মিশরের অধিবাসী কিবতিদের রাজাকে ফেরাউন বলা হতো। আল্লাহ তার নবি হজরত মুসাকে (আ.) নবুয়্যত দিয়ে তার সমকালীন ফেরাউনকে তাওহিদ বা একত্ববাদের দাওয়াত দিতে পাঠিয়েছিলেন যে অত্যন্ত দাম্ভিক ও অহংকারী ছিল এবং নিজেকে মিশরীয়দের প্রভু বা খোদা মনে করতো।
হজরত মুসার (আ.) সমকালীন ফেরাউনের প্রকৃত নাম নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে এই ফেরাউনের নাম ছিল ‘রামেসিস’, অনেকে বলেন, নবুয়্যত লাভের পর মুসা (আ.) যে ফেরাউনের মুখোমুখি হয়েছিলেন তার নাম ছিল ‘মারনেপতাহ’। অনেকে আবার বলেছেন তার নাম ছিল ‘ওয়ালিদ ইবনে মাসআব ইবনে রাইয়ান’ যে প্রায় চারশত বছর হায়াত পেয়েছিল।
চরম উদ্ধত ও পথভ্রষ্ট এই ব্যক্তির স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুজাহিম (আ.) ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও সহানুভূতিশীল ভালো মনের একজন মানুষ। ঘটনাচক্রে আল্লাহর নবি মুসা (রা.) শৈশবে তার কাছে আশ্রয় পেয়েছিলেন, তার কোলে প্রতিপালিত হয়েছিলেন।
ফেরাউনের হাত থেকে বাঁচাতে মুসাকে (আ.) যখন তার মা একটি ভেলায় শুইয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, ভাসতে ভাসতে ওই ভেলাটি গিয়ে ভিড়েছিল ফেরাউনের প্রাসাদের ঘাটে। পরিচারিকারা শিশুটিকে ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়ার (আ.) কাছে নিয়ে যায়। শিশুটিকে দেখে তার খুব মায়া হয়। তিনি তাকে হত্যা করতে বাঁধা দেন এবং তাকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করার আগ্রহও প্রকাশ করেন।
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি মুসার মায়ের প্রতি নির্দেশ পাঠালাম, তুমি তাকে দুধ পান করাও। যখন তুমি তার ব্যাপারে আশঙ্কা করবে, তখন তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ করবে। তুমি ভয় বা চিন্তা করবে না। নিশ্চয় আমি তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব এবং তাকে রাসুলদের অন্তর্ভুক্ত করব। তারপর ফেরাউনের লোকজন তাকে উঠিয়ে নিল যাতে সে তাদের জন্য শত্রু হতে ও দুঃখের কারণ হতে পারে। ফেরাউন, হামান ও তাদের বাহিনীর লোকেরা তো ছিল অপরাধী। ফেরাঊনের স্ত্রী বলল, এ শিশু আমার ও তোমার চক্ষু শীতলকারী, তাকে হত্যা কর না, সে আমাদের উপকারে লাগতে পারে অথবা তাকে আমরা পুত্র হিসেবেও গ্রহণ করতে পারি আর তারা কিছুই বুঝতে পারল না (যে এই শিশুই ভবিষ্যতে আল্লাহর নবি হবে এবং ফেরাউনের রাজত্বের অবসান ঘটাবে)। (সুরা কাসাস: ৭-৯)
পরিণত বয়সে পৌঁছে মুসা (আ.) যখন আল্লাহর নবি হিসেবে প্রেরিত হন এবং ফেরাউনের কাছে আল্লাহর দাওয়াত পৌঁছে দেন, ঔদ্ধত্য ত্যাগ করে আল্লাহকে রব হিসেবে স্বীকার করার আহ্বান জানান, তখন ফেরাউন মুসার (আ.) দাওয়াতে সাড়া না দিয়ে তাকে শত্রু জ্ঞান করে। মুসা (আ.) ও তার অনুসারীদের ওপর জুলুম শুরু করে। তাদেরকে বিপর্যস্ত ও নিশ্চিহ্ন করার আয়োজন করতে থাকে।
কিন্তু ফেরাউনের স্ত্রী হজরত আসিয়া (আ.) মুসার (আ.) দাওয়াতে সাড়া দিয়ে তার দীন গ্রহণ করেন। এক আল্লাহর ইবাদত শুরু করেন। প্রথম দিকে তিনি ঈমান আনার বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। এক পর্যায়ে ফেরাউন কোনোভাবে এটা জেনে যায় এবং তার ওপরও প্রচণ্ড নির্যাতন নেমে আসে। তাকে ঈমান ত্যাগ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু তিনি কিছুতেই ঈমান ত্যাগ করতে রাজি হননি। দুনিয়ার ভোগ-বিলাস, রাজকীয় জীবন-যাপনের বিনিময়ে তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতের জীবনকেই বেছে নেন।
কোরআনে আল্লাহ তাআলা তার প্রশংসা করেছেন। তাকে একজন আদর্শ মুমিন নারীর দৃষ্টান্ত হিসেবে বলেছেন তার কথা। তিনি নির্যাতিত হয়ে আল্লাহর কাছে জান্নাতে একটি ঘর প্রার্থনা করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ বিশ্বাসীদের জন্য উপস্থাপন করেছেন ফেরাউনের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত, যে প্রার্থনা করেছিল, হে আমার রব! আপনার কাছে জান্নাতে আমার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করুন এবং আমাকে উদ্ধার করুন ফেরাউন ও তার দুস্কৃতি থেকে এবং আমাকে উদ্ধার করুন জালিম সম্প্রদায়ের কবল থেকে। (সুরা তাহরিম: ১১)
অনেকগুলো হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) তার প্রশংসা করেছেন। তাকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুমিন নারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, জান্নাতবাসী নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুজাহিম এবং মারিয়াম বিনতে ইমরান আল্লাহ তাআলা তাদের সবার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। (মুসনাদে আহমদ: ২৬৬৩)
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত নবিজি (সা.) বলেছেন, সারা বিশ্বের নারীদের মধ্যে এই চারজন নারীর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়াই তোমার জন্য যথেষ্ট। তারা হলেন, মারইয়াম বিনতে ইমরান, খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ এবং ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া। (সুনানে তিরমিজি: ৩৮৭৮)