৬৩৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে সংঘটিত হয় ইতিহাসের বৃহত্তম ইয়ারমুক যুদ্ধ। ছয় দিন ব্যাপী তা চলমান ছিল। একদিকে ছিলেন খেলাফতের ঝান্ডাবাহি ওমর ইবনুল খাত্তাব রা., অপরদিকে ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের নেতা হিরাক্লিয়াস। সামরিক ইতিহাসে এই যুদ্ধ অন্যতম ফলাফল নির্ধারণকারী যুদ্ধ হিসেবে গণ্য। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর এই যুদ্ধ মুসলিম বিজয়ের প্রথম বৃহৎ বিজয় হিসেবে দেখা হয়। এর ফলে খ্রিস্টান লেভান্টে ইসলাম দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
ঐতিহাসিক এ যুদ্ধের পর ওমর রা. আমর ইবনুল আছ রা.কে সেনাপতি নিযুক্ত করে বাইতুল মোকাদ্দাসে প্রেরণ করেন। তিনি সেখানে পৌঁছে সর্বপ্রথম বায়তুল মুকাদ্দাসকে অবরোধ করেন। তৎকালীন বাইতুল মোকাদ্দাস এর রোমান নেতা তার বিপরীতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। রোমানরা দুর্গ থেকে বেরোতে না পেরে ভেতর থেকেই হামলা শুরু করে,তবে তারা বেশিদিন টিকতে পারেনি।অন্য দিকে আরেকজন সাহাবী আবু উবাইদা রা. সিরিয়ার যুদ্ধ শেষ করে আমর ইবনুল আছ রা. এর সাথে মিলিত হন। তিনি সেখানে পৌঁছেই রোমান সেনাপতিদের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেন।
তাতে লেখা ছিল : খুশি এবং আনন্দ ঐ সমস্ত লোকদের জন্য, যারা সরল-সঠিক পথে চলে এবং রাসুলের উপর ঈমান আনে।আমরা তোমাদের কাছ থেকে এটা চাচ্ছি যে, তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনো। যখন তোমরা ঈমান আনবে তোমাদেরকে হত্যা করা, তোমাদের সন্তান-সন্ততিকে আঘাত করা, আমাদের উপর হারাম হয়ে যাবে। আর যদি তোমরা ঈমান না আনো তাহলে তোমরা আমাদেরকে টেক্স আদায় কর এবং আমাদের অধীনে বসবাস করো। যারা এই সিদ্ধান্তটিও মানবে না আমরা তাদের মোকাবেলায় এমন লোকদের নিয়ে আসবো, যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে থাকে। আর আমরা এই অঞ্চল বিজয় ছাড়া কখনো পিছু হঠবো না। (বিদায়া ওয়ান্নিহায়া)।
চিঠি পাওয়ার পর তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয় এবং নত শিকার করে।বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের হাতে সমর্পণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।তবে তারা একটি শর্ত দেয়, তা হলো বায়তুল মুকাদ্দাস একটি পবিত্র জায়গা। মুসলমানদের খলিফা ব্যতীত আমরা তা সমর্পণ করব না। তাদের এই শর্তে মুসলিম সেনাপতিগণ রাজি হন এবং তৎক্ষণাৎ উমর রা. সমীপে একটি চিঠি লিখেন। চিঠি পাওয়ার পর ওমর রা. সকল নেতৃস্থানীয় সাহাবিদেরকে মসজিদে নববীতে একত্রিত হতে বলেন।সবার সাথে পরামর্শ করে জেরুজালেম যাওয়ার মত ব্যক্ত করেন। তখন উসমান রা. না যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু হযরত আলী রা.বললেন ‘মুসলমানরা জেরুজালেম অঞ্চল নিয়ে অনেক পেরেশানির মধ্যে আছে। তারা দীর্ঘদিন যাবত দূর দেশে সফরে থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।এমন অবস্থায় এটাই ভালো হয় যে,আপনি নিজে সেখানে গিয়ে মীমাংসা করেন। তখন ওমর রা. তার কথা গ্রহণ করলেন এবং ওসমান রা.কে মদিনার অস্থায়ী গভর্নর নিযুক্ত করে বায়তুল মুকাদ্দাস এর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন।
সফরের জন্য তিনি মেটে রঙের একটি উটনি বাছাই করেন। উটনির উপর দুটি থলে ঝুলিয়ে দেন।একটির মধ্যে ছাতু,আরেকটির মধ্যে খেজুর ছিল। উটনির সামনে ছিল পানির মশক। সাথে ছিল আরেকটি বড় গামলা, যাকে আরবিতে ‘কাশকুল’ বলা হয়, সেটির মধ্যে ছিল সফরের অন্যান্য জিনিসপত্র। সফর করার সময় প্রতিদিন সকাল বেলায় ওমর রা. সেই বড় গামলাটি সামনে রাখতেন এবং সফরসঙ্গীদের সাথে মিলে খাবার খেতেন।অতঃপর যখন তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসের নিকটবর্তী “জাবিয়া” নামক স্থানে পৌঁছলেন সেখানে আবু ওবায়দা ও খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারা পূর্ব থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, সে স্থানে তৎকালীন সমস্ত মুসলিম গভর্নর উমর রা.এর সাথে সাক্ষাৎ করেন।বিশেষভাবে মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান, আবু উবাইদা এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ।সাক্ষাতের সময় তাদের পোশাক ছিল অত্যন্ত সুন্দর, শানদার। এ পোষাক দেখে উমর রা. তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে যান এবং অনেক রাগান্বিত হন। ছোট কংকর হাতে নিয়ে তাদের দিকে নিক্ষেপ করতে থাকেন আর বলতে থাকেন এত জলদি তোমরা পরিবর্তন হয়ে গেলে? এমন পোশাকে তোমরা আমার সাথে মিলিত হতে এসেছ তোমাদের লজ্জা করল না?
যদি তোমাদের এমন অবস্থা থাকে তাহলে আল্লাহতালা তোমাদেরকে ভুলে গিয়ে রাজত্ব অন্যদের হাতে দিয়ে দিবেন। তার এমন রাগান্বিত অবস্থা দেখে বাহিনীর নেতা তার শরীরের পোশাকটা সরিয়ে তরবারি দেখিয়ে দিলেন। এটা দেখে উমর রা এর রাগ কিছুটা কমে যায়। ইতিহাসের পাতায় এটাও লেখা আছে যে ওমর রা. যখন জাবিয়াতে পৌঁছলেন, তখন তিনি সেখানকার গভর্নর কে ডেকে তার পোশাকটা খুলে দেন এবং বলেন আমার পোশাকটা মেরামত ও ধুয়ে নিয়ে আসো। ততক্ষণ পর্যন্ত আমাকে একটি কাপড় পরিধান করতে দাও। তখন তিনি রেশমের একটি কাপড় নিয়ে আসলেন।এটা দেখে তিনি বললেন “এটা আবার কি জিনিস? বলা হলো এটি রেশম। আবার জিজ্ঞেস করলেন,রেশম আবার কি? সেখানকার লোকেরা বলার পর তিনি বললেন আচ্ছা ঠিক আছে।
পরবর্তীতে যখন সেই কাপড়টি ধুয়ে নিয়ে আসা হলো তখন তিনি তা খুলে দেন। তখন সেই গভর্নর বলল আপনি আরবের বাদশা এবং মুসলমানদের খলিফা, আপনার শানে এমন পোশাক মানায় না, আপনি আরো সুন্দর এবং ভালো পোশাক পরিধান করলে রোমানদের সামনে আপনার অনেক নাম-দাম হবে। তখন তিনি রাগান্বিত সরে বললেন ‘আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে ইসলামের কারণে যে সম্মান দিয়েছেন তা ব্যতীত আমাদের আর কিছুই দরকার নেই’।
ইবনে কাসীর রহ. ফিলিস্তিন সফরের নকশা বলতে গিয়ে লিখেন যে, হযরত ওমর রা. এর কপালের উপরের অংশ ঘামে চমকাচ্ছিল।মাথার উপর টুপি ছিল। দুই পা উটনির ওপর ছিল।উটনির পিঠের উপর একটি পুরাতন কম্বল ছিল, যেটা রাতে বিছিয়ে ঘুমাতেন, তা খেজুরের পাতা দ্বারা নির্মিত ছিল।