‘ভালোবাসা জীবনের ফাউন্ডেশন’ - মন্ট্রিয়ল ফ্রেঞ্চ স্কুল বোর্ডের সাবেক কমিশনার খোকন মনিরুজ্জামান বলছিলেন সেটি। তাঁর বক্তব্যের সুরেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেকগুলো গ্রন্থপ্রণেতা, গবেষক, বাংলা একাডেমি পুরষ্কারপ্রাপ্ত লেখক তাজুল মোহাম্মদ বললেন, মেহের আফরোজ পান্নার দাম্পত্য জীবনের সেই অমর প্রেমের কথা। যা লেখিকা পান্নার বইয়ের প্রতিটি শব্দ-সুষমায় বিধৃত হয়েছে বলে তিনি অনুভব করেছেন। তাজুল মোহাম্মদ জানালেন, মেহের আফরোজ পান্না আর তাঁর স্বামী মান্জুরুল ইসলাম কৈশোর কিংবা যৌবনে ভালোবাসার যে আবীর ছড়িয়েছিলেন এর রূপ রঙের উজ্জ্বলতা কখনও ম্লান হয়নি। স্বামীকে নিয়ে মেহের আফরোজ পান্নার স্মৃতিচারনায় সে দিকটিই স্পষ্ট করে ওঠে এসেছে বইয়ে।
খোকন মনিরুজ্জামান বলেন, মান্জুর-পান্নার অবিরাম ভালোবাসার যে গল্প বাস্তবে ছিল এবং যা নির্মোহভাবে বইয়ে লিখিত হয়েছে সেটি শুধু উদাহরনীয়ই নয়, সুস্থির সমাজ রূপায়নের দিক নির্দেশিকাও।
মেহের আফরোজ পান্নার লেখা ‘সিদ্ধেশ্বরী গল্প’ ও ‘জীবনের বাঁকে বাঁকে’ বই দুটির মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাঁরা একথা বলেন। মন্ট্রিয়লের ক্যাফে রয়াল রেস্টুরেন্টে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় এটি অনুষ্ঠিত হয়। পুরো অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা, গ্রন্থনা ও সঞ্চালনায় ছিলেন নাজুল ইসলাম আব্দুল্লাহ।
এতে লেখিকা ও তাঁর বই দুটি নিয়ে আলোচনায় আরও অংশ নেন, নিউ ইয়র্ক থেকে আগত বিশিষ্ট লেখিকা লিজি রহমান, অণুজীববিজ্ঞানী, লেখক ড. শোয়েব সাঈদ, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস ড. সায়ীদ মঈন আহসান, কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এফিলিয়েটেড প্রফেসর ড. আদিত্য দেওয়ান, এরিকসন কানাডার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বর্তমানে দি ন্যাচারেল সায়েন্স এন্ড ইন্জিনিয়ারিং রিসার্চ কাউন্সিল অব কানাডা (NSERC)’র উপদেষ্টা তারিক রহমান, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, সংগঠক শামীমুল হাসান ও বিশিষ্ট সমাজকর্মি, লেখিকা শাহীন আখতার মনির।
আলোচকরা দুটি বইয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে যেমন আলোচনা করেন, তেমনি লেখিকার পরিবারের সাথে তাঁদের অন্তরঙ্গতা আর নানা ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন। অনেকে তাঁদের প্রবাস জীবন শুরুর কাহিনী এবং নানা চড়াই উৎরাই ও অতঃপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গল্প শোনান।
তারিক রহমান বলেন, জীবনে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পরিশ্রম, একাগ্রতা, অধ্যবসায়, ধৈর্য্য, সততা অপরিহার্য। তবে নেপথ্যে ভাগ্যও একটি বড় নিয়ামক বলে মনে করেন তিনি।
ড. সায়ীদ মঈন আহসান সাহিত্য, অর্থশাস্ত্র কিংবা বিজ্ঞান সুস্পষ্টভাবেই ভিন্ন বিষয় হলেও জীবনকে সমৃদ্ধ আর গতিময় করতে বিষয়গুলো একান্ত এবং একাত্ম হয়ে কাজ করে। লেখালেখির মাধ্যমে লেখকের চারপাশে যেমন এক সুন্দর ভূবন তৈরী হয়, তেমনি পাঠক সমাজকেও লেখক সেই আবহে আকৃষ্ট করে রাখতে সমর্থ হন।আনন্দ ভাগাভাগি হয়।
ড. শোয়েব সাঈদ বলেন, লেখিকা অত্যন্ত যুথসই ভাবে কিছু আঞ্চলিক অথবা অপ্রচলিত শব্দ তাঁর বইয়ে ব্যবহার করেছেন - যেটি শুধু বাংলা শব্দ ভান্ডার স্ফীত করণেই ভূমিকা রাখবে না, এই প্রক্রিয়াটি গ্রন্থবদ্ধতার একটি অতি উল্লেখ্য দিক।
লিজি রহমান লেখিকা মেহের আফরোজ পান্নার সাথে তাঁর অনেক আগের পরিচয় উল্লেখ করে বলেন, পান্নার লেখায় বাঙালির আটপৌরে জীবনের কথা শুধু নয়, এতে আছে ইউরোপ আমেরিকার জীবনযাত্রায় থিতু হওয়া আমাদের প্রথম প্রজন্মের প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তি সুখ দুঃখের কথাও। লেখালেখিতে মনোযোগী হওয়ার ব্যাপারে তাঁর ক্রমাগত উৎসাহদানের কথাও লিজি রহমান তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
ড. আদিত্য দেওয়ান বলেন, “মেহের আফরোজ পান্নার বইয়ে যা লিখা, সেটি শুধু লেখিকার নয়, আমাদের জীবনেরও গল্প”। তিনি বাংলাদেশে ও কানাডায় তাঁর শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন এবং মন্ট্রিয়লে স্থায়ী হওয়ার ইতিহাস জানিয়ে বলেন, প্রবাসীরা এখানে যতই শক্ত ভিত তৈরী করেন না কেনো মাতৃভূমির জন্যে তাদের প্রেম পরিমাপ করার মতো নয়।
শামীমুল হাসান লেখিকা মেহের আফরোজ পান্না ও তাঁর স্বামী মান্জুরুল ইসলামের সাথে তাঁর পরিবারের ঘনিষ্টতা ও আতিথেয়তার গল্প শোনান। লেখালেখি ও বই প্রকাশনায় মেহের আফরোজ পান্নার মনোযোগ তাঁকে খুব অভিভূত করেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এছাড়া, আলোচকরা বই দুটির মধ্যে লেখিকার যাপিত জীবনের সুখ দুঃখ, দেশপ্রেম, শৈশব থেকে বর্তমান নানা বিষয় খুব সহজ ও সাবলীল বর্ণনায় ওঠে এসেছে বলে উল্লেখ করেন। তাঁরা বলেন, লেখিকার দীর্ঘ প্রবাস জীবনের শুরুর নানা প্রতিকূলতা, সংগ্রাম এবং একসময় সেসব উতরে সফলতা, প্রতিষ্ঠা, সন্তানদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা, পারিবারিক সুখ, বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে আড্ডা, অনেকের নাম সহ নানা স্মৃতি বর্ণনা করা হয়েছে বই দুটিতে। তাঁরা আশা করেন মেহের আফরোজ পান্না লেখালেখি চালিয়ে যাবেন এবং ভবিষ্যতেও বই আকারে সেগুলো আসবে।