গভীর রাত। নবারুণের কাছে গ্রামের অন্ধকারকে আরও বেশি বুনো মনে হয়। ও আসছে বিয়ে করতে। পাকা রাস্তার পরে পুরো রাস্তা কাঁচা। শুধু কাঁচা বললে সবটা বলা হবে না। এবড়ো থেবড়ো, উচুঁনিচু। গরুর গাড়ি চলে রাস্তার এ অবস্থা। তার উপর রাত। রাস্তায় কোনো আলো নেই। গ্রামের রাস্তায় যে লেমপোস্ট থাকে না, এ ধারণা নবারুণের নেই। ও যদিও গ্রামের ছেলে কিন্তু বরাবর থেকেছে ঢাকা শহরে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সব ঢাকায়।
নবারুণ যে লিজাকে বিয়ে করতে আসছে সেটা লিজা জানে না। বিয়ে তো দূরের কথা, এভাবে হঠাৎ চলে আসবে সেটাই বলেনি। বলবে কী, ওতো বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছে, তাই লিজাকে কোনো কিছুই বলার সময় বা সুযোগ কোনোটা-ই পায়নি। ও শুধু ভেবেছে মনিরার হাত থেকে বাঁচতে হলে আজই ওকে বিয়ে করতে হবে। ও যখন সন্ধ্যায় মনিরাদের বাসা থেকে ওয়াল টপকে বড় রাস্তায় এসে একটা রিকসায় চড়ে বসে, তখন একটু নিশ্চিন্ত বোধ করে। হাফ ছেড়ে বাঁচে। বিকেল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত দম আটকা অবস্থায় ছিল। যেন বিনা অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামী। এখনই কালো কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে জল্লাদের মুখোমুখি হতে হবে।
হঠাৎ জানালা দিয়ে একটা চিরকুট এসে লিজার টেবিলে পড়ে। লিজা একটু ভয় পায়। কাগজটা ধরবে কি ধরবে না, কী লেখা আছে পড়বে কি পড়বে না। অবশেষে না খুলে পারল না, এতরাতে জানালা দিয়ে চিরকুট! নিশ্চয় প্রেম ট্রেমের চিঠি হবে। এসময় সতের বছরের মেয়ের পক্ষে নিজেকে দমিয়ে রাখা কঠিন। তাই আর দেরি না করে কাগজটা খুলে, মেলে ধরে চোখের সামনে। আর দেখা মাত্র চিৎকার দিয়ে ওঠে। নবারুণের চিঠি! নবারুণ এসেছে!
টেলিফোনে, ফেসবুকে ওদের পরিচয়। পরিচয়ের শুরুর দিকে লিজা বলেছিল, "মাঝেমাঝে তোমার চিঠি পাবো তো?"
নবারুণ হেসে বলেছিল, "এ যুগে কেউ চিঠি লেখে?"
"আমার খুব ইচ্ছে, আমাকে কেউ চিঠি লিখুক। আমি কারো চিঠির অপেক্ষায় থাকি।"
কথা রেখেছিলো নবারুণ। চিঠি আসতো লিজার কাছে খুব গোপনে। সে চিঠি শুরু হত 'স্নেহের লিজা ' দিয়ে, আর শেষ হত 'তোমারই নবারুণ ' দিয়ে। তখন 'স্নেহের' শব্দটার উপর খুব রাগ হত লিজার। ও কি খুব ছোট? লিজা ঠিকই "প্রিয় নবারুণ" বলে চিঠি শুরু করত।
লিজা ভেবেছিল তার চিৎকার শুনে পাশের রুমে ঘুমানো বাবা-মা জেগে উঠবেন। তারা ঘুমানোর আগে লিজাকে বলে গিয়েছিলেন, বেশি রাত করে না পড়তে। কিন্তু লিজা পড়া শেষ না করে উঠতে চায়নি।
ওর চিৎকার শুনে বাবা-মা কেউ ঘুম থেকে জাগেনি। ও সন্তর্পণে দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। নবারুণ একটু দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল, লিজাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে। ওর হাতে একটা পিঠ ব্যাগ। পরনে নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি, মাথার চুল এলোমেলো, চোখমুখ ভয়ার্ত ও মলিন। লিজার রুমের জানালা দিয়ে গলিয়ে আসা আলো থেকে এতটুকুই লিজা দেখতে পায়। এভাবে নবারুণকে দেখে একটা অজানা ভয় লিজার মধ্যে কাজ করে। একটু আগের টগবগ আনন্দ আর থাকে না। তবু কাছে যেয়ে নবারুণের হাত ধরে বলে, "কী হয়েছে তোমার, এভাবে না বলেকয়ে চলে এসেছ? আর তোমাকে দেখেও কেমন মনে হচ্ছে। একদম হুজুর সেজে এসেছ। তুমি তো কখনও পায়জামা পানজামি পরো না।" একটু থেমে, একটু হেঁসে, লিজা আবার বলে, "তুমি কি সাত সমুদ্র তের নদীর জল ভেঙে, বর সেজে আমাকে বিয়ে করতে এসেছ?"
লিজার রসিকতা যে নবারুণের মনের কথা কী ভাবে মিলে গেল, এটা ভেবে নবারুণ লিজাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা কাঁপা মুখে বলে,"ঠিক ধরেছ, আমি তোমাকে বিয়ে করতে এসেছি। আমি মনিরাদের বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি। ওরা আমাকে জোর করে অস্ত্রের মুখে মনিরার সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিল।"
একটু থেমে, পায়ের গোড়ালি থেকে মশা তারিয়ে নবারুণ আবার বলে,"মনিরা নিজেই ওর ভাইদের আমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। চল, তোমার রুমে যেয়ে বাকি সব কথা বলব।"
লিজা নবারুণের একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে বলে, "আমার কাছে যখন একবার চলে এসেছ, আর ভয় নেই। মনিরা তোমার কিছু করতে পারবে না। কিন্তু কে এই মনিরা? ওর কথা তো কোনো দিন বলোনি। আর শুনেছি ছেলেরা সুন্দরী মেয়েদের জোর করে অস্ত্রের মুখে বিয়ে করে। তোমার ক্ষেত্রে উল্টো। তোমার ভাগ্য তো ভালো বলতে হবে।" শেষ কথাটুকু বলে লিজা হা হা করে হেঁসে ওঠে।
ওর হাসির শব্দে পাসের রুম থেকে বাবা বলে ওঠেন, "ওখানে কে, কে কথা বলে?" বাবার কথা শুনে লিজা ভয়ে নবারুণের হাতটা দ্রুত ছেড়ে দেয়।