যুক্তরাষ্ট্র চায় স্বৈরাচারমুক্ত একটি বিশ্ব

বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক মন্দায় আশার আলো বাংলাদেশ!
রুবাইয়েত হাসান
  ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১০

 বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক মন্দা শুরু হওয়ার পর থেকে গণতন্ত্রায়নে পট পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ফসল বাংলাদেশ। গণতন্ত্র আবার তার গতি ফিরে পেতে শুরু করেছে। এতে বৈশ্বিক আবদ্ধ একনায়কতন্ত্রও চাপের মুখে পড়েছে। গত দু’দশকের গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসারণের পর আবারও মোড় নিতে শুরু করেছে। সম্প্রতি  বাংলাদেশ এবং ভেনিজুয়েলায় গণতন্ত্রায়নের প্রতিশ্রুতিশীল সুযোগ দেখা দিয়েছে।  এখনই আন্তর্জাতিক মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা সময়ের সুযোগ তৈরী হয়েছে।
যুদ্ধের পৃথিবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী নেীকা উত্তাল তরঙ্গে ভাসছে। গণতন্ত্রের পালে বৈশ্বিক লু হাওয়া বইতে শুরু করেছ। সারা পৃথিবী অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে রয়েছে- ইতোমধ্যে পৃথিবীর ৭০টি বেশী দেশ নির্বাচন শেষ করেছে। বিশ্ব জনসংখ্যার ৪৪শতাংশ মানুষ এসব নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। ৩৩শতাংশ ভোট অগণতান্ত্রিক অনুশীলনের মধ্য দিয়ে  তাদের নির্বাচন শেষ করছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গণতন্ত্র সূচকে অন্তত ২৬টি কর্তৃত্ববাদী বা হাইব্রিড শাসনব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যা এ বছর বিশ্বব্যাপী সমস্ত নির্বাচনের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি, বাকিগুলো গণতান্ত্রিক সরকার দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে কমপক্ষে ২০টি ত্রুটিযুক্ত হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে।
গণতন্ত্রের জন্য বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি মেঘলা হলেও একেবারে হতাশাজনক না। রাজনৈতিক উগ্রবাদ, মেরুকরণ, এবং অবিশ্বাস এমনকি দীর্ঘস্থায়ী উদার গণতন্ত্রেও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুটি প্রধান দলের প্রার্থীদের মধ্যে একজনের গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। কিন্তু মেঘের আড়ালে সূর্যের ঝলক আছে। বাংলাদেশই একমাত্র উদাহরণ। ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভে বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশে একজন স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে। ইউক্রেন-গাজা যুদ্ধের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে এক বিস্তৃত সংঘাত-ক্রমবর্ধমান বিপদ এবং মার্কন যুক্তরাষ্ট্রের রাস্ট্রপতি নির্বাচনী দেীড় ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আকস্মিক পদত্যাগ এবং নির্বাসন- বৈশ্বিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
গ্লোবাল ডেমোক্রেসি অ্যাট দি ফ্রিডম স্পোগলি ইনিস্টটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ষ্টাডিস-স্টানফোর্ড ইউনিভাসিটি এবং হোভার ইনিস্টটিউশন এর ফেলো লেরী ডাইমন্ড -উইলিয়াম ক্লেটোনের  সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণায় এসব মন্তব্য উঠে আসে।   এতে বলা হয় – বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় মেয়াদে ১৫বছর ক্ষমতায় ছিল। এসময়ে  বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসনসহ সরকারের নানা এজেন্সি ব্যবহার করে সংবাদপত্র-মিডিয়ায় বিরোধীমতের সবাইকে ঢালাওভাবে দমনপীড়ন করে ফ্যাসিবাদী সরকার হিসেবে প্রমানিত হয়েছে। এতে  বাংলাদেশ সুশীল সমাজ ক্রমবর্ধমান গ্রেফতার ও গুমের মুখে নীরব থাকতে রাজি ছিলনা। তাই ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা যখন আরেকটি অন্যায্য নির্বাচনে টানা চতুর্থ মেয়াদে যাওয়ার জন্য ডামি নির্বাচন করেন । তখনই জনগণের প্রতিবাদ আরও তীব্র হয়। জুন মাসে প্রতিবাদের ভাষা পাল্টে যেতে থাকে। তখনও  ট্রিগারটি একটি আপাতদৃষ্টিতে শালীন বিষয় ছিল বলে গবেষণায়  উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে সরকারী চাকরির জন্য একটি কোটা পদ্ধতি পুনঃস্থাপন যা হাসিনার রাজনৈতিক ভিত্তির পক্ষে ছিল। এদিকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে উঠে আসা সরকার-দলীয় লুণ্ঠন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। এতে শেষ রক্ষায় শেখ হাসিনা  পুলিশ-সামরিক বাহিনীকে রাস্তায় পাঠিয়েছিলেন। পরের দুই মাসে, সহাস্রাধিক বেসামরিক লোক নিহত, ২০হাজারেরও  বেশি আহত এবং ১০হাজারেরও বেশি গ্রেপ্তার হয়েছিল। সরকারের বর্বরতায় সীমিত প্রতিবাদ আন্দোলনকে স্বৈরাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আইন অমান্য অভিযানে পরিণত করেছে। শেষ পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর সমর্থন হারিয়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এমন আন্দোলনে একজন স্বৈরশাসকের পতন-পৃথিবীর অন্য কোথাও হওয়ার চেয়ে বাংলাদেশে এতো সহজ কাজ ছিলনা বলে গবেষণায় মন্তব্য করা হয় ।
এখানো দেখানো হয়- রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং অর্থনীতির উপর প্রাতিষ্ঠানিক আদর্শিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ করেছিল যেভাবে চীন -কিউবা এবং ভিয়েতনামে বিপ্লবী কমিউনিস্ট দলগুলি ছিল, ইরানে আয়াতুল্লাহদের  ছিল, বা কিছুটা হলেও হুগো শ্যাভেজের "বলিভারিয়ান সমাজতান্ত্রিক" আন্দোলন ভেনেজুয়েলায় ছিল। গত এক দশকে স্বৈরাচার আবির্ভূত হয়েছিল তারা বাংলাদেশের মতোই একটি পথ অনুসরণ করেছিল- যেভাবে দুর্নীতিবাজ নেতারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ফাঁপা করে ফেলেছে এবং বহুদলীয় নির্বাচনের আড়ালে স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। গণতন্ত্রকে অবনমিত করতে এল সালভাদর হাঙ্গেরি নিকারাগুয়া সার্বিয়া তিউনিসিয়া তুরস্ক এবং ভেনিজুয়েলায় নানান টুলস ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও সেই দেশগুলো স্বৈরাচারের সীমা অতিক্রম করে কিনা তা বিতর্কিত। সাম্প্রতিক উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে জর্জিয়া,হন্ডুরাস, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ফিলিপাইন এবং শ্রীলঙ্কা। পাকিস্তান এবং থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী সামরিক বাহিনীর অতিরিক্ত জটিলতার সাথে করে থাকে।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরপরই গণতন্ত্রের বৈশ্বিক গতি তুঙ্গে । অন্য কথায়, আজকের স্বৈরাচারীরা অপরাজেয় নয়। বৈধতার হাওয়া বজায় রাখার জন্য অনেকেই গভীর ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের উপর নির্ভর করে। সমাজের উদার গণতন্ত্রের বৃহত্তর সম্প্রদায়ের দ্বারা সমর্থিত হয়ে নির্ধারিত অভ্যন্তরীণ বিরোধী ফ্রন্টগুলি বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ প্রবণতাকে তরান্তিত করে। এদিকে গণতন্ত্রের গুণমান রক্ষা করতে না পারায় জনসমর্থন নষ্ট করেছে  আফ্রিকার প্রাচীনতম বহুদলীয় ব্যবস্থা বতসোয়ানা মরিশাসে, মঙ্গোলিয়ায়।  নিরপেক্ষ অনুশীলনের অভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্নীতিগ্রস্ত এবং আধিপত্যবাদী শাসক দলগুলি গণতান্ত্রিক পতনের তত্ত্বাবধান করেছে, ফলে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলি উভয়ের জন্যই মারাত্মক ধাক্কা খেয়েছে। গেল জুলাই মাসে একটি চুরির নির্বাচনের পর ভেনেজুয়েলায় স্বাধীনতার সংগ্রাম বৃদ্ধি পায় এবং বিরোধীরা তার ভূমিধস বিজয়ের অপ্রতিরোধ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে। আদালত ২০২৩ সালের মে সংসদীয় নির্বাচনে বিজয়ীকে ক্ষমতা গ্রহণে বাধা দেওয়ার পর থেকে থাইল্যান্ডের সামরিক সমর্থিত সরকার বৈধতার গভীর সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। তুরস্কের নির্বাচনী স্বৈরাচার ক্রমবর্ধমানভাবে জীর্ণ এবং ভঙ্গুর দেখায় দেশটির দীর্ঘ শাসক-রিসেপ তাইয়িপ এরোগান মে ২০২৩ সালের রাষ্ট্রপতি ভোটে একটি বর্ণহীন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সবেমাত্র জয়লাভ করে। এদিকে জাতীয় নির্বাচনে অত্যাশ্চর্য বিরোধীদের বিজয় পোল্যান্ডে গণতন্ত্রের চর্চার পুনরুদ্ধার এবং গুয়াতেমালায় স্বৈরাচার ও দুর্নীতির সমস্যায় জর্জরিত ইতিহাসকে অতিক্রম করার ঐতিহাসিক সুযোগ নিয়ে এসেছে। এবং মালশিয়ার বিগত দুটি নির্বাচন চক্র একটি স্থিতিশীল প্রতিযোগিতামূলক কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার ছয় দশক পরে গণতন্ত্রের দিকে পরিবর্তনের পরামর্শ দেয়। ছয় দশকের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভোটাররা প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেন।