বিএনপি তাহলে এক দফার আন্দোলনে গেল

সোহরাব হাসান
  ৩১ মে ২০২৫, ১১:৪৭


দেশের শাসনক্ষমতায় অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু ঢাকা শহরের সড়কের শাসন করে কখনো বিএনপি, কখনো জাতীয় নাগরিক পার্টি, কখনো জামায়াতে ইসলামী কিংবা অন্য কোনো দল। 
গত বুধবার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে তারুণ্যের সমাবেশে ১৫ লাখ লোকসমাগমের ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু সাপ্তাহিক কর্মদিবসে ১৫ লাখ লোকসমাগম যে আরও কত লাখ লোকের অবর্ণনীয় ভোগান্তি ডেকে আনতে পারে, সেটা তাদের মাথায় ছিল বলে মনে হয় না। তারা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ কিংবা প্যারেড গ্রাউন্ডেও তারুণ্যের সমাবেশটি করতে পারত। তাতে নগরবাসীর দুর্ভোগ অনেক কম হতো। 
এ বিষয়ে বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি কৈফিয়তের সুরে বললেন, তাঁরা ডিএমপিকে ১৫ লাখ লোকের উপস্থিতির কথা জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো বিকল্প স্থান কিংবা সময়ের কথা জানানো হয়নি। তাঁর দাবি, আওয়ামী লীগ আমলে ডিএমপিকে সমাবেশ করার জন্য চিঠি দিলে কমিশনার না হলেও তার নিচের কর্মকর্তারা কথা বলতেন। অন্তর্বর্তী সরকারের ডিএমপি পুরোপুরি নীরব।
বুধবার সকালে শাহবাগে জামায়াতে ইসলামীও একটি সমাবেশ করে তাদের দলীয় নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের মুক্তি উপলক্ষে। সেটির প্রভাব পড়ে সকালের যানজটে। পরে বিএনপির সমাবেশের কারণে সেই যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। সন্ধ্যার পর ঢাকার বেশির ভাগ সড়ক স্থবির হয়ে পড়ে। সমস্যা হলো, যাঁরা জনগণের কল্যাণের কথা বলে রাজনীতি করেন, তাঁরা তাঁদের সমস্যা নিয়ে কম ভাবেন। 
বুধবার তারুণ্যের সমাবেশ থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে ঘোষণা দিয়েছেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতেই হবে, সেটা সরকারের জন্য কঠিন বার্তা বলেই মনে হয়। কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাঁর এই ঘোষণাকে বিএনপির ‘এক দফা দাবি’ বলে অভিহিত করেছেন। তারেক রহমান নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, সংস্কারের নামে সরকার অযথা সময়ক্ষেপণ করছে এবং সরকারের ভেতরে ও বাইরে কারও কারও ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে।
নির্বাচন কমিশনের গেজেট বিজ্ঞপ্তির পরও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপিদলীয় প্রার্থী ইশরাক হোসেনকে শপথ না পড়ানোয় উষ্মা প্রকাশ করে তারেক রহমান বলেন,‘যারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখায় না, যারা আদালতের নির্দেশকে অবজ্ঞা করে, তাদের কাছ থেকে কতটুকু সংস্কার আশা করতে পারি?’ (প্রথম আলো, ২৯ মে ২০২৫) 
এই প্রশ্নের মাধ্যমে বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান নেতা অন্তর্বর্তী সরকারকে সরাসরি আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, যিনি অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দেননি, তিনিও জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় অভিযোগ করেছেন, এখনো গণতন্ত্রের যাত্রা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। 
কয়েক দিন আগে জুলাই ঐক্য নামের একটি সংগঠন শাহবাগে মার্চ ফর ইউনূস কর্মসূচি পালন করে। ওই সংগঠনের নেতারা আওয়াজ তুলেছেন ইউনূস সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকুক। সামাজিক যোগাযোাগমাধ্যমেও ইউনূস সরকার পাঁচ বছর থেকে সংস্কারকাজ সম্পন্ন করুক বলে অনেকে আশা প্রকাশ করেছেন। এসব প্রচার বিএনপির নেতাদের সন্দেহ–সংশয় বাড়িয়ে দিয়েছে।
 যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় ইউনূস সরকার পাঁচ বছর থাকবে, সেটা কীভাবে হবে? কেউ কেউ গণভোট নেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে গণভোটের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। দুজন সামরিক শাসক তাঁদের ক্ষমতা প্রলম্বিত করার জন্য গণভোট করেছিলেন। আর ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসার জন্য যে গণভোট হয়, সেটা ছিল আনুষ্ঠানিকতামাত্র। এর আগে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদে দ্বাদশ সংশোধনী পাস হয়।  
তারুণ্যের সমাবেশে বিপুল জনসমাগম ঘটিয়ে বিএনপি দেখাতে চাইছে যে তরুণদের বৃহৎ অংশ তাদের সঙ্গে আছে। কিন্তু বিএনপির নেতাদের বুঝতে হবে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বড় বড় সমাবেশ করার চেয়ে সেমিনার–টিভি বিতর্ক অনেক বেশি কার্যকর। ঢাকার সমাবেশের আগের দিন বিএনপি যে ‘তারুণ্যের রাজনৈতিক ভাবনা ও অর্থনৈতিক মুক্তি’ শিরোনামে যে সেমিনারের আয়োজন করল, সেখানে দলের বাইরের তরুণ লেখক–ভাবুকেরাও কথা বলেছেন। রাজনীতির সংস্কার চাইলে কর্মসূচির ধরনও পরিবর্তন দরকার। 
কেবল নির্বাচনের দিন-তারিখ নয়, আরও অনেক বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির নেতৃত্বের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বিএনপির এক নেতা অভিযোগ করেন, বিএনপি সরকারকে পুরোপুরি সমর্থন করলেও সরকার তাদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। বিএনপি যে তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ চাইছে, তাঁদের একজনকে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করলেন, যা ছিল দুই পক্ষের জন্য অস্বস্তিকর। বিএনপি লিখিত ও মৌখিকভাবে তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়েছে। পদত্যাগের দাবির জবাবে প্রধান উপদেষ্টা কী বলেছেন, জানতে চাইলে বিএনপির ওই নেতা জানান, তিনি বলেছেন, ‘আপনাদের কথা শুনলাম।’
মোটাদাগে আলোচনার ফলাফল শূন্য। দুই পক্ষই যে নিজ নিজ অবস্থানে অনড়, জাপান সফরে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে তা স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, একটি দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়। অথচ বিএনপির এক নেতা জানালেন, তাঁদের দলসহ ৩০টি দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইছে। অন্যদিকে ডিসেম্বরের পর নির্বাচনের পক্ষে আছে ১৩টি দল। 
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপির এক দফার আন্দোলন ছিল নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে। আন্দোলন করতে গিয়ে দলের বহু নেতা-কর্মী জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির দাবি অগ্রাহ্য করে চব্বিশে একটি প্রহসনের নির্বাচন করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে তাদের বিদায় নিতে হয়েছে। 
বিএনপির আক্ষেপ, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও তাদের রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হচ্ছে যথাসময়ে নির্বাচনের দাবিতে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপির দাবি ছিল সুষ্ঠু নির্বাচনের। এখনকার দাবি যথাসময়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের।
বুধবারের সমাবেশে বিএনপির নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো যদি তিন মাসের মধ্যে ভালো নির্বাচন দিতে পারে, অন্তর্বর্তী সরকার কেন ১৬–১৭  মাসে পারবে না? 
ডিসেম্বর না জুন—এই বিরোধের সমাধান কী? সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার পর দেশে ‘যুদ্ধাবস্থা’ বিরাজ করছে। দেশের ভেতরে ও বাইরে চক্রান্তকারীরা নানাভাবে সরকারের কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্যও তো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের ভালো বোঝাপড়া থাকা দরকার ছিল। বিএনপি জানিয়ে দিয়েছে, ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে সরকারের প্রতি সমর্থন ধরে রাখা কঠিন হবে। এর মাধ্যমে দলটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অনাস্থারই পূর্বাভাস দিয়েছে। 
ডিসেম্বরে নির্বাচন না করার পক্ষে সরকারের যুক্তি হলো বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে অবস্থায় আছে, তাতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। বিএনপি মনে করে, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে বলেই সবখানে অস্থিরতা চলছে। নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে সরকার যত দেরি করবে, পরিস্থিতি সামাল দেওয়া ততই কঠিন হবে।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com
সূত্র: প্রথম আলো