আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়টা যেন ঘোষণা হয়েও হলো না। বিজয় দিবসে দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়। বলা যায়, জনপরিসরে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়ের প্রত্যাশা থাকলেও তিনি নির্বাচনের দুটো সময় দিলেন।
তিনি অবশ্য এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন– ‘যদি অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি তাহলে আরও অন্তত ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে’ (সমকাল, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪)।
৮ আগস্ট শপথ গ্রহণের পরপরই অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। প্রধানত নির্বাচন কবে হবে– তা জানাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। প্রধান উপদেষ্টা এ নিয়ে প্রথম দিকে কার্যত কিছু না বললেও পরবর্তী সময়ে একাধিক উপদেষ্টা বলেছিলেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে দেশ একটা নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার পাবে। তারা অবশ্য একই সঙ্গে এও বলেছিলেন, নির্বাচনের সময় নিয়ে কথা বলার এখতিয়ার একমাত্র প্রধান উপদেষ্টার। তিনিই তা পরিষ্কার করবেন। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর ছাড়াও ইতোমধ্যে ড. ইউনূস জাতির উদ্দেশে ১৭ নভেম্বর ভাষণ দিয়েছেন। সেখানেও নির্বাচনের সময়টি পরিষ্কার হয়নি, যদিও এটুকু স্পষ্ট যে, নির্বাচনটি হয়তো বেশি দিন ঝুলে থাকবে না।
শুধু বিএনপি কেন; দলটির মিত্র ১২ দল এবং গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম শরিক বামপন্থি দলগুলোও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ বা ‘রোডম্যাপ’ না থাকায় প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করেছে। ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য এক বা দেড় বছরের কথা এসেছে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে। তবে তারাসহ অনেক দল ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন চায়।
এই মুহূর্তে দেশের প্রধান দল বিএনপির নেতারা সেই আগস্ট থেকেই নির্বাচনের রোডম্যাপ বা পথনকশা দাবি করে আসছেন। তারাও প্রধান উপদেষ্টার দুটো ভাষণের পর প্রায় একই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। ১৭ নভেম্বরের মতো ১৬ ডিসেম্বরের ভাষণেও তাদের প্রতিক্রিয়ার সারমর্ম হলো– প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের ধারণা পেলাম, রোডম্যাপ পাইনি। ১৮ ডিসেম্বর এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আমরা পর্যবেক্ষণ করে ও বিশ্লেষণ করে বের করেছি, এ ক্ষেত্রে সংস্কারে চার থেকে পাঁচ মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়’ (প্রথম আলো, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪)।
শুধু বিএনপি কেন; দলটির মিত্র ১২ দল এবং গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম শরিক বামপন্থি দলগুলোও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ বা ‘রোডম্যাপ’ না থাকায় প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করেছে। ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য এক বা দেড় বছরের কথা এসেছে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে। তবে তারাসহ অনেক দল ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন চায়। ১৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রথম আলোর একই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি রোডম্যাপ তৈরি করা সম্ভব।
বিএনপিসহ দেশের উল্লেখযোগ্য দলগুলো যেখানে ২০২৫ সালেই নির্বাচন চায়, সেখানে নির্বাচনকে ২০২৬ সালে নিয়ে যাওয়া তারা মেনে নেবে না। এটাই স্বাভাবিক।
১৭ ডিসেম্বর সমকালের একটি প্রতিবেদনে বিএনপির কোনো কোনো নেতার কথায় কারণটাও উঠে এসেছে। তাদের মতে, সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করা পর্যন্ত নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। তাদের সন্দেহ, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী শিক্ষার্থীরা যে রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে, তা ভোটের জন্য প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে।
বাস্তবেও বিএনপি ও তার সমমনাদের এসব শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ‘রাজনৈতিক উদ্যোগ’ বলে ঘোষিত জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের এবং ফ্যাসিবাদীর যারা দোসর রয়েছে, তাদের বিচারের আগে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না (প্রথম আলো, ১৭ ডিসেম্বর)।’
এমনকি বিএনপির আন্দোলনকালীন মিত্র জোট গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম ফেসবুকে রীতিমতো প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময়ে নির্বাচন রুখে দাঁড়াতে আহ্বান জানিয়েছেন। তারা চান উপযুক্ত সংস্কার শেষে সংবিধান পরিষদের নির্বাচন, যা সব দিক থেকেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে আলাদা। জামায়াতে ইসলামীও বরাবরের মতোই মাঝামাঝি পথ বেছে নিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণামতো জামায়াত ‘অল্প নাকি প্রত্যাশিত’ সংস্কার চায়– সমকালের এমন এক প্রশ্নে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘কিছু বিলম্ব জাতি মেনে নেবে, যদি নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হয়।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাম্প্রতিক সম্পর্কও বিএনপির শঙ্কাকে ভিত্তি দিতে পারে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েক স্থানে বিএনপি যেমন জাতীয় নাগরিক কমিটিকে সভা-সমাবেশ করতে বাধা দিয়েছে, তেমনি নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও বিএনপির বিরুদ্ধে ‘আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন’ চেষ্টার মতো গুরুতর অভিযোগ করে চলেছেন। বৈষম্যবিরোধীদের ও শিবিরের একাধিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাওয়ার পরও ছাত্রদল নেতারা অংশগ্রহণ করেননি। একই সঙ্গে ছাত্রদল বিভিন্ন বাম ছাত্র সংগঠনসহ ২৮টি সংগঠনকে নিয়ে মতবিনিময় করলেও সেখানে ছাত্রশিবির ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের আমন্ত্রণ জানায়নি। এগুলোর কোনোটাই গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর ঘনিষ্ঠ আন্তঃসম্পর্কের ইঙ্গিত করে না।
এমন আশঙ্কা কি অমূলক যে, নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে, ততই এই দল ও সংগঠনগুলোর মধ্যে তিক্ততা ও টানাপোড়েন বাড়তে থাকবে, যা এমনকি দেশকে দীর্ঘস্থায়ী এক অনাকাঙ্ক্ষিত বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঠেলে দিতে পারে? এ অবস্থায় দেশের সংকটগ্রস্ত অর্থনীতিরই বা কী দশা দাঁড়াবে, তা কি অনুমান করা কঠিন? পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনও যে ভঙ্গুর দশায় আছে, তাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণও দুরূহ হতে পারে।
অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি ভবিষ্যতে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসার পথও বন্ধ করা দরকার– সন্দেহ নেই। কিন্তু কাজটি শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের একক ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। নির্বাচন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার– এটা কখন ও কোন পর্যায়ে হবে, তা ছাত্র নেতৃত্বসহ জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের সব রাজনৈতিক শক্তির ঐকমত্যের ভিত্তিতে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যে ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথা, তাদের প্রধানদের নিয়ে তাঁর নেতৃত্বে একটি ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ গঠন করা হবে। এই কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতে ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্যোগ নেবে এবং এ ব্যাপারে পরামর্শ চূড়ান্ত করবে। নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন বিষয়ে ঐকমত্য তৈরির ক্ষেত্রে এটা ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু এ পদক্ষেপ গ্রহণে যদি কোনো কারণে কালক্ষেপণ হয়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে, যা হবে সত্যিই বিপর্যয়কর।
মনে রাখতে হবে, দেশে একটি টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি বিষয়। তার জন্য প্রয়োজন একটা স্বচ্ছ, অবাধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ তৈরি। এ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
সূত্র : সমকাল