ক্রমাগত দূষণে পৃথিবী যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে, সে কথা সুবিদিত। দূষণের হাত থেকে পরিবেশ বাঁচানোর জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে যে সব বড় পরিকল্পনার কথা শোনা যায়, তারই একটি হল সবুজ বনায়ন বা ‘গ্রিন কেমিস্ট্রি’ পরিকল্পনা। এক কথায়, বনায়ন বিদ্যাকেই কাজে লাগিয়ে ক্ষতি কারক বনায়নিক পদার্থের হাত থেকে পরিবেশকে বাঁচানোই হল এর মূল উদ্দেশ্য। খাবার-দাবার, জামা-কাপড়, ওষুধ, প্রসাধনী থেকে শুরু করে জীবন যাত্রায় যে অসংখ্য কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থের দরকার, তাদের প্রস্তুতি, ব্যবহার এবং আবর্জনা হিসাবে বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে একটা বিশাল মাত্রার দূষণ ঘটে। এই দূষণকে গোড়াতেই বিনাশ করা, অর্থাৎ দূষণ ঘটানোর মত পদার্থ যাতে তৈরিই না হয়, সেই চেষ্টা করাই হল এই পরিকল্পনার গোড়ার কথা।
১৯৯০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-এ ‘পলিউশন প্রিভেনশন অ্যাক্ট’ পাস হয়। তখন থেকেই ‘এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন এজেন্সি’-র উদ্যোগে এই সবুজ বনায়ন পরিকল্পনা শুরুহয়েছে। পোশাকি ভাষায় বললে শরীর এবং পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর পদার্থের প্রভাব ব্যাহত করতে পারে বা পরিবেশে তাদের পরিমাণ কমাতে পারে তেমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ এবং রাসায়নিক পদ্ধতির উদ্ভাবন, উন্নয়ন এবং প্রয়োগের কৌশলই সবুজ বনায়ন।
সবুজ উদ্ভিদ বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাউড আর পানি ব্যবহার করে, স্রেফ সূর্যের আলোকে কাজে লাগিয়ে শর্করা জাতীয় খাবার তৈরি করে আর উপজাত হিসাবে বাতাসে ছাড়ে অক্সিজেন। পরিবেশের দিক থেকে একটি আদর্শ বিক্রিয়া, যাতে দরকারি জিনিসটা তৈরির সঙ্গে সঙ্গে একটা ক্ষতিকর গ্যাস বিনষ্ট হয়, আবার একটা উপকারী গ্যাসও তৈরি হয়। বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও যেসব বিক্রিয়া পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় সেগুলো যেন এই রকমের হয় এটাই সবুজ বনায়নের উদ্দেশ্য। সবুজ বনায়ন নামটা তাই দু’ভাবে অর্থবহ; সবুজ উদ্ভিদের মত বনায়ন বা যে বনায়ন পৃথিবীকে সবুজ করে রাখেবে, দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এ অভিযানের দুজন পথিকৃৎ পল আম্লান এবং জন ভার্নার ১২টি সূত্রে এর রূপরেখাটা মোটামোটি স্পষ্ট করেছেন। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়েও কয়েকটা কথা বলা যায়। যেমন, উৎপাদনের পদ্ধতি হবে এমন, যাতে কাঁচামাল যতটা সম্ভব বেশি মাত্রায় উৎপাদনের সরাসরি কাজে লেগে যায়, কোনো পর্যায়েই কোনো ক্ষতিকারক পদার্থ তৈরি না হয়, যতটা সম্ভব নিরাপদ পদার্থ নিয়ে কাজ শুরুকরা যায়, শক্তির অপচয় না ঘটে ইত্যাদি।
সবচেয়ে বড় কথা, কোনো একটা লম্বা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যে সব পর্যায়ে ক্ষতিকারক পদার্থ তৈরি হয়, বা ব্যবহৃত হয়, সে জায়গাগুলো সংশোধন করে অন্য কোনোভাবে এগুতে হবে। যেমন, এখন অনেক বিক্রিয়াকে মাইক্রোওয়েভ-এর সাহায্যে খুব তাড়াতাড়ি ঘটানো হচ্ছে। এতে কাজটা তাড়াতাড়ি হচ্ছে, তেমনই রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারও কমছে; তাই এটা সবুজ রসায়ানুগ পদ্ধতি। সূর্যের আলোকে কাজে লাগালে আরো ভালো। সে চেষ্টাও হচ্ছে। তেমনই কোনো বিক্রিয়ার উপজাত পদার্থও এমন হওয়া উচিত, যাতে তারা খুব কম পরিমাণে তৈরি হয়, কিংবা তারা ধীরে ধীরে এমনিই নষ্ট হয়ে যায়, দুটো উপজাত পদার্থ পরস্পরকে ধ্বংস করে দেয়-এ রকম ধারণা।
যদি এ রকম পদার্থের মধ্যে ক্ষতিকর কিছু থেকেও যায়, তবে তাকে পরিবেশে ফেলে দেওয়ার আগে তার ক্ষতিকর মাত্রা যতটা সম্ভব কমিয়ে ফেলতে হবে। এ ছাড়া বর্জ্য পদার্থের পুনর্ব্যবহারও খুব জরুরী। তবে এ সব কিছুই করতে হবে এমনভাবে, যাতে উৎপাদনের খরচ সীমিত থাকে;তা না হলে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা যাবে না। অর্থাৎ, সবুজ অভিযান একই সঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাবে। কথাগুলো শুনতে যত সহজ , বাস্তবে ততই কঠিন। রোজ যে লক্ষ লক্ষ রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে চলে, তাদের বিশ্লেষণ করে ক্ষতিকর পদার্থটিকে খুঁজে নিয়ে বিকল্প পদ্ধতির নকশা করা মুখের কথা নয় ! তার চেয়েও কঠিন হল যারা এ পদ্ধতিগুলো কাজে লাগাচ্ছেন তাঁদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা, যাতে প্রস্তাবিত বিকল্পগুলো তারা স্বীকার করে নেন। তোড়জোড় শুরু হয়েছে সাড়ম্বরে। রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি শুধু এ ধরণের গবেষণা পত্রের জন্য ‘গ্রিন কেমিস্ট্রি’ নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ করছে গত দশ বছর ধরে, আর এজন্য বিজ্ঞানের সর্বে্চ্চা পুরষ্কার নোবেল-ও ২০০৫ সালে এমন দুজন পেয়েছেন, যারা এ বিষয়ে কাজ করেন। ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ থেকে ‘গ্রিন কেমিস্ট্রি’ বিষয়ে গবেষণার জন্য বিশেষ অনুদান দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশ নিয়ে পৃথিবীরসব মানুষ কম বেশি চিন্তিত। আমাদের দেশেও পন্ডিত বিজ্ঞানীরা আছেন। এ ব্যাপারে তাদেরকে চিন্তা ভাবনা করতে হবে। আর সরকারকে আন্তরিকতার সাথে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। এমন কোন কাজই নেই-যা চেষ্টা করলে করা যায় না। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনার একান্তই প্রয়োজন আমরাত সার্বিক সহযোগীতার জন্য প্রস্তুত।