বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হওয়ার প্রচারণা চালানোর সময় এবং ইউপিএকে ক্ষমতা থেকে সরানোর লক্ষ্যে নরেন্দ্র মোদি বেশ আগে থেকেই মনমোহন সিংকে লক্ষ্যবস্তু করেন। ২০১২ সালের অক্টোবরে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন একটি সমাবেশে তিনি মনমোহন সিংকে ‘মৌন মোহন সিং বলে অভিহিত করেন। প্রায় এক বছর পর, ২০১৩ সালের মার্চে নয়াদিল্লিতে বিজেপি জাতীয় পরিষদের বৈঠকে বক্তৃতা করার সময় মোদি সিংকে ‘নাইট ওয়াচম্যান’ বলে আখ্যায়িত করেন।
এরপরের মাসে, বিজেপি কর্মীদের উদ্দেশে বক্তৃতায় মোদি বলেন, ‘যদি আপনি ১০০ কংগ্রেস কর্মীর কাছে জানতে চান তাদের নেতা কে, কেউই মনমোহন সিংয়ের নাম করবে না। অথচ তিনিই প্রধানমন্ত্রী।...এমন একজন প্রধানমন্ত্রী কীভাবে জাতিকে নেতৃত্ব দেবেন?’
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংয়ের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পর, রাজ্যসভায় মোদি তাঁর বক্তৃতায় মনমোহনের কোন দুর্নীতির রেকর্ড না থাকা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘মনমোহন সিংয়ের বিরুদ্ধে একটিও দুর্নীতির অভিযোগ নেই, তা–ও তাঁর সময়ই কংগ্রেস সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার। বাথরুমে রেইনকোট পরে গোসল করার কৌশল ড. মনমোহন সিংয়ের কাছ থেকে শেখা যেতে পারে।’ কংগ্রেসসহ বিরোধীরা এরপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওয়াকআউট করে।
২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর, গুজরাট নির্বাচনের প্রচারণার সময়, মোদি ইঙ্গিত দেন যে মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে রাজ্যের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে। এর প্রতিক্রিয়ায় সিং বলেন, ‘আমি গভীরভাবে ব্যথিত এবং মর্মাহত এমন মিথ্যা অপপ্রচার এবং অমূলক অভিযোগে,...তা–ও একজন প্রধানমন্ত্রী দ্বারা।’
২০১৪ সালের ৪ জানুয়ারি, লোকসভা নির্বাচনের আগে এক সংবাদ সম্মেলনে মনমোহন সিংহ বলেছিলেন, ‘নরেন্দ্র মোদির গুণাবলি নিয়ে আলোচনা না করেও আমি বিশ্বাস করি, শ্রী নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে তা দেশের জন্য বিপর্যয়কর হবে।’
২০১৪ সালে ক্ষমতা হারানোর পর, ২০১৮ সালের নভেম্বরে মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে ইন্দোরে একটি সংবাদ সম্মেলনে মনমোহন সিংকে এই মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি অত্যন্ত কঠিন শব্দ ব্যবহার করেছিলাম। তা আমার উচিত হয়নি। আমি তা আর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। তবে সময় বেশি দূরে নয়, যখন সাধারণ জনগণ মোদিজির প্রণীত সরকারি নীতির কার্যকারিতা সম্পর্কে নিজস্ব মতামত জানাবেন।’
মনমোহন সিংহ তাঁর উত্তরসূরির অর্থনৈতিক নীতিগুলোরও তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। ২০১৬ সালের নভেম্বরে সংসদে নোট বাতিল নিয়ে বিতর্কের সময় তিনি বলেন, ‘যেভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে তা একটি বিশাল ব্যবস্থাপনা ব্যর্থতা...সংগঠিত লুটপাট ও বৈধ ডাকাতি।’
এর এক বছর পর, ২০১৭ সালের নভেম্বরে আহমেদাবাদে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, নোট বাতিল এবং পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) দেশের অর্থনীতির জন্য ‘যমজ আঘাত’।
