ইসলাম ধর্মের অন্যতম স্তম্ভ রোজা। আর তাই পবিত্র রমজান মাসে বিশ্বজুড়ে রোজা পালন করছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। এই মাস জুড়ে মুসলমানরা ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকেন।
এই দীর্ঘ সময় খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকার কিছু স্বাস্থ্যগত সুবিধা থাকলেও, কেউ কেউ খাদ্যাভ্যাসের আকস্মিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে অসুবিধা বোধ করে থাকেন। এছাড়া দীর্ঘ সময়ের জন্য খাদ্য ও পানীয় পরিহার করার ফলে অনেকেই এক ধরনের ক্লান্তি এবং অবসাদ অনুভব করে থাকেন।
আবার যারা উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড সুগারের মতো স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন তাদের এই উপবাস কষ্টকর হতে পারে। আর তাই এখানে স্বাস্থ্যকর উপায়ে রোজা রাখার জন্য পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের দেওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস তুলে দেওয়া হল,
তিন ধাপে সাহরি
রোজাদার ব্যক্তির দিনের প্রথম আহার হল সাহরি। এই সময়ে তিনি যা খাবেন তা নির্ধারণ করবে যে তিনি সারাদিন রোজা রাখার সময় কতোটা ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত বা ক্ষুধার্ত বোধ করবেন। পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন সাহরিতে এমন সব খাবার খাওয়া উচিত যাতে প্রায় ৭০ শতাংশ পানি থাকে।
তার মতে, খাবারটি তিন ধাপে খাওয়া উচিত এবং এক ধাপের সঙ্গে আরেক ধাপের যেন পাঁচ মিনিটের ব্যবধান থাকে। সাহরি শুরু করতে হবে সালাদ দিয়ে। এতে থাকতে পারে শসা, লেটুস ইত্যাদি। তবে খেয়াল রাখতে হবে সালাদে যেন লবণ বেশি না থাকে।
সাহরির দ্বিতীয় ধাপে খাওয়া উচিত শর্করা ও চিনি জাতীয় খাবার। এক্ষেত্রে দুই তিন টুকরো বা এক কাপ তাজা ফল খাওয়া ভাল, যেগুলোয় পানির পরিমাণ বেশি।
এরপর তৃতীয় বা শেষ ধাপে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খেতে হবে।
রোজা রাখার সময় সাহরিতে চা এবং কফি পান করা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। কারণ এসব পানি হল মূত্রবর্ধক এবং এতে ক্যাফিন থাকে। এতে শরীর থেকে দ্রুত পানি বেরিয়ে যাবে।
ক্লান্ত বা অলস বোধ হলে কী করবেন?
সারাদিন রোজা রেখে ইফতারে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে বেশীরভাগ মানুষের মধ্যেই। কিন্তু এতে তার কী ক্ষতি হচ্ছে সেটা তিনি বুঝতে পারেন না। এই ভুড়িভোজের ফলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, যেমন পেটে ব্যথা, পেট ভার লাগা, অলসতা, ঘুম ঘুম ভাব ইত্যাদি হয়।
তবে, কিছু মানুষের জন্য সমস্যাটি আরও গুরুতর হয়ে উঠতে পারে যদি তার উচ্চ রক্তচাপ বা রক্তে চিনির মাত্রা বেশি থাকে। আর তাই সাহরির মতো ইফতারও তিনটি পর্যায়ে খাওয়ার পরামর্শ পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের। এবং এক খাবার থেকে পরের খাবারের মধ্যে ছয় মিনিটের ব্যবধানে থাকতে হবে।
তাদের মতে, প্রথম পর্যায়ে এক কাপ পানি খেয়ে রোজা ভাঙার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ছয় মিনিট পর, দ্বিতীয় ধাপে চিনি ও শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। সেটা হাতে তৈরি খাবারের পরিবর্তে প্রাকৃতিক খাবার হলে ভালো যেমন খেজুর বা তাজা ফলের রস।
এবং আরও ছয় মিনিট পর তৃতীয় ধাপে ছোট ছোট করে কাটা সালাদ খাওয়ার পরামর্শ পুষ্টিবিদদের। শাকসবজিতে থাকা ফাইবার শরীরকে ভিটামিন সরবরাহ করতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
পুষ্টিবিদরা বলেন, সালাদের পরে একটি বা দুটি খাবার খাওয়া উচিত, যাতে প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট থাকে। যেমন আলু, ভাত, রুটি,পিঠা, খিচুরি ইত্যাদি।
এসব খাবার কতোটা চিবিয়ে খাচ্ছেন সেটাও জরুরি। খাবার নরম হলে ৩০ সেকেন্ড ধরে চাবাবেন এবং শক্ত হলে যেমন যেমন মাংস এবং বাদাম এগুলো খেতে এক মিনিট ধরে চিবিয়ে খাবেন।
নারীরা কি পুরুষদের চেয়ে বেশি ধৈর্যশীল?
মরক্কোর খাদ্য, বিজ্ঞান এবং পুষ্টি বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফায়েদ বলেন: “সাধারণত নারীরা পুরুষদের তুলনায় রোজা সহ্য করতে বেশি সক্ষম কারণ একজন নারীর শরীরে চর্বির পরিমাণ পুরুষের শরীরের তুলনায় বেশি। পুরুষদের পেশী ভর মহিলাদের পেশী ভরের চেয়ে বেশি।" .
ফায়েদের মতে, এর পিছনে বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে এবং তা হল নারীদের মধ্যে এমন কিছু সক্রিয় হরমোন রয়েছে যা পুরুষদের চেয়ে বেশি, এবং তাদের মধ্যে আবার কিছু হরমোন পুরুষদের মধ্যে বেশি সক্রিয়।
"এস্ট্রোজেন হরমোন মহিলাদের ক্ষুধা সহ্য করতে এবং যতক্ষণ সম্ভব শান্ত মেজাজে রাখতে সাহায্য করে, যা তাদের আবেগ এবং উদ্বেগের অনুভূতিগুলি মোকাবেলা করতে সহায়তা করে, যেখানে কিনা পুরুষদের মধ্যে টেস্টোস্টেরন হরমোনের আধিক্য বেশি। যা তাদের আবেগ, উদ্বেগ এবং উত্তেজনার অনুভূতিকে উদ্দীপিত করে।"
ফায়েদ আরও জানান, “একজন নারীর শরীরে সাধারণভাবে একজন পুরুষের চাহিদার তুলনায় কম খাবারের প্রয়োজন হয়। নারীরা যখন প্রচুর পরিমাণে মাংস, হাঁস-মুরগি এবং পনির খান তখন হরমোনের উৎপাদন বেড়ে যায়।”
“এতে তাদের স্নায়বিক অবস্থা প্রভাবিত হয়। কারণ এস্ট্রোজেন কোলেস্টেরলের সাথে যুক্ত। তাই প্রচুর পরিমাণে মাংস খাওয়ার ফলে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং এইভাবে নারীর স্নায়ুতে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়।"
চাকুরীজীবী নারী
কর্মজীবী নারীরা বাইরে কাজ করার পাশাপাশি বাড়ি ফিরে শিশুদের দেখাশোনা এবং গৃহস্থালির বড় বোঝা সাম্লে থাকেন। এক্ষেত্রে, নারীর ক্যালোরি খরচ হওয়ার হার একজন পুরুষের সমানই হয়। কখনও কখনও নারীরা পুরুষদের তুলনায় দ্বিগুণ কাজ করে, দ্বিগুণ ক্যালোরি খরচ করে।
এ সময় একজন ব্যক্তির মেজাজ কেমন হবে সেটা অনেকটাই নির্ভর করে তিনি ধরনের খাবার খাচ্ছেন তার ওপরে। যারা প্রচুর মাংস খান তারা নিরামিষাশীদের তুলনায় বেশি আবেগপ্রবণ এবং মানসিক চাপে থাকেন বলছেন পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ফায়েদ।
তিনি জানান একজন নারী, পুরুষের মতো একই পরিমাণে মাংস এবং পনির খেলে তিনি একই মানসিক এবং স্নায়বিক পরিস্থিতিতে ভুগতে পারেন। যা কিনা একজন পুরুষ ভোগেন।
খেলাধুলা ও ব্যায়ামের সেরা সময়
শরীরের অতিরিক্ত ক্যালোরি থেকে মুক্তি পেতে নামাজ পড়ার পাশাপাশি কিছু ধরনের ব্যায়াম করা দরকার যা হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেবে। এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন লন্ডন-ভিত্তিক পুষ্টি বিশেষজ্ঞ আইসন কোয়াঞ্জ।
তিনি বলেন, ‘যেকোনো ধরনের ব্যায়াম শুরু করার আগে পাকস্থলীকে অবশ্যই হজম প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে, অর্থাৎ সেহরি বা ইফতারের অন্তত তিন ঘণ্টা পর ব্যায়াম শুরু করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন: "প্রথম দিনগুলোয় শরীরের উপর বেশি চাপ দেবেন না। এজন্য হালকা ব্যায়াম করুন যেমন হাঁটাহাঁটি করা, ঘরের মধ্যে হালকা ভারোত্তোলন করা, সিঁড়ি দিয়ে কয়েকবার ওঠা।
প্রতিদিন অল্প অল্প করে ব্যায়ামের এই হার বাড়ানো ভালো। একেকজন ব্যক্তির সক্ষমতা এবং স্বাস্থ্য পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যায়ামের গ্রহণযোগ্য স্তর একেকরকম হবে।’
এসময় তিনি কোমল পানীয় এবং কৃত্রিমভাবে মিষ্টি করা পানীয় থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এর পরিবর্তে ভেষজ পানীয় যেমন ক্যামোমাইল টি, গ্রিন টি এবং অন্যান্য ভেষজ পানীয় খেতে বলেছেন।