জীবনের সত্য

ডঃ মরিস রলিংস
  ১২ মার্চ ২০২৪, ১২:৫২

সংসারের মায়া বড় কুহকিনী! ছাড়ি ছাড়ি ক’রেও ছাড়া যায় না। সংসার জিনিসটাও ছাই বড্ড নাছোড়বান্দা! অনেকেই বলেন, কী দরকার মায়া বাড়িয়ে? একদিন তো সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে চলেই যেতে হবে। যেতে তো হবেই। কিন্তু মন যে মানে না। কোন কিছুতেই সে সায় দেয় না। দেখিনা আরও কিছুটা দিন, বেঁচেবর্তে থাকা যায় কিনা। আমার বলতে এ জগতে যা কিছুই আছে, তার গণ্ডি আরও কিছুটা বাড়াতে পারি কিনা। আমি তো থাকবোই না। কথা সত্যি হলেও একেবারে কপর্দকহীন চ’লে যাবো, তাও নিরেট অকাট্য হলেও উত্তরসূরি যারা থাকবে বংশপরম্পরায়, তারা তো অন্ততঃ ভোগদখল করে যেতে পারবে। সবকিছু যদি ‘আমার নয়’ ব’লে ত্যাগই করি, তবে চলবে কেন? তাহলে তো জগত সংসার ব’লে এ পৃথিবীতে আর কিছুই থাকতো না।
মানুষ বড়ই আজব জীব! মানুষের এক দল বলে, ‘এ জগতে সবই অসাড়। দু’দিনের এ প্রবাসে এক রকম বেড়াতে এবং সওদা করতে এসেছি। জগতের সংসার-আঙ্গিনায় ঘুরে বেড়িয়ে; কর্মের বিপরীতে পাপ-পুণ্য সওদা করতে করতে সময় হলেই চ’লে যেতে হবে। টুপ ক’রে চ’লেই যাবো।’ বাস্তবিক, মানুষ সকলেই গেছে। নিয়ত সকলেই যাচ্ছে। ভবিষ্যতে সকলেই যাবে। অপ্রিয় হ’লেও, এ নির্ঘাত সত্য কথা!
আবার আরেক দল মানুষ আছে, যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, শ্বাস-প্রশ্বাস যতক্ষণ চলে, সবই ‘আমার আমার’ ব’লে চিৎকার করতেই স্বচ্ছন্দবোধ করে, ‘যত পারি ভোগদখল ক’রেই যাবো। জীবন তো মাত্র একবারই আসে। এমন তো নয় যে, একবার ম’রে গিয়ে আবার ফিরতি জীবনে বাকিটুকু ভোগ ক’রে যাবো।’
তো এ ভাবেই চলছে জগৎ-সংসার। তদুপরি এটাই স্বতঃসিদ্ধ সত্য যে, কোন মানুষই অমর বা দেহগতভাবে অমর বা চিরজীবী নয়। জগতে কত ধনাঢ্য, কত ক্ষমতাবান, কত বড় চিকিৎসক, আরও কত বৈজ্ঞানিক, জ্ঞানী, গুণী। তাঁদের কেউ তো আর চিরদিন বেঁচে থাকছেন না।
অবশ্য এক সময়কার সভ্যতা প্রমাণ দেয় যে, দেহগতভাবে মানুষ ম’রে গিয়েও অন্ততঃ তাঁর শারীরিক অস্তিত্বকে একেবারে বিলীন হয়ে যেতে দিতে চায়নি। তাই তখনকার কিছু কৌশল ব্যবহার ক’রে ‘মমি’ আর ‘পিরামিড’কে প্রচলন করলো দৈহিক-স্মারক হিসেবে টিকিয়ে রাখতে। হাজারো বছরের পুরনো সভ্যতার নিদর্শন এখনও সেই প্রচেষ্টার সাক্ষ্য দেয়। তাজমহলের মত স্মারক-স্থাপনা, ইতিহাসখ্যাত ব্যক্তিদের বাঁধাইকৃত সমাধি-সৌধ, এবং এ সকলের গাঁয়ে রচিত এপিটাফ প্রয়াত প্রিয়জনদের স্মরণীয় ক’রে রাখার নিদর্শনের সাক্ষ্য দেয়।
তবুও সার কথা এই যে, সংসারের মায়া ছেড়ে সকলকে, আপনাকে, এমনকি আমাকেও চলে যেতে হবে। তা চলে তো যাবোই। বিষয়টা এমন, এই আছি। আবার এই নেই। এখন আছি জীবিত। কিছুক্ষণ বাদে নাও থাকতে পারি। আজ আছি। কাল নেই। এ বছর আছি। আগামি বছর আমার কী হবে জানি না। এটাই সত্য। গেল বছর এদিনে আমাদের আশেপাশে কত আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজন ছিল। আর এ বছর তাদের অনেকেই নেই! এমনকি, আগামিকাল ঠিক এসময় আমরা মানুষ যে বেঁচেই থাকবো, তা কেহই হলফ করে বলতে পারি না।
মৃত্যু মানুষের জীবনে একান্ত চুপিসারেই হানা দেয়। বস্তুতঃ যেদিন মানুষ মায়ের গর্ভে জীবনসত্তা নিয়ে আগমন করে সেদিনই সে মৃত্যুর পরোয়ানা প্রাপ্ত হয়! তার একহাতে এ জগতে ভূমিষ্ঠ হবার ছাড়পত্র, আর অন্য হাতে এ জগত ছেড়ে চ’লে যাবার নিষ্ঠুর পরোয়ানা! এক করকম ‘রিটার্ন টিকেট’ হাতে নিয়েই আমাদের সকলের আগমন এ প্রবাসে। কেউ কি ‘ওয়ান ওয়ে’ টিকেট নিয়ে; ফিরে না যাবার মনোবৃত্তি নিয়ে এখানে এসেছেন? এ জগতের ‘ইমিগ্রেশন’ ফাঁকি দিয়ে কি কেউ ফিরতি টিকেট ছাড়াই আসতে পেরেছেন? নির্দিষ্ট সময়ের ‘ভিসা’ ছাড়াই কি এ জগতের ‘কাস্টমস’-এ ছাড়া পেয়েছেন? ‘আমি জন্মসূত্রে  চিরদিনের জন্য এ পৃথিবীর নাগরিকত্ব পেয়েছি’ ব’লে অতি সহজেই ‘গ্রীণ সিগন্যাল’পার হয়ে এসেছেন? মানুষ ও জীবের পক্ষে কি তা সম্ভব? তো, আগত মানুষেরা যতক্ষণ এ জগতে বিচরণ করবেন; ততক্ষণই তাদেরকে হাতে ‘এম্বারকেশন কার্ড’ নিয়ে চলতে হয়। কখন কোথায় সেই অনাকাঙ্ক্ষিত যমদূত, মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় তার কি ঠিক আছে? কেহই তা জানে না।
আবার অনেক মানুষ তড়িঘড়ি ক’রে এ পৃথিবী থেকে চ’লে যাওয়ার জন্য  আত্ন-হননের পথ বেছে নেয়। কিন্তু কেন? বেঁচে থাকাই মানুষের যখন চূড়ান্ত ও আপ্রাণ প্রচেষ্টা, তখন কোন কোন মানুষ অকালে তাদের মৃত্যুর আগেই ‘মৃত্যু’কে বরণ ক’রে নেয়। কী নির্মম! এ জগতে মানুষ তার অবলম্বন বলতে আর কোন কিছুর উপর যখন ভরসা বা নির্ভর করতে পারে না, সমূহ জগতটাকে তখন তার কাছে তখন একান্তই অসহ্য,  বিব্রতকর এবং দুর্বিষহ মনে হয়। যখন যাপিত-জীবনকে বড় কষ্টের বোঝা ব’লেই মনে হয়, তখনই প্রচন্ড আবেগে তাড়িত হয়েই বুঝি, পরিশেষে সে এ পথটাকে বেছে নেয়। তখন তার কাছে কি বেঁচে থাকার বিষয়টাই একান্ত গৌণ ও নিরর্থক হয়ে যায়? বোধ করি, হয়ত তো তাই।
তারপরও অনেকে বলেন, ‘আত্মহত্যা করতে গিয়ে, মরতে মরতে মানুষ যখন শেষ ও চূড়ান্ত পরিণতিতে চ’লে যায়; তখন মৃত্যু তার জীবনে নিশ্চিত এবং ধ্রুব-সত্য হয়ে দাঁড়ায়। তারপরেও শেষবারের মতো, অনেকের ভিতরে বাঁচার ‘শেষ-আকাঙ্ক্ষা’ জেগে ওঠে। তখন তারা কয়েক মুহূর্তের জন্যে হলেও তার অনিবার্য মৃত্যুকে নয়, বরং জীবনকেই ফের আলিঙ্গন করতে চায়। ফিরে পেতে চায় তাদের জাগতিক মানবীয়-অস্তিত্বকে।
আত্মহত্যা’ প্রসঙ্গে ডঃ মরিস রলিংস তাঁর ‘মৃত্যুর পরে ও আত্মার কথা’ গ্রন্থের ৫৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘‘আত্মহত্যার চেষ্টা বহু ব্যক্তি করে কিন্তু অনেকেই অকৃতকার্য হয়। যাহারা কৃতকার্য হয় তাহারা মনে করে সব শেষ হইল, কিন্তু তাহা নহে। বস্তুতপক্ষে ইহা আরম্ভ মাত্র। আমি যতগুলি ঘটনা দেখিয়াছি অথবা অন্য চিকিৎসকের নিকট শুনিয়াছি তাহাতে মনে হয় ইহা অর্থাৎ আত্মহত্যা করিয়া কেহ দুঃখের অবসান করিতে পারে না। বরং অপর এক কষ্টকর জীবনের শুরু বা আরম্ভ হয়। আত্মহত্যার পর যাহারা পুনরায় ফিরিয়া আসিয়াছে এবং শরীরের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করিয়াছে তাহাতে একটি সুখকর অভিজ্ঞতার খবর নাই। যাহা হউক কেবলমাত্র কয়েকজন তাহাদের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করিয়াছে।’
বিজ্ঞান বলে, সৃষ্টিতে এ মহাজাগতিক পরিমণ্ডলে আপাতদৃষ্টিতে অনেক বস্তুকেই আমরা বিলীন বা নিঃশেষ হয়ে যেতে দেখি। সবকিছুকে অস্তিত্ববিহিন হয়ে যেতে  প্রতীয়মান হয়। আসলে কিন্তু তা নয়। বস্তুর শুধু অবস্থার পরিবর্তন এবং রূপান্তর ঘটে মাত্র। বস্তুজগতে ‘বিবর্তনবাদ’ এবং ‘অবিনাশিবাদ’ বলে বিজ্ঞান-স্বীকৃত ও প্রমাণিত মতবাদ রয়েছে। মানুষের, জীবের জন্ম-মৃত্যু তারই চলমান প্রক্রিয়া। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন-অস্তিত্বের অবস্থান্তর বা রূপান্তর ঘটে মাত্র। শারীরবৃত্তিয়-প্রক্রিয়ার অবসান ঘটিয়ে পার্থিব-পরিমণ্ডল ছেড়ে, মানুষ তার আধ্যাত্মিক সত্তা নিয়ে অজাগতিক-আবহে প্রবেশ করে । সেখান থেকে; সেই স্তর থেকেই আবার শুরু হয়, তার পারলৌকিক জীবনের নতুন অধ্যায়। মানুষ তার জন্য নিশ্চিত আর এক নতুন জগতে প্রবেশ করে। তার সেই জ্ঞানাতীত জগতটা কী? কেমন তার রূপ? এটাই মানুষের চরম ও পরম জিজ্ঞাসা। জানার বিপুল আগ্রহ। কালে কালে মানুষ, এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে আসছে। কিন্তু তার ‘বিজ্ঞান-সম্মত’ যুক্তিগ্রাহ্য কোন প্রমাণ বা উত্তর দাঁড় করতে পারেনি সে।  
তো, মোদ্দা কথা হল, জীব মাত্রই মৃত্যুকে ভয় পায়। জীবের প্রধান শর্তই হল বেঁচে থাকা। তার পারিপার্শ্বিকতায় জগত-সংসারের যত কিছু প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি, সবকিছুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম ক’রেই বেঁচে থাকা, টিকে থাকা এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা জীবের ধর্ম। যতক্ষণ তার অস্তিত্বে প্রাণ আছে, ততক্ষণই সে জীবিত-জীব। প্রাণ নেই তো জড়-অস্তিত্বের কাছে নিজেকে নিঃশর্তভাবেই ছেড়ে দেয়া। অবলীলায় সোপর্দ করা। প্রাণ ধারণ করে, বেঁচে থাকতে থাকতেই জীব তাই, তার জীবনের পরিপূর্ণতার স্বাদ পুরোটাই আস্বাদন এবং উপভোগ করতে চায়। তাই জীবনের বিস্তর চাওয়া আর সীমিত পাওয়ার মাঝে সম্ভাব্য সামঞ্জস্য বিধান ক’রেই সে তার অস্তিত্বটাকে, জীবনটাকে সর্বোপরি তার পছন্দের নিজস্ব জগতটাকে সম্ভাব্য নিরবচ্ছিন্নতার আবহে সাজাতে চায়।
মৃত্যুচিন্তা অধিকাংশ মানুষকেই বিমর্ষ ক’রে তোলে। নড়বড়ে ক’রে দেয় তার জীবনের ভিত্তিকে। পরমায়ু নিয়ে বেঁচে থাকার আত্ম-বিশ্বাসকে। এবং দুর্বল ও বাঁধাগ্রস্ত ক’রে দেয় তার বেঁচে থাকার গতিময় সাবললিতাকে। তখন সে যেদিকেই তাকায়, সবকিছুই ভীষণ পর পর মনে হয়। নিষ্ঠুর আর স্বার্থপর বলেই প্রতিভাত হয় পুরো জগতটাকে। সমূহ পারিপার্শ্বিকতা বড়ই মলিন আর দুঃসহ হয়ে ওঠে তার কাছে। আসলে মৃত্যু নিয়ে মানুষের বিচিত্র ভাবনা, কল্পনা রয়েছে। আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান।’ অনেকে মৃত্যুর ঘোর থেকে ফিরে এসে, সবিস্তারে বিধৃত করেছেন তাঁদের লব্ধ বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। এরূপ কতজনেরই বা আছে মৃত্যুর অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা? তো, মৃত্যুকে জীবনের কাছ থেকে অবলোকন করেছেন অনেকেই। মৃত্যু নিয়ে বিস্তর লেখালেখি, গবেষণা হয়েছে। এখনও হচ্ছে। আগামিতেও হবে। মানুষ  এযাবৎ; মৃত্যু-রহস্যের প্রাগৈতিহাসিক খোলসটাকে ভেদ ক’রে কি তার অন্তর্নিহিত রূপ উদ্ঘাটন করতে পেরেছে? প্রকৃত অর্থে বলা যায়, মৃত্যু-রহস্য মানুষের চিন্তা-চেতনায় এখনও অনুদ্ঘাটিত এবং অলিখিত রহস্যময় এক সুবিশাল উপাখ্যান হয়েই আছে ! তো, জীবন-মৃত্যু খেলার মূল নাটাইটা যাঁর হাতে, সেই বিশ্ব-নিয়ন্তা খেয়ালী সৃষ্টিকর্তাই স্বয়ং পরম আয়াসে নিয়ন্ত্রণ করছেন, জীব ও জীবনের অমোঘ পরিণতির ট্রাজেডি-পর্ব। এ কাজে তিনি বড়ই পারঙ্গম!  কেবল অদৃশ্য তাঁরই নির্দেশে ও ইশারায়, জগতমঞ্চে আবির্ভূত কোন কোন অভিনেতা-অভিনেত্রির চলমান দৃশ্যপটে করুণ যবনিকাপাত ঘটছে অযাচিতভাবেই। বড্ড অসময়ে। অবলীলায় জীবনের লেনদেনের সমস্ত পাট অসমাপ্ত রেখেই পিছু হ’টে এ জগতের রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে তাদের। জীবন-নাট্যের ঘূর্ণায়মান মঞ্চ থেকে যবনিকা ঠেলে অপসারিত হতে হচ্ছে একান্ত ত্বরিতেই। এইতো বিধির অমোঘ বিধান! নিষ্ঠুর নিয়তি! এই তো জীব ও জীবনের  অমোঘ চূড়ান্ত সত্য!
সৃষ্টিতে যতকিছু মহাজাগতিক ধ্রুবসত্য রয়েছে, মানুষের জন্ম ও মৃত্যু তাদের মধ্যে অন্যতম। সূর্যের চারিদিকে তার নিজস্ব কক্ষে আপন গতিতে পৃথিবী ঘুরছে তো ঘুরছেই। আগামিতেও ঘুরবে। কিন্তু জন্মের পর মানুষ বেঁচে আছে তো; বেঁচেই থাকবে অনাদিকাল, তা হয় না। এবং হবেও না। এ জগতে মানুষ জন্ম নিচ্ছে। আবার তাকে ম’রে, এ জগত থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। তাকে চিরতরে চ’লে যেতেই হচ্ছে। মানুষের জন্য জীবনটা যেমন সত্য, মৃত্যুটা বোধ করি তারও চেয়ে বেশি সত্য!
মানুষের আচরিত, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, প্রচলিত প্রতিটি ধর্মেই জীবন ও মৃত্যুর বিষয়ে রয়েছে সুনির্দিষ্ট মতবাদ। রয়েছে বিশ্বাসের ভিত। মানুষের মৃত্যুর পর  তার পুনর্জন্মেও বিশ্বাস করেন অনেকে। সেই মতবাদ ও বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধ’রেই মানুষ স্বচ্ছন্দ গতিতে তার আচরিত জীবনের পরিমণ্ডলে নিজেকে পরিচালিত ও পরিশীলিত করতে প্রয়াস পায়। মৃত্যু ও পরজীবন নিয়ে মানুষের রয়েছে জানার সীমাহীন আগ্রহ। তাই প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের বাইরেও আগ্রহী মানুষ পরজীবন নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। মৃত মানুষের আত্মার সাথে জীবিত মানুষের যোগাযোগ করার পুরনো পদ্ধতি ‘প্লানচেট’-এর কথাও আমরা শুনি। জীবৎকালে আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায় নাকি প্লানচেটের মাধ্যমে মৃত-আত্মার সাথে সংযোগ স্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন!    
তাই বলতেই হয়, এ জগত-সংসারের মায়া মানুষকে ছাড়তেই হয়।  এর কোন বিকল্প নেই। মানুষের এ জগতে যা কিছু আছে, ধনসম্পদ, প্রভাব, ক্ষমতা, অমর হয়ে বেঁচে থাকার আকুলতা, সমস্তকিছুকে দু’হাতে পিছনে ঠেলে, পরিবার, আত্মীয়স্বজনের আবেগ, ভালবাসাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তার পরমবন্ধু মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করতে হয়। মৃত্যুর হাতে নিজেকে সমর্পণ করতে হয়। সবশেষে মৃত্যুতেই তাকে স্থায়ীভাবে এবং চিরতরেই বিলীন হয়ে যেতে হয়। এটাই নিয়ত সত্য। এবং চূড়ান্ত সত্য।
মৃত্যু তো বিশ্বের অন্যান্য জীবের সাথে, আমাদের সকল মানুষের জন্য ধ্রুব সত্য। মৃত্যুর দ্বার পেরিয়ে পরলোকে প্রবেশ ক’রেও কিছু কিছু মানুষ নাকি আবার ফিরে এসেছেন ইহজগতে! অনেক প্রাজ্ঞ-মানুষ, মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণকারী অনেকের লব্ধ অভিজ্ঞতার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁদের লেখনীতে।
তো, ডঃ মরিস রলিংস ‘মৃত্যুর পরে ও আত্মার কথা’ গ্রন্থে মৃত্যুপরবর্তী অনেক বর্ণনা দিয়েছেন। ১৩৯৪ বঙ্গাব্দে কোলকাতা থেকে, এই গ্রন্থটি সম্পাদনা ও বাংলায় অনুবাদ করেছেন হীরালাল চক্রবর্তী। ডঃঃ মরিস রলিংস তাঁর এই গ্রন্থে অনেক মানুষের কথা লিখেছেন যারা তাঁদের কথিত ‘মৃত্যুর’ পর পুনরায় জীবন ফিরে পেয়েছেন এবং সবিস্তারে স্মরণীয় অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। 
ডঃঃ মরিস রলিংস লিখেছেন, ‘মৃত্যু দুই প্রকার। প্রথম হইতেছে ‘রীভারসীবল ডেথ’ ও দ্বিতীয় ‘ই-রীভারসীবল ডেথ’। উভ্য় ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ কিন্তু একই।’ তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কোন কারণে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও মস্তিস্ক অবিরাম সক্রিয় এই নিরলস-যন্ত্রগুলোর কোন একটি যদি থেমে যায় বা ক্রিয়া বন্ধ করতে বাধ্য হয় তাহলে মূল দেহ বা শরীরকে ‘মৃত’ ব’লে গণ্য করা হয়। তবে মূল শরীর ‘মৃত’ হ’লেও মৃত্যু পরবর্তী সময়ে, তার প্রতিটি সেল বা টিসু তখনও জীবিত থাকে। মাত্র দুই মিনিটের জন্য যদি অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় তবে, হার্ট, লাংস বা ব্রেণ তাদের কাজ বন্ধ করতে পারে। আর যদি চার মিনিটের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় তবে এই যন্ত্রগুলো স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায়। তিনি বলেছেন, ‘শরীরের এই অবস্থার নাম হইল রীভারসীবল ডেথ।’   
‘ই-রীভারসীবল ডেথ’ সম্পর্কে ডঃঃ মরিস রলিংস লিখেছেন, বহুক্ষণ অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ থাকলে সেল বা টিসুও মরে যায় এবং শরীরে পচন আরম্ভ হয়। এবং ‘রীভারসীবল ডেথ’ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘ইলেক্ট্রিক শক, হার্ট অ্যাটাক, জলডুবি অ্যাক্সিডেণ্টাল ডেথ বা গলায় দড়ি দিয়া আত্মহত্যা ইত্যাদিতে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় রীভারসীবল ডেথ হয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় এইরূপ রীভারসীবল ডেথ কেস লইয়া। ই-রীভারসীবল ডেথ হইতেও কেহ কেহ বাঁচিয়া গিয়াছে এইরূপ শুনা যায়, কিন্তু ঐগুলি নির্ভরযোগ্য নয় অথবা ঐগুলিকে মিরাকল বা অলৌকিক কাহিনী বলা যায়। Recorded History বা লিখিত নির্ভরযোগ্য কাহিনী বলিয়া ধরা যায় না।’
ডঃঃ মরিস রলিংস তাঁর ‘মৃত্যুর পরে ও আত্মার কথা’ গ্রন্থে রীভারসীবল ডেথ বা ‘প্রত্যাগমনযোগ্য মৃত্যু’ বরণকারী কয়েকজনের বর্ণিত অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন এ ভাবেঃ ‘বিভিন্ন হাসপাতালের করোনারী কেয়ার ইউনিটের রোগীদের সঙ্গিন অবস্থার চিকিৎসা করিতে অভিজ্ঞ ‘’কার্ডিওলজিস্ট’’ হিসাবে আমাকে দায়িত্ব লইয়া কাজ করিতে হইয়াছে। যাঁহারা ক্লিনিক্যালি ডেড বলিয়া গণ্য হইয়াছেন তাঁহাদেরও শরীরের উপর রিসাসীটেশন প্রক্রিয়া কৃত্রিম উপায়ে রক্ত সঞ্চালন ও শ্বাস-প্রশ্বাস চালন করায় কেহ কেহ বাঁচিয়া উঠিয়াছেন। যাঁহারা বাঁচিয়া উঠিয়াছেন তাঁহাদের মৃত সময়ের অভিজ্ঞতাগুলি বর্ণনা করিবার সময় আমি লক্ষ্য করিয়াছি যে, কেহ কেহ অতি মনোহর রোমাঞ্চকর বর্ণনা দেন, আবার কেহ কেহ অতি ভয়ঙ্কর অবস্থার কথাও বলেন। ইহাদের মধ্যে এক একটি কাহিনী এত ভয়ঙ্কর যে, তাহা শুনিয়া আমি নিজেই আতঙ্কিত হইয়া উঠি। - মৃত্যুর পরে ও আত্মার কথা—পৃষ্ঠাঃ ১।
‘বছর দশক পূর্বে একদিন সন্ধ্যাবেলায় যখন একজন মৃত ব্যক্তিকে চিকিৎসা করিতেছিলাম, সেই সময় সে বাঁচিয়া উঠিয়া বলিতে লাগিল যে, সে এতক্ষণ নরকে ছিল। সে ক্রমাগত বলিতে থাকে এবং আকুলভাবে অণুরোধ করিতে থাকে যেন পুনরায় তাহাকে নরকে যাইতে না হয়। সে ক্রমাগত একই অনুরোধ করিতে থাকে নরক হইতে তাহাকে বাহিরে আনিতে ও বাঁচাইয়া তুলিতে। তাহার বীভৎস ও  সাংঘাতিক আতঙ্কিত অবস্থা এতই অকৃত্রিম ও স্বাভাবিক ছিল যে, তাহা দেখিয়া আমি নিজেই আতংকিত হইয়া উঠি। ইহার পরে আরও কতকগুলি ঐরূপ ঘটনা আমাকে এতই বিচলিত ও অভিভূত করে যে, আর কাল বিলম্ব না করিয়া অতি সত্বর এই রিপোর্টগুলি পুস্তক আকারে সংকলন করিতে কৃতসংকল্প হই। এখন আমি নিশ্চিত হইয়াছি যে, মৃত্যুর পরেও জীবন আছে ও ইহার সবগুলিই মনোহর বা আনন্দদায়ক নয়।’ - মৃত্যুর পরে ও আত্মার কথা। [পৃষ্ঠাঃ২-৩]
‘একজন মৃত্যুপথযাত্রী মুর্চ্ছা যায় অথবা ধীরে ধীরে জ্ঞান হারায় কিন্তু তখনও তাহার শ্রবণশক্তি জাগ্রত থাকে এবং তাহার চিকিৎসকের শেষ জবাব শুনিতে পায়। তাহার পর সে আবিষ্কার করে যে, তাহার নিজের শরীর হইতে বাহিরে আসিয়াছে, কিন্তু এখনও তাহার আত্মা সেই ঘরের মধ্যেই রহিয়াছে এবং উপর দণ্ডায়মান লোকগুলির সহিত সর্বপ্রকার ক্রিয়াকলাপ করিতেছে। সে লক্ষ্য করে, তাহারই শরীরের উপর চিকিৎসকগণ রিসাসীটেশন করিতেছেন এবং কখনও কখনও অন্য কেহ তাহার দৃষ্টিপথে বাধা হওয়ায় তাহাকে এক জায়গা হইতে অন্য জায়গায় সরিয়া যাইতে হইতেছে। বা ছাদের সমান্তরালভাবে ভাসমান অবস্থায় থাকিয়া নীচে তাহারই শরীরের উপর কি হইতেছে তাহা অবলোকন করিতে থাকে। সে বুঝিতেই পারে না যে, সে মরিয়া গিয়াছে বা মৃত ব্যক্তিটি সে নিজেই, ইহা কিরূপে সম্ভব। সে খুবই মজা অনুভব করে এবং যে শরীর সে ত্যাগ করিয়া গিয়াছে, সেটি যে সে নিজেই ইহা উপলব্ধি করিয়া খুবই অবাক হয়।
ক্রমে ক্রমে এই অদ্ভুত অবস্থার সহিত অভ্যস্ত হইয়া সে জানিতে পারে যে, তাহার নূতন শরীর হইয়াছে এবং তাহার অনেক সূক্ষ্ম অনুভূতি আসিয়াছে। সে জানিতে পারে যে সে ভুত, প্রেত, বা ঐ জাতীয় কিছু নহে। সে অনুভব করিতে পারে, চিন্তা করিতে পারে, বা কথাও বলিতে পারে যাহা পূর্বেও পারিত। কিন্তু কিছু কিছু অতিরিক্ত ক্ষমতা এখন সে পাইয়াছে। তাহার গমনাগমনের ক্ষমতা সীমাহীন ও অপরের চিন্তা সে বুঝিতে পারে এবং চিন্তা বা ইচ্ছামাত্রই যে এক জায়গা হইতে অন্য জায়গায় নিমেষের মধ্যেই পৌঁছাইতে পারে এবং চিন্তামাত্রই সে যাহা কিছুও করিতে পারে। এই সময় সে অদ্ভুত শব্দ শুনিতে পায় ও অনুভব করে চতুর্দিকে দেয়ালবেষ্টিত অন্ধকারময় পথে সে চলিয়াছে। তাহার গতি দ্রুত ও মন্দ হইতে পারে, কখনও পাশের দেয়াল স্পর্শ করে না। নীচে পড়িয়া যাওয়ার জন্য ভীতও হয় না।’ - মৃত্যুর পরে ও আত্মার কথা- পৃষ্ঠাঃ ১৪।
ডঃঃ মরিস রলিংস আবার লিখেছেন, ‘Dr. Wiltse নিজেই একজন চিকিৎসক। নিজস্ব অভিজ্ঞতার কাহিনী পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করিয়াছেন। ফালমীনেটিং টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হইয়া তিনি ৪ ঘণ্টা যাবত পালসহীন ও ৩০ মিনিট কাল শ্বাসপ্রশ্বাসহীন অবস্থায় অচেতন হইয়া পড়িয়াছিলেন। এই ঘটনা ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর মাসের ‘ST. Lowis Medical and Surgical Journal’-এ ডাঃ রেইনস (Dr. Raynes) রিপোর্ট করিয়াছেন। তাঁহার চিকিৎসক ডাঃ এইচ,এস,রেইনস লক্ষ্য করেন তাঁহার হৃদস্পন্দন (Pulse) গত ৪ ঘণ্টা যাবত ছিল না এবং শ্বাসপ্রশ্বাসও গত ৩০ মিনিট কাল বন্ধ ছিল। তিনি মৃত বলিয়া ঘোষিত হইয়াছিলেন এবং ঐ অঞ্চলের চার্চবেলও ধ্বনিত হইয়াছিল যাহা কাহারও মৃত্যু হইলে বাজান হয়। ডাঃ উইলটস তাঁহার নিজস্ব ভাষায় নিজের মৃত্যু সম্বন্ধে নিম্নলিখিত বর্ণনা দিয়াছিলেন।’
‘আমি পুনরায় নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হইয়াছিলাম এবং আবিষ্কার করিলাম যে, আমি আমার শরীরের মধ্যেই আছি এবং এই শরীরের কোনও বিশেষত্ব নাই। আমি বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া এই প্রথমবার আবিষ্কার করিলাম (একজন চিকিৎসকের অনুসন্ধিৎসা লইয়া) যে, মৃত্যুর পরও আমার বডি-অ্যানাটমি (Body Anatomy) একই আছে। আমি মৃত্যুর পূর্বে যেই রূপ ছিলাম মৃত্যুর পরও সেই একই দেহ বিশিষ্ট মানুষই আছি। লোকে যাহাকে মৃত্যু বলে আমি সেই পরিপ্রেক্ষিতে মৃত হইয়াছি, কিন্তু শরীর বা অবয়ব একই আছে। আমি স্বচ্ছন্দে মনে করিতে পারি যা, জেলিফিশের যেই রূপ বর্ণ, আমার বর্ণও অনেকটা সেই রূপ।  আমি নীচে ও উপরে ক্রমাগত নড়িতে লাগিলাম। সোপ-বাবল যেইরূপ নলের মুখে লাগিয়া নড়িতে থাকে সেইরূপ, যতক্ষণ মূল শরীর হইতে বিচ্যূত না হইলাম। আমার শরীর অর্ধস্বচ্ছ, কিছুটা পাতলা নীল রঙের। যখন ঘর হইতে বাহির হইবার চেষ্টা করিলাম তখন আমার কনুই, যাঁহারা ঘরের দরজার সামনে ভীড় করিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন তাঁহাদেরই একজনের কনুইয়ের সহিত ধাক্কা লাগিল। আমি খুবই আশ্চর্য্যাম্বিত হইয়া গেলাম এই দেখিয়া যে, অপর ব্যক্তির হাত আমার কনুইয়ের ভিতর দিয়া বাহির হইয়া গেল (বাধাপ্রাপ্ত না হইয়া) আমার ছিন্নহস্তটি পুনরায় জুড়িয়া গেল, যেমন বায়ুর সহিত বায়ু সংলগ্ন হয়। আমি কোনও বেদনা অনুভব করিলাম না। আমি অতি সত্বর ঐ ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকাইলাম, জানিতে চেষ্টা করিলাম আমার হাতের সহিত উঁহার হাতের সংঘর্ষ, উনি জানিতে পারিয়াছেন কিনা। মুখ দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম উনি জানিতে পারেন নাই। উনি আমার পরিত্যক্ত মৃত শরীরের দিকে একদৃষ্টে তাকাইয়া রহিলেন। আমি উঁহাদের সহিত দৃষ্টি লক্ষ্য করিয়া উঁহারা যেই দিকে তাকাইয়া ছিলেন সেই দিকে লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম আমার নিজেরই মৃত শরীর। ইহা একইরূপে পড়িয়া আছে যাহা আমি বহু কষ্টে ডানদিকে ঈষৎ হেলাইয়া রাখিয়াছিলাম। হাত দুইটি বুকের উপর সংঘবদ্ধ অবস্থায় হেলান এবং পা দুইটিও একত্রিত। আমি পাংশুবর্ণ বিকৃত মুখের দিকে তাকাইয়া একটু অবাক হইয়াছিলাম। বেশ কয়েকজন লোক আমার মৃত শরীরের চারিদিকে দাঁড়াইয়াছিলেন, কেহ বা বসিয়াছিলেন। বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিয়াছিলাম দুইজন মহিলা আমার শরীরের দুই পাশে হাঁটু গাড়িয়া ক্রন্দন করিতেছিলেন। উঁহাদের মধ্যে একজন আমার স্ত্রী ও অন্যজন আমার ভগিনী।’
‘পরবর্তী জীবনের পরিবর্তন শিরোনামে’ লেখক ডঃঃ মরিস রলিংস লিখেছেন, ‘পরপারের জগত দেখিবার পর এক এক জনের জীবনের উদ্দেশ্য ও তাঁহার চরিত্রগত বিশ্বাস পরবর্তী জীবনে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনে। পরবর্তী জীবনে আমূল পরিবর্তন আসে। একজন ভুক্তভোগী প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ নিম্নে দেওয়া হইল। ‘আমি সব সময় মনে করিতাম অর্থ, ধন-দৌলত ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা জীবনের একটি অতি প্রয়োজনীয় বস্তু যতক্ষণ না ওপারের ডাক আসে। এখন বুঝিতে পারিতেছি ওগুলির আদৌ কোনও গুরুত্ব নাই। অপরের প্রতি প্রেম ও প্রীতি যাহা তুমি দেখাইয়াছ তাহারই স্মৃতি থাকিয়া যাইবে। পার্থিব বস্তুগুলি সবই নশ্বর। আমাদের বর্তমান জীবন পরবর্তী জীবনের তুলনায় কিছুই নহে। এখন আমি পুনরায় মারা যাইতে ভীত নহি। যাঁহারা মৃত্যুর নামে ভয় পায় তাঁহাদের কোনও কারণ আছে অথবা তাহাদের ওপারের জীবন সম্বন্ধে কোনও জ্ঞান নাই।’
- মৃত্যুর পরে ও আত্মার কথা - পৃষ্ঠাঃ ৩৭
‘নরকে গমন’ অধ্যায় লেখক লিখেছেন, ‘যাহারা দুঃখদায়ক বা কুৎসিত অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছে অর্থাৎ যাহারা নরক দর্শন করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছে তাহাদের একজন হইতে অন্যজনের বর্ণনা ভিন্ন, অপর পক্ষে যাহারা মনোহর অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া আসিয়াছে অর্থাৎ স্বর্গ পর্যন্ত গিয়া ফিরিয়া আসিয়াছে তাহাদের অভিজ্ঞতাগুলি প্রায় একই রকম। নীচে একটি নরক দর্শনের অভিজ্ঞতা লিখিত হইলঃ ‘প্যানক্রিয়াস ফুলিয়া যাওয়ায় আমি পেটে অসহ্য বেদনা ভোগ করিতেছিলাম। আমার ব্লাড-প্রেশার ক্রমশঃ কমিতে লাগিল অ আমার চৈতন্য ধীরে ধীরে হারাইতে থাকিল। ইহার জন্য চিকিৎসকগণ আমাকে ঔষধ প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। আমাকে বাঁচাইবার জন্য তাঁহারা আমার উপর কাজ করিতেছিলেন। ইতিমধ্যে আমি দেহ ছাড়িয়া দীর্ঘ টানেলের ভিতর দিয়া যাইতেছিলাম। আমি বিস্মিত হইতেছিলাম এই দেখিয়া যে আমার পা মাটিতে ঠেকিয়া নাই। অথবা শরীরের কোনও অংশ দেওয়ালের সহিত আঘাতপ্রাপ্ত হয় নাই। আমার মনে হয় আমি ভাসমান অবস্থায় অতি দ্রুত যাইতেছিলাম। ইহা পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ কোনও স্থান হইবে। ইহা একটি গুহা বা সুড়ঙ্গ হইতে পারে। চারিদিক হইতে চীৎকার ও হাহাকার ধ্বনি আসিতেছিল। মরা ও পচা বা ক্যানসার রোগীদের শরীর হইতে যেইরূপ শ্বাসরোধকারী গন্ধ নির্গত হয় সেইরূপ দুর্গন্ধে আমার শ্বাস বন্ধ হইয়া আসিতেছিল। এইবার আমার গতি ধীর হইয়া আসিল। আমি যাহা যাহা দেখিয়াছিলাম সব মনে করিতে পারি না। কিন্তু এইটুকু মনে করিতে পারি যে, এখানকার বাসিন্দা বা কোন কোন কর্মী আধা মানুষ। একজন অপর জনকে মুখ ভেঙ্গচাইতেছিল, উপহাস করিতেছিল এবং এমন এক ভাষায় কথাবার্তা বলিতেছিল যাহা আমি বুঝিতে পারিতেছিলাম না। যখন আপনি জিজ্ঞাসা করিলেন যে, পূর্ব পরিচিত কোনও লোককে দেখিয়াছি কিনা অথবা উজ্জ্বল আলোকরশ্মি দেখিয়াছি কিনা, আমার উত্তর হইল যে, আমি ঐ সব দেখি নাই। কিন্তু আমি যখন চীৎকার করিয়া বলিলাম, ‘...আমাকে উদ্ধার কর।’  তখন অতি উজ্জ্বল শুভ্র বসন পরিহিত এক বিরাট পুরুষকে দেখিয়াছিলাম। তিনি আমার দিকে তাকাইয়া ছিলেন এবং তাঁহার বাণী আমার নিকট পৌঁছাইয়াছিল। তিনি বলিলেন, ‘জীবনের ধারা পরিবর্তন কর।’ আমি মনে করিতে পারি না আমি কিভাবে ফিরিয়া আসিলাম। যেখানে হয়ত আরও অনেক কিছুই ঘটিয়াছিল যাহা আমি ঠিক মনে করিতে পারি না। হইতে পারে আমি মনে করিতে ভয় পাই অথবা ভুলিতে পারিলেই শান্তি।’ - মৃত্যুর পরে ও আত্মার কথা- পৃষ্ঠাঃ ৫২-৫৩।
অদৃশ্য শক্তি, দেবদূত এবং যমদূত  সম্বন্ধে ডঃ মরিস রলিংস লিখেছেন, ‘স্টিফেন বোর্ড (Light at the end of the Tunnel) ‘Eternity, July ’77.-P.P.1-3-17’ প্রবন্ধটিতে লিখেছেন, সব ঘটনায় দেবদূত (Angel of Light) দেখা যায় না। পরন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে মৃত্যুর দূত অথবা যমদূতকেও দেখা যায়। -মৃত্যুর পরে ও আত্মার কথা- পৃষ্ঠাঃ ৫৯।