- তুমি শেষ পর্যন্ত এমন একটি কাজ করতে পারলে? আমার পছন্দ-অপছন্দের সম্মানটুকু করলে না? আমি কি এতকাল ধরে এমন একটি পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করেছিলাম আসিফ?
তিনতলা সিড়ি বেয়ে নিঃশব্দে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো আসিফ। বাবার তিরস্কার যেনো বেশ কয়েকদিনের দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজ সুরভি কফি কালার ও নীল পাড়ের একটি শাড়ি পরেছে। হাতে নীল পার্লের চুড়ি, কানে নীল পাথরের স্টার্ড। এত সাধারণ সাজেও সুরভি অনন্যা! রুমজুড়ে যেনো সুরভি ছড়ায়। সুরভি মিতবাক, স্বতন্ত্র রুচিবোধসম্পন্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের গ্রাজুয়েটেড ঊনচল্লিশ বছর বয়সী একজন দায়িত্বশীল নারী।
সিনিয়র এই নারীর প্রতি আসিফের অনুরক্তি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অফিসের এমডিসহ অনেকেরই চোখে পড়েছে ঘটনাটি, তবে আসিফের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। যেকোন এক্সকিউজ দিয়ে বারবার সুরভির রুমে আসে। সুরভিকে চা পৌঁছে দেয় রুমে। কোন প্রসঙ্গ ছাড়াই নিজের পরিবার সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দেয় সুরভিকে। সুরভির পরিবার সম্পর্কে জানতে উদগ্রীব থাকে। সুরভির আট বছরের মেয়েটিও মায়ের মতই মেধাবী। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে লেখাপড়া করছে।
আজও সুরভি অন্যদিনের মতই সবার মতন হৈ-হুল্লোড় না করে বরং নিজের রুমে এক মনে কাজ করে যাচ্ছিল। প্রথমদিন আসিফের সঙ্গে সাথে কোনো কথাই হয়নি, শুধুই দূর থেকে লক্ষ্য করেছিল সুরভিকে। সুরভির কণ্ঠস্বর শোনার জন্য অধীর অপেক্ষা করেছিল আসিফ।
কাজের প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী সুরভি। নতুন কিছু শেখা, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যেনো তার প্রতিদিনের সন্ধি।
একদিন বর্ষণমুখর রাতে পরিচিত কণ্ঠের ফোন পেয়ে বৃষ্টিপতনের সঙ্গে রুমের মধ্যে অদ্ভুত এক সিম্ফনি তৈরি হলো! ফোন রিসিভ করতেই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ফোনের অপরপাশে বলে উঠলো :
- আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন? আমার মা প্রচন্ড অসুস্থবোধ করছেন, এত রাতে কোন যানবাহন পাওয়া যাচ্ছে না।
- আমি আসছি। এড্রেস টেক্সট করে দিন, বলেই আর কোন বাক্য ব্যয় না করে তড়িঘড়ি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে আসিফ। রাত ১টায় পৌঁছে যায়, মগবাজারে, সুরভির বাড়িতে। সুরভি ও আসিফ সুরভির মাকে ধরে গাড়িতে বসিয়ে দ্রুত ড্রাইভ করে নিকটস্থ প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে আসে। প্রচন্ড ব্যথায় মিসেস ফিরোজা কোকাচ্ছেন। কর্তব্যরত ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন :
- কিছু টেস্ট করাতে হবে। হাই ব্লাড প্রেসার আছে। মিসেস ফিরোজাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিন। আপাততঃ ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হবে, তিনি ঘুমাবেন। আপনারা সকালে আসুন।
সুরভি মেয়েটিকে পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর কাছে রেখে এসেছে। বাড়ি ফেরার পথে পিনপতন নীরবতা ভেঙে আাসিফকে বললো :
- আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না; আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ আপনার কাছে।
- আমরা কি বন্ধু হতে পারি? বয়সে বড়-ছোট আমার কাছে কোন ম্যাটার নয়। আমরা তুমি করে আমাদের বন্ধুত্বের সূত্রপাত করতে পারি কি?
কিছুটা ইতস্ততঃ কণেবঠ সুরভি বললো :
- ‘বন্ধুত্ব এক মধুর দায়িত্ব’। আমার প্রিয় জিবরান থেকে কোর্ট করলাম।
পরদিন ছুটির দিন।
- সকালে আপনি নিশ্চয়ই মাকে দেখতে হাসপাতালে আসবেন। আমি কি আপনাকে পিকআপ করতে পারি? আমিও উদ্বিগ্ন আন্টির জন্য।
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সুরভি উত্তর দেয় :
- না, না আপনি প্লিজ ভাববেন না, আমার পরিচিত ট্যাক্সি আছে। আমি প্রতিদিন অফিসে যাতায়াত করি।
সুরভির অতি আপত্তি আরিফের ভালো লাগেনি, তবে আরিফ ধৈর্য্য হারাতে চায়নি। সুরভিকে বাড়িতে ড্রপ করে আরিফ ফিরে আসে নিজ ঘরে।
ঘরে ফিরে ফ্রেস হয়ে মিউজিক প্লেয়ারে পিয়ানোর সুর শোনে। ঘরময় এক আবহাওয়া তৈরি হয়। বৃষ্টি থেমে গেছে। ইন্সস্ট্রুমেন্টাল পিয়ানোর সুরে বাজছে শ্রীকান্ত আচার্যের ‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’।
সকালে ঘুমে আচ্ছন্ন আসিফের ঘুম ভাঙলো সুরভির ফোনে :
- মা এখন অনেকটা সুস্থবোধ করছেন।
আসিফ উত্তরে বললো :
- যেকোন প্রয়োজনে আমাকে কল দেবেন প্লিজ।
কোন প্রস্তুতি ছাড়াই আসিফ সুরভিকে বললো :
- আপনার সম্পর্কে জানতে চাই সুরভি, যদি আপত্তি না থাকে।
কিছুটা নীরব থাকার পর সুরভি জানালো :
- আমার জীবন আমি নিজেই পরিচালনা করছি, তাই অতীতের কোনকিছুই আমাকে আর আহত করে না। জীবনে একা সংগ্রাম একধরণের উপাসনার মত, তবে একদিন কিছু ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা শেয়ার করতে পারি।
আসিফ কিছু বলবার আগেই লাইনটা কেটে গেল। আর কথা বলা হয়নি সেদিন, হয়ত মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সুরভি।
সুরভি কিছুটা অস্বস্তিতে ভোগে। কিছু কথা কোন মানুষের কাছে শেয়ার করলে হয়ত কিছুটা স্বস্তি মিলবে।
সুরভি ও পিয়ানোর সুর যদি পাশাপাশি সঙ্গ দেয়, অভূতপূর্ব মুহূর্ত তৈরি হতে পারে। তবে মানুষ ও যন্ত্র কি একে অপরের ওপর নির্ভরশীল? কিছু স্বপ্ন নিমেষেই তৈরি হয়ে গেল। কোন এক নির্জন বিকেলে আসিফ ও সুরভি ধূমায়িত কফিতে পরস্পরের দৃষ্টি বিনিময় হৃৎকম্পনে পিয়ানোর তার জুড়ে যাবে? ভাবতে ভাবতে রোমান্টিক আবহে আসিফ জানালায় সদ্য থেমে যাওয়া বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে।
অফিসের বস আসিফকে ডেকে পাঠান :
- আসিফ আপনাকে তো ব্যাংকক যেতে হবে। আমাদের নতুন প্রজেক্টের মিটিংয়ে যোগ দেবেন?
আসিফের মনটা অস্থির হয়ে পড়লো সুরভিকে একবার দেখার জন্য।
- কবে যাচ্ছি ব্যাংকক?
- আগামী পরশু।
আসিফের চোখ বারবার সুরভির রুমের দিকে ঘুরে পুরো অফিসে খুঁজছে। সুরভি আজ কি তবে কাজে আসেনি? কল করে জানা উচিৎ হবে কি?
ভাবতে ভাবতে আসিফ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে।
আসিফ কল করে সুুরভিকে :
- হ্যালো, কেমন আছেন আপনি?
- আমি ভালো আছি।
- আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারি?
- মেয়েকে নিয়ে গানের ক্লাসে এসেছি। আপনি আসতে পারেন। এড্রেস পাঠিয়ে দিচ্ছি।
পৌঁছে এই প্রথম সুরভির চোখের দিকে তাকালো, অপরিচিত ভঙ্গিতে বললো :
- আপনি কোনধরণের গান পছন্দ করেন? আমরা পাশের ক্যাফেতে বসতে পারি?
- চলুন তবে, সোহানার ক্লাস শেষ হবে পাঁচটায়।
- আপনি আমাকে এড়িয়ে চলেন? কেন?
- না, মোটেও নয়।
- আমি কারো কাছে ঋণী থাকতে পছন্দ করি না। বলুন কি খাবেন? আজ আমি ট্রিট করবো আপনাকে। অর্থপূর্ণ জীবনঘনিষ্ঠ গান শুনতে ভালো লাগে আমার।
আসিফের বন্ধুত্ব হলো সুরভির সঙ্গে। মেয়েটি কেনো সারাক্ষণ একা থাকতে পছন্দ করে, প্রচন্ডরকম মানসিক কষ্ট বয়ে বেড়ানো মেয়েটির জীবনের কিছু কষ্ট ও সংগ্রাম-সত্য জেনে আসিফ ভারাক্রান্ত মনে ঘরে ফেরে।
মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল সম্ভ্রান্ত ঘরে। তবে বিয়ের পরে সুরভি লক্ষ্য করে রাহাতের স্বেচ্ছাচারী জীবন। বুঝতে বুঝতেই সুরভি ঠাহর করে তার ভেতরে বাড়ছে ভ্রুণ। সন্তান জন্মের পরে সব প্রচেষ্টা দিয়ে রাহাতকে সন্তানের ভবিষৎ চিন্তা করে সঠিক জীবনযাপন করতে পরামর্শ দেয়। কিন্তু দিনদিন রাহাত বেপরোয়া হয়ে ওঠে উশৃঙ্খল জীবনের মোহে। একদিন সুরভি আবিস্কার করে রাহাতের ড্রাগ আসক্তির বৃত্তান্ত। শ্বশুরবাড়ির সবার সাহায্যেও ফেরাতে পারেনি রাহাতকে আসক্তি থেকে। সুরভি মেয়েকে নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে বসবাস শুরু করে এবং রাহাতকে ডিভোর্স পাঠিয়ে দেয়। শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। কিছুদিন পর বাবার মৃত্যুর পর জীবন দূর্বিষহ হয়ে পড়ে। ছোটভাই বিয়ে করে অন্যত্র বসবাস শুরু করে।
সুরভি সংসারের হাল ধরে।
সুরভির মনে ভরসা সঞ্চয় করতে আসিফের অনেক সময় লেগে যায়। ক্ষতবিক্ষত মনকে নতুন করে উজ্জ্বীবিত করা সহজ কাজ নয়। বাবাকে সুরভিকে বিয়ের কথা জানাতেই বাড়িতে এক প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি হয়। মাঝে মাঝে রাগ, মাঝে মাঝে মৌনতাÑ এভাবেই কাটছিল আসিফ ও বাবার দিনকাল।
বিয়ের আগে সুরভি আসিফকে কখনও বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারেনি। কিন্তু আসিফের প্রগাঢ় ভালোবাসার কাছে সুরভি নত হয়।
আজ আসিফ ও সুরভির বিয়ের একবছর পূর্ণ হলো। আসিফের বাবা সিরাজ সাহেব এখনও সুরভিকে মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারেননি, যদিও শান্তশিষ্ট সোহানার প্রতি তার স্নেহ অপরিসীম।
সোহানাকে স্কুলে ড্রপ করে আসিফ ও সুরভি অফিসে আসে। দুপুরে হঠাৎ সিরাজ সাহেবের কল রিসিভ করে আসিফ প্রচন্ড চিন্তিত হয়ে পড়ে। বিকেলে আসিফের ফ্লাইট। অফিসের কাজে সিঙ্গাপুর যাচ্ছে। সুরভি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে মেয়েকে পিকআপ করে ঘরে ফেরে। সিরাজ সাহেবের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। সুরভি নিজের বাবার মতই সিরাজ সাহেবের দেখাশোনা করে, যদিও তিনি আপত্তি জানান। দিনরাত সুরভির শুশ্রুষায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবুও একজন পূর্ববিবাহিতা মেয়ে তার ছেলের বৌ হবেÑ তিনি ছিলেন এ পরিস্থিতির ঘোর বিরোধী।
সুরভি মনে মনে প্রশ্ন করে পাশ্চাত্য বিয়েতে সন্তানসহ পূর্ববিবাহিতাদের এভাবে সম্পর্কে কমপ্লিকেসি পোহাতে হয় না। তবে বাঙালি সংস্কৃতিতে এধরণের বিয়েতে মেয়েদের সব বিসর্জনের বলি হতে হয়। যদিও আসিফের এ বিষয়ে ব্যক্তিগত কোন অভিমত নেই, তবুও পরিবারে সম্পর্কের টানাপোড়েন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে প্রভাব ফেলে।
- আসিফ আমরা কি ভুল করেছি? বাবা আমার প্রতি সবসময় অসন্তুষ্ট থাকেন। আমাকে মনে করেন আমি পরস্ত্রী ছিলাম, আমাকে এ পরিস্থিতি প্রতিদিন বিব্রত করে।
- সুরভি তুমি আমার ভালোবাসা, বাবা আমার দায়িত্ব। আমি চেষ্টা করছি পরিস্থিতি সামলে নেবার। আমাকে আর কিছুদিন সময় দাও। আজ ছুটির দিন, চলো কোথাও ঘুরে আসি। দেশের বাইরে থেকে ফিরে আমার ক্লান্তি এখনও কাটেনি।
সোহানা নানির কাছে যেতে বায়না ধরে। সোহানাকে মায়ের কাছে ড্রপ করে সুরভি ও আসিফ শহর থেকে দূরে লং ড্রাইভে বেরিয়ে পড়ে। রিসোর্টে দু’জন দু’জনের সান্নিধ্য পরম উপভোগ করে।
- আসিফ তুমি আমার জীবনে না এলে ভালোবাসার মর্মার্থ বোঝা আমার সম্ভব হতো না।
- আমিও জীবনের পরিপূর্ণতা অনুভব করতে পারতাম না, জানো সুরভি!
দু’জন নিবিড় হয়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়।
বাতাসে পাতা মর্মরে ওড়ে ভালোবাসা। ওড়ে যুগল ফুল।