আবু আফজাল সালেহের কবিতা

স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ

সাহিত্য ডেস্ক
  ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ২১:৪৭

যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকেরা জগজ্জীবনের রহস্য-আবরণ উন্মোচন করে যে অনির্বচনীয় আনন্দ, রসানুভূতি আস্বাদন করে সাহিত্য তারই প্রকাশ। কবি-সাহিত্যিকগণ হচ্ছেন সভ্যতার অগ্রদূত। কালপ্রবাহে ব্যক্তি বিলীন হয়ে যায় কিন্তু সাহিত্যের সৃষ্টি বেঁচে থাকে। সাহিত্যকর্ম জাতির চেতনার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত না থাকলে কোনো সাহিত্যই সেই জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রকৃতরূপে স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে না। দেশের ইতিহাস, সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি ও ঐতিহ্যকে সামনে রেখে লেখককে এগিয়ে যেতে হয়। যারা দেশ সম্পর্কে না জেনে লেখালিখি করেন, তাদের অস্তিত্ব ক্রমে মহাকালের গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
কবি-সাহিত্যিকগণ অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে নির্মাণ করেন তার সৃষ্টিকর্ম। কালের রক্তচক্ষু, অবহেলা ও ব্যক্তি সমালোচনার গ্রাস এড়িয়ে ঋজু পথে হাঁটছেন কবি ও প্রাবন্ধিক আবু আফজাল সালেহ। তিনি ইতোমধ্যে কবিতা, প্রবন্ধ, কলাম লেখার মাধ্যমে পাঠকমহলে আত্মপরিচয় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। লেখালিখি হচ্ছে কল্পনা আশ্রিত কুমার শিল্প, যার কল্পনা শক্তি যত বেশি, যার সময়ের স্বল্পতায় লেখালিখির প্রতি যত্ন বেশি, তার লেখা ততটা উজ্জ্বল। কবি-সাহিত্যিকেরা সাহিত্যের মধ্যে মুক্তির বাণী শুনতে পান। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে মানুষ জগৎকে চিনে ও জানে এবং সৎ-সাহিত্য আমাদের উপলব্ধি শেখায়, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের বিচারে সহযোগিতা করে আমাদের প্রকৃত ও কল্যাণের পথে চালিত করে।
সাহিত্যের মাধ্যমে একদিকে যেমন আমরা জ্ঞান আহরণের সুযোগ পাই; তেমনই অন্যদিকে নানা অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়ে মানববিজ্ঞানের বিচিত্র ভাবনাকে প্রকাশ করি। যারা সাহিত্য সৃষ্টি করেন, তাদের সৃষ্টির মূলে রয়েছে একাগ্রতা, ধ্যান, অবিচলিত নিষ্ঠা, একান্ত বিশ্বাস এবং দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। প্রাকৃতিক কোনো বস্তুকে একজন সাহিত্যিক যখন মূর্ত করে তোলেন; তখন তা সুন্দর হয়ে ওঠে। সাহিত্যের একজন পাঠক হিসেবে কবি ও প্রাবন্ধিক আবু আফজাল সালেহের লেখা বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় যখন প্রকাশিত হয়, তা আমার চোখ এড়াতে পারে না। আমার দৃষ্টিতে একজন প্রাবন্ধিক আবু আফজাল সালেহের চেয়ে কবি আবু আফজাল সালেহ অনেকদূর এগিয়ে। ‘কবিতা যতটা পাঠের বিষয় নয়, তার চেয়ে বেশি অধ্যয়ন, অনুভব ও উপলব্ধির বিষয়। কেননা কবিতা হচ্ছে কবির আত্মকথন, নিভৃতে নিজের সঙ্গে নিজের আলাপচারিতা, সেইসূত্রে তাঁর জ্ঞাত ও অজ্ঞাতলোক নিয়ে পরিপার্শ্বের কাছে তাঁর আত্ম ও ব্যক্তি স্বরূপের উন্মোচন, উদ্ঘানটও বটে।’
বাহ্যজগতের আলোড়ন, স্বচ্ছ অভিজ্ঞতা অন্তর্গত তাড়নার সংরাগে মিশ্রিত হয়ে কবির হৃদয়াবেগ যখন সুতীব্র অনুভূতির ব্যঞ্জনায় ও অনিবার্য শব্দদ্যোতনায় অপূর্ব ভাষা বা বাণীশিল্পে রূপ লাভ করে, তখনই বস্তুত জন্ম হয় কবিতার। কবি আবু আফজাল সালেহ তার ‘তারার ঘাট’ কবিতায় লিখেছেন, ‘গহীন রাতে ফেনা- ধোওয়া আঁচলে/ বসে বসে নক্ষত্রের গান শুনছি/ নীল সাগরে ভেসে বেড়ায় চাঁদের কণ্ঠ/ শিশিরে মাখে সুর।’ একজন কবি কতটা কল্পনা শক্তির আশ্রয় নিলে বসে বসে নক্ষত্রের গান শুনতে পান কিংবা সাগর জলে চাঁদের কণ্ঠ ভেসে বেড়াতে দেখেন। যে কোনো সময়ের যে কোনো জগতের বিশেষ মুহূর্তে কোনো এক বিশেষ আঁধারে অন্তঃপ্রবেশ লাভ করে যখন চিত্রস্তনিত ধ্বনির পবিত্র মর্মস্পর্শিতায় ফুটে উঠতে থাকে; তখন বুঝতে হবে, সে আঁধার সক্রিয় কবিমন- কবিতা সৃষ্টি হচ্ছে।
‘পতাকা, আমাদের গৌরব’ কবিতায় কবি লিখেছেন, ‘একটি পতাকার কাছে আমরা ঋণী/ যুদ্ধ খুন, লুট, নারীত্ব বির্সজনে/ -এ পতাকা/ লাল-সবুজ আমাদের-গৌরব।’ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তচেতনার সাথে সংশ্লিষ্ট আমাদের বাংলা সাহিত্য। সেই চেতনায় গড়ে উঠেছে আমাদের জাতির ইতিহাস, পটভূমি, জীবনচর্চা, ভাষা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। বাঙালির জীবনধারা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার রূপ সন্ধানের প্রচেষ্টায় একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। একজন কবি তা কখনো এড়িয়ে যেতে পারেন না। কবি আবু আফজাল সালেহও তা পারেননি। সেদিন বীর বাঙালি হাজার বছরের লালিত সৃষ্টিশীলতার তুঙ্গীয় নিদর্শন ও বহুমাত্রিক প্রতিভার সুদীপ্ত উপস্থিতিতে সশস্ত্র বিপ্লব-সংগ্রামে অনেক কিছু বিসর্জনের মধ্য দিয়ে ছিনিয়ে আনে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য, একটি লাল-সবুজের পতাকা। কবি তার কবিতায় মুক্তিযুদ্ধকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ‘পতাকা, আমাদের গৌরব’ কবিতায়।
একজন শক্তিমান কবি হওয়ার জন্য একজন কবির যেসব গুণাবলি থাকা দরকার; আবু আফজাল সালেহের মধ্যে তা রয়েছে। কবি সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়চেতনার মধ্য দিয়ে মননে-মানসে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ, উজ্জ্বল, দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যাবেন কবিতা আস্বাদনে।