহেলা কিংবা নৈরাজ্যই এমন রচনার পেছনে ক্রিয়াশীল প্রেরণা নয়। বরং এখানে রয়েছে ভ্রান্ত দার্শনিকতা, শব্দবিলাসের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া। এই বক্তব্যের মধ্য থেকে এ বিষয়টা পরিষ্কার হয় যে কবির ভেতরে একটা সুস্পষ্ট দার্শনিক প্রক্রিয়া ক্রিয়ারত থাকা দরকার। কবির শব্দচর্চায় যে একটা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন রয়েছে, দিন শেষে ব্যয়কৃত শব্দ যেন নিষ্ফলা না হয়, সে বিষয়েও কবির বক্তব্য আমাকে ভাবনার খোরাক যোগায়। আর আমি উপলব্ধি করি, অভ্যাসবশত কথা বলা বা মিথ্যা বলার সর্বনাশা প্রভাব শিল্পেও প্রতিফলিত হয়, কবিতার অবয়বও কলরোলে ভরে যায়, হয়ে ওঠে বার্তাবিহীন এবং অভ্যাসতাড়িত। এসব কথা এতদিনে অধীত নানাজনের নানান কবিতার মধ্যে দেখতে পেয়েছি বলেই শঙ্খ ঘোষের লেখা পাঠ করা অত্যাবশ্যকীয় রূপে ধরা দেয় আমার কাছে।
শঙ্খ ঘোষ তার প্রবন্ধে অঁদ্রে জিদকে লেখা ভ্যালেরির চিঠির উল্লেখ করে মনে করিয়ে দেন যে ভ্যালেরির আক্ষেপ ছিল এক পৃষ্ঠা লেখা একটুমাত্র স্বরলিপির মহিমায় পৌঁছাতে পারে না। আক্ষেপ থাকলেও তার কবিতা তো রুদ্ধ হয়নি। তবে, কবি মনে করেন, এটাও স্মর্তব্য যে নামহীন কবিতার এবস্ট্রাকশন এদিকে কমিউনিকেশনে ব্যর্থ। এমনকি মালার্মে বর্ণিত ইনিসিয়েশনও এখানে নেই। তিনি মনে করেন ভাবীকাল একদিন ঘৃণার বিহ্বলতায় দেখবে এই পরম ধূসরতাকে।
কবি বলেন, শব্দ তার জড়ত্ব নিয়েই সম্মুখ দিকে এগোতে চায়। আর সেটাই শব্দের জন্য গৌরবের ব্যাপার। আজকাল প্রায় শুনি যে কবিতার কাল ফুরিয়ে গিয়েছে। এখন নানা রকমের মিশ্রশিল্পের আয়োজনে ব্যস্ত। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ সেই কবে দৃঢ়প্রত্যয়ে বলেছেন, এই নতুন জগতের এসব কার্যক্রম কবিতার প্রতিস্পর্ধী নয়, বরং তার সমান্তরাল। তাই মিশ্রশিল্প বা এবস্ট্রাকশন বা নিঃসঙ্গ প্রাকৃতিক আয়োজনের বাইরে গিয়ে আর দূর গভীরে জাল ফেলতে হয় শব্দশিল্পী বা কবিকে। আর আমি টের পাই পঞ্চাশের দশকের এই কবি তার সমকালীন অন্যদের মতো কেবল ভাবে বিভোর নন, তিনি যুক্তির অবিচলতায় বিশ্বাস করেছেন শব্দের শক্তিকে। নির্বোধ ব্যক্তিগত উচ্চাশার হানাহানির অপর পৃষ্ঠায় থাকে অন্তরালবর্তী জীবনের রোদসীরেখা। ওখানেই রয়েছে জীবনের আত্মার সাথে কবিতার গোপন সম্পর্ক, যেখানে ধরা দিতে থাকে ভয়াবহ পরিণামহীন মীমাংসাহীন সত্য। শঙ্খ ঘোষ যেভাবে কবির জীবনকে চিত্রায়িত করেন তার শব্দের পবিত্র শিখা প্রবন্ধে তা অতুলনীয়। তিনি মনে করেন একজন কবির কামনা প্রেমিকের মতো তিনটি প্রজাপতির দিন বাঁচতে। মানব জীবনের পঞ্চাশ বছর অপেক্ষা মাত্র তিনটি তীব্র দিবস, যার মধ্যে কবি তার সমস্ত অস্তিত্বকে ভরে রাখতে পারবেন। যেমন কিটস খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন তার প্রিয়াকে বর্ণনা করার জন্য উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর শব্দ, যা শুদ্ধ আবেগ ও শুদ্ধ সত্যকে প্রকাশ করবে। কিন্তু এমন শব্দ কোথায় মিলবে?! আসলে শব্দের সাথে কিটসের এই সংগ্রাম কবিমাত্রেরই সংগ্রাম। এই যে উজ্জ্বল শব্দের সন্ধানের কথা কিটস বলেছেন, কী সেই উজ্জ্বল শব্দের সংজ্ঞা? শঙ্খ ঘোষের ভাষ্যে নতুন শব্দের সৃষ্টিই শেষ কথা নয়, বরং শব্দের নতুন সৃষ্টিই মূল ব্যাপার। আর সেই শব্দের নতুন সৃষ্টি গ্রন্থকীটের ভাষা থেকে আসবে না, বরং লৌকিক ভাষা বা মৌখিক ভাষাই হচ্ছে কবিতার অবলম্বন, সকল রকমের প্রচলিত শব্দই কবিতার শব্দ হিসেবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু লক্ষ রাখা দরকার শব্দ যেন উদ্দেশ্যবিহীন বা লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়। শব্দটি নিশ্চয়ই সজীব, কিন্তু তা কতদিন সজীব থাকবে? কবি তার মধ্যে চিরন্তনতাও সন্ধান করেন। শঙ্খ ঘোষ আরেক জায়গায় বলেছেন এই শব্দকে সজীব ও চিরন্তন করে ধরে রাখতে ছন্দ ও স্পন্দন দরকার- যাকে তিনি একসাথে ছন্দস্পন্দ বলে উদ্ধৃত করেছেন; ছন্দের আলোড়ন এবং শব্দের আলোড়ন একই সাথে বাঁধা। মধুসূদন ঠিক এই কারণেই রঙ্গলালের ক্লান্তিকর পুরোনো নকশা থেকে অমিত্রাক্ষর ছন্দের পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন। আবার রবীন্দ্রনাথও অভ্যাসের গণ্ডি পেরিয়ে গদ্যকবিতার পথে পা বাড়িয়েছিলেন। তবে, রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা অন্য কোনো ছন্দে যে লেখা যেতো না, এমন দাবি করা যায় না। তবে সে ছিল পরীক্ষা নিরীক্ষার কাল। পরীক্ষার ভেতর দিয়েই কবিতার শব্দ নতুন মাত্রায় উজ্জ্বলতা পায়।
কবি বিশ্বসাহিত্যের সাথে সাথে ভারতীয় সাহিত্যের বিস্তৃত পটভূমি উদঘাটনের পাশাপাশি নিজের ভাবনা-জাল এমন চরিত্ররূপে ব্যবহার করেছেন, যেন কবির অভ্যন্তর থেকে অন্য এক ‘আমি’র উদ্ভাসন ঘটেছে। কবি শঙ্খ ঘোষের লেখা ‘দিনগুলি রাতগুলি’, ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’, ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থেও ‘আমি’র সরব উপস্থাপন লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথের ‘তুমি’র সাথে শঙ্খ ঘোষের এই ‘আমি’ তুলনীয়। তবে, এখানে কবি ‘আমি’র সঙ্গ অবিরত আলাপচারিতায় সংশয় ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্বের ভেতরে সত্যের অনুসন্ধান করেন। এখানেই কবি ‘আমি’ যোজনা করে সত্যের পথে এগিয়ে চলেন।
প্রশ্ন উঠতেই পারে সত্য শব্দটিকে নিয়ে। সত্য তো আর ‘এক’ নয়। সত্য অনেক। কেউ কেউ বলেন সত্য অনেক হলে তা সত্য কেমন করে হবে। যেন বা সত্য ‘বহু’ হতে পারে না। সত্য যে অনেক বেশি করে ‘সমূহ’কে ধারণ করে থাকে, সে যে ‘এক’-এর গণ্ডীর মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখে না, সেই দার্শনিক উপলব্ধির জগতে কবি শঙ্খ ঘোষের যাতায়াত ছিল নিভৃতে। তার কবিতা তাই নানা রকমভাবে সেই বহুস্তরীয় সত্যকে খুঁজে চলার সাধনা হয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়। আর এখানেই কবির কাব্য-ব্যক্তিত্ব ছুঁয়ে থাকে আমাদের সহজ অথচ গভীর সত্তার।
‘বলিনি কখনো?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে
সেই এক বলা
কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়ো
কোনো ভাষা নেই
কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে
যতদূর মুছে নিতে জানে
দীর্ঘ চরাচর
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই।
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলিনি? তবে কীভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?’
