জাতীয় নির্বাচন ঘিরে এখনও কেন শঙ্কা

মাহবুব আজীজ
  ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:৫৬


চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ও উচ্চারিত দুটি বিষয়– সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ৯ মাসেরও বেশি সময়জুড়ে আলোচনার পর সংস্কার প্রস্তাব পেশ করে। সেই অনুসারে গণভোট ও সংসদ নির্বাচন একই দিন হবে বলে সরকার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল নিজেদের প্রার্থী মনোনয়ন দিতে শুরু করেছে। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তপশিল ঘোষিত হবে বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে। প্রধান উপদেষ্টা থেকে সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তি নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হবে বলে বারংবার ঘোষণা দিয়ে এমনও বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন হতে যাচ্ছে।’ কিন্তু নির্বাচনের ঘোষিত সময়ের দুই মাস দূরত্বেও নির্বাচন ঘিরে শঙ্কা ও প্রশ্ন কমছে না।
এর মধ্যে রোববার সকালে খুলনার আদালতপাড়ায় প্রকাশ্যে হেঁটে এসে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে দুই যুবককে। খুলনায় ১৬ মাসে ৪৮ খুন হয়েছে; নভেম্বরেই ৭। আইনশৃঙ্খলার এই বিপর্যস্ত পরিস্থিতি কেবল খুলনাতে নয়, দেশের নানা প্রান্তে দেখা যাচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্বে যেমন, তেমনি দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বেও নেতাকর্মী খুন-জখম হচ্ছেন। প্রশাসন ও পুলিশের তৎপরতা নিয়ে অভিযোগেরও সুরাহা হচ্ছে না। সর্বশেষ মানিকগঞ্জে বাউল আবুল সরকারের গ্রেপ্তারের ঘটনায় প্রতিবাদী বাউলদের ওপর উগ্রবাদীদের হামলাসহ নানা স্থানে মব সন্ত্রাসে পুলিশের নির্বিকার ভূমিকা নতুন নতুন প্রশ্ন সামনে এনেছে। 
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পরপর তিনটি ছলচাতুরীর নির্বাচনের প্রধান শক্তি ছিল দলীয় প্রশাসন ও পুলিশ। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় তাদের শনাক্ত করে শাস্তির উদ্যোগ নেই। যথার্থ বটে, সরকারের নির্দেশ প্রশাসন ও পুলিশ মানতে বাধ্য; কাজেই শাস্তি হতে হবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। তাহলে বর্তমানে নানা ক্ষেত্রে পুলিশের নির্বিকারত্বও কি সরকারের সিদ্ধান্ত? পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে পুলিশের কার্যক্রম আরও সক্রিয় ও সুনির্দিষ্ট করতে উদ্যোগী হতে হবে সরকারকে। লটারিতে এসপি পদায়ন ও বদলিই কেবল সমাধান নয়, নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসন ও পুলিশের সর্বাত্মক সক্ষমতা ব্যবহারে কার্যকর উপায় খুঁজে বের করতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী পুরস্কার ও তিরস্কারের ব্যবস্থা করে পুলিশ ও প্রশাসনকে চাঙ্গা রাখার দায়িত্ব সরকারকে দ্রুত নিতে হবে।
নির্বাচন কমিশন নিয়েও প্রশ্ন কম নেই। সামগ্রিক নির্বাচনী বন্দোবস্ত– সহিংসতা ও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ প্রতিরোধের জন্য যে লোকবল, প্রযুক্তিগত সহায়তা, আইনগত সক্ষমতা ও প্রাতিষ্ঠানিক দৃঢ়তা প্রয়োজন; এর কোনো কিছুই নির্বাচন কমিশনে দেখা যায় না। বরং বিগত দিনে সরকারের অনুগত কণ্ঠস্বর হিসেবেই নির্বাচন কমিশনকে দেখা গিয়েছে। বর্তমান কমিশন এখনও তাদের স্বাতন্ত্র্য প্রমাণ করতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে; তপশিল ঘোষণা এবং সব দলের জন্য সমতল মাঠ প্রস্তুত করতে হবে। কেন্দ্রে গোলযোগ হলে তাৎক্ষণিক ভোট বাতিলসহ প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিগত নির্বাচনগুলোয় প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র বা হলফনামায় মিথ্যা বা জাল তথ্য উপস্থাপন করলেও কমিশনের কার্যকর ভূমিকার দেখা মেলেনি। এ বিষয়ে এবারের কমিশনের প্রস্তুতিবার্তা এখনও মেলেনি। প্রার্থীদের অসত্য তথ্যসহ আচরণবিধি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের ক্ষেত্রে কমিশন কী পদক্ষেপ নিতে সক্ষম, তার ওপর নির্বাচনের সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করছে। আইনশৃঙ্খলার নাজুক পরিস্থিতি আমলে নিয়ে দেশের ৩০০ আসনে এক দিনে নির্বাচনের বদলে আট বিভাগে আট দিনে নির্বাচনের চিন্তা করা যেতে পারে। এতে বিশৃঙ্খলা রুখে দেওয়া সহজ হতে পারে। অবশ্য কমিশন কি আদৌ আইনশৃঙ্খলার নাজুক পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে? 
২০০৮ সালে সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে ভোট পড়ে ৮৭ শতাংশ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে সেটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা অনুকূলে থাকলে ও সব দল অংশ নিলে এ দেশে ভোটাররা নির্বাচনকে উৎসবে পরিণত করেন। আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি সেই সম্ভাবনা ম্লান করে। তাদের অনুপস্থিতি ভোটার উপস্থিতিও কমিয়ে দিতে পারে। আওয়ামী লীগের পক্ষে সহিংসতার চেষ্টাও হতে পারে; অবশ্য সেটা যে কোনো পক্ষ থেকেই হতে পারে। প্রতিহিংসা ও বিভাজনের রাজনীতিতে সহিংসতার চেষ্টা হবে, 
বলা বাহুল্য।
এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে সরকারের কঠোর মনোবল ও সুদৃঢ় পদক্ষেপের বিকল্প নেই। কথার ফুলঝুরি নয়, কাজেই প্রমাণ রাখতে হবে। রাজনীতিতে অর্থের ব্যবহার যেমন সন্ত্রাস উস্কে দেয়, ধর্মের ব্যবহারও সহিংসতা ও উগ্রতা ছড়িয়ে দেয়। এসব বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ আমরা দেখি না; বরং উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্রমবর্ধিত শক্তি ও আস্ফালন দেখতে পাচ্ছি। ধর্মভিত্তিক দল নিশ্চয়ই রাজনীতি করতে পারবে; কিন্তু ভোটের বদলে ‘বেহেশতের টিকিট বিক্রি’ ধর্মের অপব্যবহার 
ছাড়া কিছু নয়।
গণঅভ্যুত্থানজয়ী অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে গতানুগতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেয়ে প্রত্যাশা অনেক বেশি। রাজনীতিতে ভারসাম্য তৈরি জরুরি। ভারসাম্য তৈরিতে সরকারের ভূমিকা প্রয়োজন। ডানপন্থি সাম্প্রদায়িক শক্তির তুলনায় বামপন্থি প্রগতিশীল শক্তির সঙ্গে সরকারের দূরত্ব দৃশ্যমান। আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত; পুরো দল নয়। সরকার আহ্বান জানাতে পারে– মামলায় অনভিযুক্ত নেতাদের নিয়ে দলটি নির্বাচনে অংশ নিক। এতে দলটি রাজি না হলেও সরকার তার দিক থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে। জাতীয় পার্টি, ১৪ দল, সিপিবিসহ বামপন্থি চার দল, যারা সংবিধানের মূল স্তম্ভ বদলের প্রতিক্রিয়ায় সরকারের সঙ্গে আলোচনা বাতিল করে– সকলের সঙ্গে আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত করে নির্বাচনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পারে সরকার।
তবে সময় কম। নির্বাচন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অনুষ্ঠিত হতে হবে। নির্বাচিত সরকারের অনুপস্থিতিতে দেশে বিনিয়োগ কমছে, বেকারের সংখ্যা হু-হু করে বাড়ছে, আর্থসামাজিক সব সূচক নিচের দিকে। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ তার নেতাকে ভোটে নির্বাচিত করে জবাবদিহিতার মধ্যে দেখতে চায়। এ জন্যই এত রক্তস্রোত, এত মায়ের বুকফাটা কান্না, সন্তানের আত্মদান। সেই কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রে পৌঁছানোর জন্য সরকারের নিজের ভূমিকায় অবিচল থাকতে হবে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে দেশ গভীর অনিশ্চয়তায় নিক্ষেপিত হবে, যা কারও প্রত্যাশিত নয়। 
দেশে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা স্বৈরাচার পতনের পর থেকে সকলের আকুল অপেক্ষা মুক্ত গণতন্ত্রের জন্য। এ লক্ষ্যে নির্বাচন ঘনিয়ে আসার কালে আনন্দমুখর কলকাকলিতে মেতে ওঠার কথা সারাদেশ। তার বদলে বহু শঙ্কা ও সংশয় কালো মেঘের মতো জাতির আকাশে ঘনায়মান। এই মেঘ সরিয়ে সূর্যের দেখা পাবার জন্য জাতির যূথবদ্ধ 
চেষ্টায় নেতৃত্ব দিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। মেঘ সরানোর প্রধান পদক্ষেপও সরকারকে নিতে হবে। সরকার কি সেই পথে এগোবে? জাতি তা দেখবার জন্য অধীর অপেক্ষায়।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com
সূত্র: সমকাল