কচি সবুজ লাউয়ের ডগার মতো অবুজ আমার মন। কোমলতা মিলিয়ে থাকে আলতো করে। বাঁধাহীন উড়ন্তপনায় সামনে মাচা না পেয়ে যে কোনো ডালকে আকড়ে ধরে। সে ডাল ভার বহন করতে পারবে কি পারবে না তা বিবেচ্য নয়। একদিন বৈরি সময়ে সে ডাল ন্যুয়ে পড়ে। লাউয়ের ডগা আলগোছে ঝুলে থাকে, হাওয়ায় এপাশ-ওপাশ করে। সুঁতোর ন্যায় চিকন হাত প্রসারতি হয় শূন্যে। একসময় বন্ধু হয় কোন এক কঞ্চি অথবা সবুজ ঘাস। জীবনে বন্ধু নামক মাচা না মিললে সবুজ ঘাসের গালিচা হয় আশ্রয়। জীবন সাজতে থাকে প্রকৃতির পরম সান্নিধ্যে।
আমার ছেলেবেলা। বয়স সাত কি আট। বাংলা সিনেমা দেখে দেখে আমার বড় হওয়া। খুব ইচ্ছা হতো, সিনেমার মতো কেউ আমার বন্ধু হোক। পরম বন্ধু, নির্লোভ। সিনেমার মতো হলো না। কারণ পড়াচোর আমি খেলা প্রিয় মানুষ। স্কুলের চেয়ে খেলার মাঠে পুরোদিন না খেয়ে কাটিয়ে দিতাম। কোনো বিশেষ কারণে কেউ আমাকে বন্ধু ভাববে এমনটাও নয়। স্বভাবতই খুব বন্ধুপ্রিয় মানুষটাই থাকে বন্ধুহীন।
বাড়ি থেকে প্রায় তিনক্রোশ দূরে আমার স্কুল। জায়গাটির নাম মনোহর, মানে অতি সুন্দর। যেহেতু মনোহর নামক স্থানে মানুষের বাস, তাই ‘পুর’ যুক্ত করা। প্রকৃত অর্থে গ্রামের নাম মনোহরপুর এর ইতিকথা জানা যায়নি। চম্পক নগরের বনিক চাঁদ সওদাগরের নামে নামকরণ হওয়া জেলার এ গ্রামটি আমার সনাতন পৈত্রিক নিবাস। দাদা চলে এলেন তিনক্রোশ পশ্চিমের গ্রাম বড় হায়াতপুর। এ নিয়ে খুব দুঃখবোধ আমার। মনোহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই আমার বাড়ি। অথচ দাদা, বাপ-চাচাদের নিয়ে চলে এলেন দূরের গ্রামে। সেখান থেকে স্কুলে যাওয়া আমার ছোটছোট পা খুব ক্লান্ত আর বিরক্ত। ভাই-বোনদের স্কুলে যাওয়া আমাকেও অনুগত হতে বাধ্য করে।
স্কুলে আসা-যাওয়ার মাঝেই একজনকে বন্ধু ভাবতে শুরু করি। নাম তারেক। দেখতে ঠিক আমার ছেলের মতো। মাটি রঙ। মিহি-কোমল। ছোট্ট জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাপ্তিগুলো ভাগবাটোয়ারা করি তার সাথে। আমি গর্বের সাথে বলতে থাকি আমারও বন্ধু আছে। তারেকের বাড়িটা আমার চেনা হয়ে ওঠেনি। স্কুলের পাশে পোস্ট অফিস। লাগুয়া যে দোকান, যেখানে হরেক রকম স্বপ্ন সাজানো থাকে। চকলেট, বাতাসা, সন্দেশ, কুরকুরি, বুট, বাদাম, চানাচুর আরও কতো কি, কয়েক প্রকার খেলনাও ঝুলে থাকে মাথার উপর। ওসবের চেয়ে পোস্ট অফিসেই আমার মনোযোগ বেশি থাকে। প্রবাসী বাবার চিঠির অপেক্ষা। আমার আসা-যাওয়ায় পিওন কাকা ভালো করেই চিনে রাখে। সোলাইমান বাবার নাম তাও তার মুখস্ত।
তারেকের সাথে আমার স্কুলেই কথা, একসাথে ক্লাসের টেবিলে বসা, গল্প করা, স্কুল মাঠে দৌড়াদৌড়ি। সবার সাথে তারেককে আমার বন্ধু বলে সম্মোধন করি। এতে তার হ্যাঁ বা নাবোধক কোনো ইঙ্গিত নেই। একদিন কঠিন পরীক্ষায় পড়তো হলে আমাকে। রূঢ় বাস্তবতা। এক সহপাঠীর সাথে যখন আমি আমার বন্ধুকে নিয়ে গল্প করছি, সেদিন তারেক স্কুলে আসেনি। সহপাঠী আমার বন্ধুত্বকে বিশ্বাস করলো না। সে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো। আমি বললাম, কাল তোকে প্রমাণ করে দিবো।
পরদিন সহপাঠী ও তারেক একসাথে দাঁড়িয়ে। আমি এলাম। সহপাঠী তারেকের কাছে জানতে চাইলো, পলাশ কি তোর বন্ধু?
তারেক বললো, একসাথে চললেই কি বন্ধু হয় নাকি? আমার কোনো বন্ধু নাই। আমার কচি মনে খুব আঘাত পায়। ভেবেছি তারেক বুক চওড়া করে বলবে, হ্যাঁ পলাশ আমার বন্ধু। আমার সে ভাবনা মাটি হলো। মুসড়ে পড়লো আমার বুক। কিছু সময় ভেবে দেখি, আসলেই তো একসাথে চললেই তো বন্ধু হয় না। বন্ধু হতে হলে চিন্তা ভাবনা আর স্বপ্নের মিল থাকতে হয়। সাথে
সামর্থ্য, সামাজিক অবস্থান। জীবনে প্রথম আঘাত পেলাম সেদিন। হৃদয়ে কষ্ট অনুভব হলো। খুব অপমানবোধও। সেদিন স্কুল থেকে পালিয়ে বাড়ি চলে আসি। মনটাকে খারাপ হতে দেই নি। কীভাবে যেন বিষণ্ণ মন, স্বাভাবিক হলো মনে নেই। তবে সেদিনের পর কয়েকদিন স্কুলে যাই নি। পরে জানতে পারি তারেক তার পুরো পরিবার নিয়ে দূরের কোথায় যেন চলে গেছে।
আমি চেতনে অবচেতনে তার ঠিকানা বের করার চেষ্টা করি। পরিনি। আজো পাইনি। মনে মনে গোপনে তাকে আমি র্নিলজ্জের মতো স্মরণ করি। কেন জানি না। তার প্রতি আমার কোনো চাওয়া নেই, পাওয়া নেই, কোনো স্বার্থ নেই, তবুও তাকে আমি খুঁজি। হৃদয় দিয়ে খুঁজেফিরি।
ক্লাস থ্রি থেকে ফোর। ক্লাসমেট আহসানকে বন্ধু ভাবা শুরু করলাম। কারণ স্কুলের পাশেই তার বাড়ি। বাড়িটা অনেক বড়। অনেক গাছগাছালি। এরমধ্যে তেঁতুল গাছও আছে। তেঁতুল আমার প্রিয় ফলের একটিও। পুরুষ মানুষের তেঁতুল প্রিয় হয়, এমন কিঞ্চিত মানুষের মধ্যে আমিও একজন। কিন্তু আহসানও আমাকে বন্ধু ভাবলো না। আমাকে এড়িয়ে গেল। আমি আরেক দফা কষ্ট পাই।
ক্লাস ফাইভে উঠে বৃত্তি পরীক্ষা দিবো। স্কুলে কোচিং হচ্ছে। কথায় কথায় মিতু নামে একটি হিন্দু মেয়ের সাথে খুব সখ্য গড়ে উঠে। তার সাথে আমার কথা বলতে ভালো লাগে। ক্লাসের ফাঁকে সুযোগ হলেই কথা বলি। তখন কী কথা হতো মনে নেই। এক পূজায় আমার জন্য মিতু সন্দেশ এনেছিল। মেয়ে তাই মিতুকে আমার বন্ধু ভাবতে পারিনি। অথচ মিতুর সাথে আমার চমৎকার সময় কেটেছে। মিতুকে খুব মিস করি। ওদের সাথে আমার সকল স্মৃতি প্রায় বিস্তৃতি। কিন্তু নামগুলো এখনো বুকের ভেতর যতন করি। এতো চমৎকারভাবে লালন করি যে, পৃথিবীর এমন কোনো ভাষা নেই যে প্রকাশ করতে পারি। বাংলা বর্ণমালা এ বেলায় যেন অচল। প্রাথমিকের গণ্ডিটা তো ওদের কারণে সমৃদ্ধ দুখে কিংবা সুখে।
আমার এ লেখা তোদের চোখে পড়বে কি না জানি না। তবে তোদের জন্য আমার হৃদয়টা হুহু করে ওঠে। যখনই মনে হয়, আমি কাতর হই। আপ্লুত হই খুব করে। তোদের সেই মুখ ভেবে ভেবে মিশে যাই রোদ্দুর। যদিও প্রিয়মুখগুলো এখন আবছাআবছা। ভালো থাকিস। যদি কখনো দেখা হয়ে যায়, জানি না, আমি কী বলবো বা কী করবো? তবে জেনে রাখিস, আমি তোদের খুব ভালোবাসি। কারণ তোরা আমার ছোট্ট হৃদয়ের প্রথম অনুভূতি।