এই স্বগত সংলাপের ভেতর দিয়ে অন্তর্গত ‘আমি’ সমষ্টিগত ‘আমি’তে পরিণত হয় আবহমান চেতনায়। কবিতা লেখার সকল উপলক্ষ্য অন্তর্জগতের অনুভূতির কাছে মূল্য হারিয়ে ফেলে। তাই শঙ্খ ঘোষের কবিতার আপাত সরল বহিরঙ্গের আবেশ কাটিয়ে ভেতরের বক্তব্যের দিকে প্রবেশ করলে তার বহুস্তরের সূক্ষ্ম কারুকাজ অনুভূত হয়।
শঙ্খ ঘোষের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দিনগুলি রাতগুলি’র কবিতাগুলো রচিত হয় ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৪ সালের সময়কালের মধ্যে। রাষ্ট্রের দেশভাগজনিত মানচিত্রের রেখাকে প্রত্যাখ্যান করে কবি এখানে লিখেছিলেন- ‘মানচিত্র রেখা, তুমি দেশ নও মাটি নও তুমি’। যমুনাবতী কবিতাও সম্ভবত এই প্রতিবাদেরই আরেক ভাষ্যরূপ।
‘দেশের মানুষের কাছে তার খবর এসে পৌঁছেছে। কিন্তু খাবার এসে পৌঁছয়নি তখনও।’ ইতিহাস থেকে জানা যায় ১৯৫১ সালে খাদ্যের দাবিতে কোচবিহারে মিছিল হয়। পুলিশের গুলিতে ষোলো বছরের কিশোরী নিহত হয়, যাকে কবি গড়ে তোলেন যমুনাবতী স্বরস্বতীরূপে।
‘স্বাধীন দেশে স্বাধীন পুলিশের হাতে স্বাধীন এক কিশোরীর কত অনায়াস সেই মৃত্যু’।
যখন কবি বলেন নিভন্ত চুলায় আগুন ফলেছে, তখন তা বিপ্লব বর্তিকার কথাই ইঙ্গিত করে।
যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এ পথ দিয়ে
দিয়েছে পথ গিয়ে
নিভন্ত এই চুল্লিতে বোন আগুন ফলেছে।
একের পরে এক তিনি রচনা করেছেন ‘ইন্দ্র ধরেছে কুলিশ’, ‘হাসপাতালে বলির বাজনা’, ‘রাধাচূড়া’, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’, ‘বিকল্প’, ‘হাতেমতাই’র মতো বিস্ফোরণোম্মুখ কবিতাগুলো। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থটিও প্রতিবাদী কবিতার সংকলন। অনেক রকম প্রতিবাদের স্বর শুনি ‘মূর্খ বড়ো সামাজিক নয়’, ‘বাবরের প্রার্থনা’ এবং ‘লাইনেই ছিলাম বাবা’ কবিতাগুলোয়। আবার ছড়া লিখতে গিয়েও মারাত্মক মুনশিয়ানার পরিচয় দেন শঙ্খ ঘোষ। তার চরিত্রগুলো সব বাস্তব থেকে তুলে আনা, যা সুকুমার রায়ের কাছ থেকে তার ছড়াকে ভিন্ন সত্তা প্রদান করে।
শঙ্খ ঘোষের কবিতার ভাষা অভিধানমুখী না হয়ে বরং লৌকিক ও মৌখিক শব্দের অনুগামী হয়েছে। রবিঠাকুর যদিও বলেছিলেন ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’, শঙ্খ ঘোষ সেই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠে সহজ কথনভঙ্গি হৃদয়ঙ্গম করে মানুষের দুঃখ, শোক, যন্ত্রণা, হতাশা, স্বপ্নভঙ্গের প্রকাশে ব্যক্তিগত উপলব্ধিকে সমষ্টির চেতনায় নিয়ে গিয়ে শব্দের শক্তিকে নিঃশব্দে বেগবান করেছেন।