২০১৮ সালে কাঠুয়ায় আট বছরের এক মেয়ের ধর্ষণ ও হত্যা এবং উন্নাওতে এক বিজেপি বিধায়কের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগব ওঠে। এই বিষয়ে এপ্রিলে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ মনমোহন সিং একটি সাক্ষাৎকারে নরেন্দ্র মোদির ‘নীরবতা’ নিয়ে সমালোচনা করে বলেছিলেন, মোদী ‘আমাকে যে আরও বেশি কথা বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেটা তাঁর নিজেরই অনুসরণ করা উচিত।’
বিজেপি যখন তাকে ‘মৌন মোহন সিং’ বলে ব্যঙ্গ করেছিল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি জীবনে এমন মন্তব্যের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
২০১৯ সালের মে মাসে পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মনমোহন সিং এনডিএ সরকারের দেশ চালানোকে ‘শাসন এবং জবাবদিহির ব্যর্থতার একটি করুণ গল্প’। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে, জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের প্রাক্কালে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, দিল্লি তার সার্বভৌম এবং অর্থনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি শান্তির আহ্বান জানিয়ে সঠিক কাজ করেছে।
বলেছিলেন, তিনি ‘ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্নের চেয়ে বেশি আশাবাদী’। তবে সেই আশাবাদ নির্ভর করছে ভারতের ‘সম্প্রীতিময় সমাজ’ হিসেবে টিকে থাকার ওপর।
সাম্প্রতিক নির্বাচনে মোদি বারবার মনমোহন সিংয়ের ইউপিএ সরকারকে নিশানা করেছিলেন। মোদির অভিযোগ ছিল যে কংগ্রেস তাদের শাসনকালে সংখ্যালঘুদের জন্য সরকারের বাজেট বরাদ্দের ১৫ শতাংশ দিতে চেয়েছিল।
রাজস্থানে এক ভাষণে মোদি ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের এক সভায় মনমোহন সিংয়ের বক্তব্য উল্লেখ করে বলেছিলেন যে কংগ্রেস সরকার দেশের সম্পদের প্রথম অধিকার মুসলমানদের দিতে চেয়েছিল। তিনি দাবি করেছিলেন যে কংগ্রেসের ইশতেহার ইঙ্গিত দেয় যে তাদের নেতৃত্বাধীন সরকার ‘আমাদের মায়েদের ও বোনদের জমানো সোনা’ নিয়ে গিয়ে বিলিয়ে দিতে চায়।
শেষ পর্যন্ত স্বল্পভাষী মনমোহন সিং পর্যন্ত মোদিকে নিশানা করে বলেছিলেন, মোদি নির্বাচনী প্রচারে এমন ‘বিদ্বেষপূর্ণ’ এবং ‘বিভাজনমূলক’ ঘৃণাত্মক ভাষণ দিয়েছেন, যা জনজীবনের মর্যাদা এবং প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদাকে খাটো করেছে। এর আগে কোনো প্রধানমন্ত্রী একটি নির্দিষ্ট সমাজগোষ্ঠী বা বিরোধী পক্ষকে লক্ষ্য করে এমন বিদ্বেষপূর্ণ, অসংসদীয় এবং অমার্জিত ভাষা ব্যবহার করেননি।
নির্বাচনের সময় পাঞ্জাবের ভোটারদের উদ্দেশে মনমোহন সিং বলেছিলেন, ‘গত ১০ বছরে (মোদি শাসনকালে), বিজেপি সরকার পাঞ্জাব, পাঞ্জাবি এবং পাঞ্জাবিপনাকে কলঙ্কিত করতে কোনো কসরত রাখেনি।’
তিনি দিল্লির সীমান্তে কৃষকদের বছরব্যাপী আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেন, ‘কৃষকদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত লাঠিচার্জ এবং রবার বুলেট যথেষ্ট ছিল না বলে মনে হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজে সংসদে আমাদের কৃষকদের “আন্দোলনজীবী” এবং “পরজীবী” বলে আক্রমণ করেছিলেন।’
লালমণি ভার্মা সহকারী সম্পাদক, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস