জীবনানন্দ-উত্তরকালের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬)। পঞ্চাশের দশকের কবি হিসেবে সুচিহ্নিত হলেও, ১৯৪৮ সালে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতার নাম ‘উনিশশো ঊনপঞ্চাশ’। মাত্র ১৯ বছর বয়সে নলিনী কিশোর গুহ সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক সোনার বাংলা’য় এটি ছাপা হয়। শুধু তাই নয়, ১৯৬০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশের আগেই কবি হিসেবে তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ‘রূপালি স্নান’। তিনি সর্বমোট ৬৭টি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। এগুলো শিল্প ও সময়ের মানদণ্ডে পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে। কারণ তাঁর কবিতা বিষয়-বৈচিত্র্য ও শৈলীর স্বকীয়তায় অনন্য। বক্ষ্যমাণ লেখায় শামসুর রাহমানের প্রথম পর্যায়ের ৪টি কাব্যগ্রন্থ– ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ (১৯৬০), ‘রৌদ্র করোটিতে’ (১৯৬৩), ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ (১৯৬৭) ও ‘নিরালোকে দিব্যরথ’ (১৯৬৮) সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়াস পাব। কোনো কোনো সমালোচক এই চারটি কাব্যগ্রন্থকে তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে অভিহিত করেছেন।
শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঘোষিত হয় সম্ভাবনাময় নতুন কবির আগমনী বার্তা। এই গ্রন্থের প্রকাশ তৎকালীন বাংলা ভাষার কাব্যভুবনে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অবশ্য এই বিবেচনার নেপথ্যে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। বিশ শতকের চল্লিশের দশকের কবিরা যখন ইসলামী ও প্রগতিবাদী দুটি ধারায় বিভক্ত, তখন বাংলা কবিতার চিরায়ত ধারা কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কবিতার বদলে মতাদর্শকেন্দ্রিক জিজ্ঞাসা প্রধান হয়ে ওঠে। পঞ্চাশের দশকের কবি শামসুর রাহমান সেই বিভাজনের প্রচল ধারা থেকে কবিতাকে মুক্ত করেন। তিনি পূর্ববাংলার নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির যাপিতজীবন ও রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামকে কবিতার প্রধান বিষয় হিসেবে বেছে নেন। এই প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য– “১৯৬০ সাল বাঙালি মুসলমানের আধুনিক হয়ে ওঠার বছর, তাদের কবিতার আয়ত্তের বছর। তিরিশি কবিতাস্রোতের সঙ্গে ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’র সাহায্যে বাংলাদেশকে দৃঢ় সংযুক্ত করেন শামসুর রাহমান। আধুনিক জীবন ও কাব্য-চেতনার এমন ব্যাপক-প্রবল-গভীর প্রকাশ গোচরে আসে না শামসুর রাহমান– পূর্ব কোনো বাংলাদেশীয় কবির কবিতায়।… ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ বাংলাদেশীয় কবিতার ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল উচ্চস্তম্ভ।” (‘আদিম দেবতারা ও সন্ততিরা’– হুমায়ুন আজাদ/নির্জনতা থেকে জনারণ্যে: শামসুর রাহমান/সম্পাদনা– ভুঁইয়া ইকবাল)
কাব্যচর্চার সূচনাপর্বে শামসুর রাহমান রোমান্টিকতায় অধিক সমর্পিত ছিলেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’-এর কবিতাগুলোয় সেটা আভাসিত হয়। এখানে তিনি কিছুটা আত্মমগ্ন, স্মৃতিকাতর, স্বপ্নচারী ও ব্যক্তিগত অন্তর্দ্বন্দ্বে আচ্ছন্ন। যেমন– ‘তুমি আসবে না/নিঃশব্দে নিঃসঙ্গ এই চেনা/বাগানের দরজা খুলে ফাল্গুনের বিহ্বল দুপুরে/বাগানের দরজা খুলে ফাল্গুনের বিহ্বল সিঁড়ির নির্জন বাঁক ঘুরে/এসে শিশিরের মতো স্বেদকণা মুছে মিহি রুমালে, হাওয়ায়/প্রীত তুমি মৃদু টোকা দিবে না দরজায়;/গানের গুঞ্জনে আর উঠবে না ভরে/দক্ষিণের শূন্য ঘর প্রহরে প্রহরে।’ (জর্নাল, শ্রাবণ ১/ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’)
পরবর্তী সময়ে শামসুর রাহমান তিরিশের দশকের কবিদের কবিতা ও কাব্যচিন্তাকে আত্তীকরণের মাধ্যমে নিজস্ব কাব্যভুবন তৈরি করতে সক্ষম হন। এ প্রসঙ্গে ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ কাব্যের ‘আত্মজৈবনিক’ কবিতায় তিনি লিখেছেন– ‘স্মরণের আঠা দিয়ে হতাশ প্রেমের জলছবি/সেঁটেছি সত্তার ফ্রেমে। মধ্যপথে কেড়েছেন মন/রবীন্দ্রঠাকুর নন, সম্মিলিত তিরিশের কবি।’ মূলত কবির ব্যক্তিগত বোধ সমকালীন নানা ঘটনার অভিঘাতে কবিতায় রূপ নিয়েছে। তাঁর কবিতার প্রধান অঞ্চলজুড়ে আমরা যে নাগরিক জীবনের সন্ধান পাই, প্রথম পর্যায়ের কবিতাগুলোয় তার স্ফুরণ ঘটেছে। নগরচেতনা তাঁর কবিতার কুললক্ষণ। একজন একনিষ্ঠ কবি হিসেবে তিনি নগরচেতনাকে বিধিলিপি হিসেবে মেনে নিয়েছেন। নগরজীবনের সুনিপুণ ছবি তাঁর কবিতার উপমা, চিত্রকল্প কিংবা রূপকে দৃশ্যমান হয়। যেমন– ‘শহর জেগেছে, দূরে ঘণ্টায় প্রাণের ধ্বনি/রোগীর শরীরে নামলো নিদ্রা হাসপাতালে,/যারা কোনোদিন ভুলেও পেলো না আপনজন,/ছেঁড়াছোঁড়া সেই ক’জন রাতের জুয়ো শেষের/ক্লান্তিতে ফের ভিড়লো ধোঁয়াটে রেস্তোরাঁয়।/আস্তাবলের সহিস ঘোড়ার পিঠ বুলোয়,/শীতের শুকনো ডালের মতোই ভিস্তি বুড়ো কেঁপে কেঁপে তার জল-মসৃণ মশক বয়।’ (আত্মজীবনীর খসড়া/প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে)উল্লিখিত কবিতায়– শহর, আস্তাবলের সহিস, ঘোড়া, শহরের ধোঁয়াটে রেস্তোরাঁ, ভিস্তি বুড়ো, মশক ইত্যাদি নাগরিক অনুষঙ্গের উল্লেখ রয়েছে। অবশ্য দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রৌদ্র করোটিতে’ তিনি নাগরিক, বিশেষত ঢাকা নগরীর কবি হিসেবে প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ইংরেজি ও আমেরিকান সাহিত্যে ডব্লিউ বি ইয়েটস, টি এস এলিয়ট ও এজরা পাউন্ড কিংবা ফরাসি সাহিত্যে বোদলেয়ার, ভের্লেন, মালার্মে প্রমুখ প্রতীকবাদী কবি শামসুর রাহমানের কাব্যচর্চায় প্রেরণা জোগালেও তিনি স্বদেশের শিকড়ে সংলগ্ন থেকেছেন। তাঁর কবিতায় পুরান ঢাকার চিরচেনা রূপ অসাধারণ কাব্যভাষায় বাঙ্ময় হয়েছে। ‘রৌদ্র করোটিতে’, ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ ও ‘নিরালোকে দিব্যরথ’ থেকে প্রাসঙ্গিক কিছু পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করা যেতে পারে। ক. ‘উন্মত্ত বালক তার মাউথ অর্গানে দুপুরকে/চমকে দিয়ে সন্দেহপ্রবণ কিছু মানুষ ব্যতীত/দালান পুলিশ গাড়ি চকিত কুকুর অ্যাসফল্ট/রেস্তোরাঁকে বানাল দর্শক। ট্রাফিক সিগনালের/সবুজ বাতিটা ফের নতুন আশার মতো ঝলমল জ্বলে/কয়েকটি সম্ভ্রান্ত মোটর পাশাপাশি/হঠাৎ হরিণ হতে চেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে বুঝি/রোদচেরা সুরের গমকে।’ (দুপুরে মাউথ অর্গান/রৌদ্র করোটিতে) খ. ‘এ শহরে চতুর্দিকে ভিড়, চতুর্দিকে/বামনেরা জটলা পাকায়/এবং চাঁদের নখ উপড়ে আনবে ভেবে তারা/গুটিয়ে জোব্বার হাতা এলাহি রগড় করে শেষে/থুথু ছুড়ে দেয়/আকাশের মুখে।’ (বামনের দেশে/বিধ্বস্ত নীলিমা) গ. ‘শহরের শেষ প্রান্তে ফ্যাক্টরির চোঙ, ঝিল্লিস্বর,/সমস্ত পিছনে ফেলে পা বাড়ালে দূরে/বুদ্ধের কাঠের মূর্তি, ফ্রেমে আঁটা ছবি’ (এ-শহর ঢাকাতেই নিরালোকে দিব্যরথ)।
সমঝদার পাঠক মূলত ‘রৌদ্র করোটিতে’ শামসুর রাহমানের মৌলিক অভিযাত্রা খেয়াল করে থাকবেন। এই গ্রন্থে তাঁর কবিতা আত্মমগ্নতার খোলস ছেড়ে জীবনের সামগ্রিকতার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কারণ তিনি ব্যক্তি থেকে সামষ্টিক বোধে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’য় নিজের ভাবনার জগৎকে যেন আরও প্রসারিত করার সুযোগ পান। এখন তিনি আরও বেশি সমকাল সংলগ্ন ও কালসচেতন। প্রসঙ্গক্রমে এই পর্বের কিছু কবিতার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে পাঠক তাঁর স্বতন্ত্র কাব্যস্বরের ইঙ্গিত পাবেন। যেমন– ‘রূপালি স্নান’, ‘মনে মনে’, ‘আত্মজীবনীর খসড়া’, ‘কাব্যতত্ত্ব’, ‘একান্ত গোলাপে’, ‘দুঃখ’, ‘ছুঁচোর কেত্তন’, ‘আত্মহত্যার আগে’, ‘কখনো আমার মাকে’, ‘টেলেমেকাস’, ‘মেঘের নীল ইজিচেয়ার’, ‘শবাহারী কীটের কোরাস’, ‘পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জ’, ‘মেষতন্ত্র’, ‘পিতলের বক’, ‘কবিতার অন্তঃপুরে’ ইত্যাদি।
সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের অভিঘাতে শামসুর রাহমানের নাগরিকবোধেও যুগযন্ত্রণা বিযুক্ত হয়। তিনি উপলব্ধি করেন সময়ের দায়বদ্ধতা। দেশ ও মানুষের কল্যাণে কবিতায় উচ্চারিত হয় বাস্তব ভুবনের আখ্যান। কারণ এই চারটি কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৬ সালের সময়সীমার মধ্যে রচিত। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রৌদ্র করোটিতে’ এসে তিনি মনোলোক থেকে বহির্বিশ্বে বেরিয়ে আসেন। এ প্রসঙ্গে শামসুর রাহমানের অকপট স্বীকারোক্তি– ‘কাব্যক্ষেত্রে পদার্পণের পর কিছুকাল কবিতার ত্রিসীমায় দরিদ্র সাধারণ জনের কোনো সমস্যা, বাস্তবের ছায়াকে ঘেঁষতে দিইনি। কিন্তু কিছুকাল পর সমাজের অস্থিরতা, নানা সমস্যা আমার কবিসত্তার ঘাড় ধরে বাস্তবতার মুখোমুখি নিয়ে এলো। বুঝতে আমার অসুবিধা হলো না যে, শুধু কল্পনার মায়াজালে আটকে থাকলে চলবে না, কল্পনার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবের কাছেও হাত পাততে হবে কবিতার সারবত্তা অর্জনের উদ্দেশ্যে।’ (কালের ধুলোয় লেখা, পৃষ্ঠা ২২৫)
সর্বোপরি, শামসুর রাহমানের দীর্ঘ কাব্যযাত্রায় প্রথম পর্যায়ের চারটি কাব্যগ্রন্থ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কবিতায় বিষয় ও শৈলীগত যে স্বাতন্ত্র্য, সেটা এই পর্যায়ের কবিতাগ্রন্থে প্রবলভাবে উপস্থিত। এই সময়ে লেখা কবিতাগুলোর ভাববস্তুতে পুষ্ট হতে থাকে সামাজিক দায়বদ্ধতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদী অঙ্গীকার ও নাগরিক অনুষঙ্গ। রোমান্টিক কবিমানস নিয়ে বাংলা কবিতায় তাঁর দীপ্ত যাত্রা হলেও, বিকাশের নানা স্তর পেরিয়ে কবিতাকে তিনি যুগপৎ শিল্প ও সমাজের শীর্ষ সোপানে নিয়ে এসেছেন।