যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়েকবারই গ্রিনল্যান্ড দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি তিনি আবারও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেবে বলে তিনি মনে করেন। কারণ হিসেবে ‘অর্থনৈতিক নিরাপত্তার’ কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। যদিও ডেনমার্কের এ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে বলে দিয়েছে, এ দ্বীপ বিক্রি হবে না।
উত্তর আমেরিকার সুদূর উত্তর-পূর্বে সুমেরু অঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। দ্বীপটির এ বিপুল সম্পদ অনেকের আগ্রহের জায়গা। তবে এর খনিজ সম্পদের বেশির ভাগ অব্যবহৃত অবস্থায় আছে।
আমারক মিনারেলস নামের খনি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী এলডুর ওলাফসন মনে করেন, গ্রিনল্যান্ডের প্রচুর খনিজ সম্পদ এখনো অব্যবহৃত থাকায় দ্বীপাঞ্চলটি একটি অতুলনীয় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের আগামী কয়েক দশকে যে পরিমাণ খনিজ সম্পদের প্রয়োজন হবে, তার সবটাই সরবরাহ করতে পারবে গ্রিনল্যান্ড। এমন সক্ষমতার ক্ষেত্রে এর ধারেকাছে কেউ নেই।
সম্প্রতি বিবিসির একজন প্রতিবেদক গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণ প্রান্তের একটি সোনার খনি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। আমারক মিনারেলস নামের খনি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী এলডুর ওলাফসনের সঙ্গী হয়েছিলেন তিনি। যন্ত্রচালিত একটি নৌকায় করে তাঁরা যাত্রা করেন। পথে ওলাফসন ইশারায় দূরের একটি জায়গা দেখিয়ে বলেন, ‘ওই যে অনেক উঁচু পর্বতগুলো দেখা যাচ্ছে, তা মূলত সোনাসমৃদ্ধ।’
নৌকায় দুই ঘণ্টা ভ্রমণের পর তাঁরা নালুনাক পর্বতের পাদদেশে একটি দুর্গম উপত্যকায় পৌঁছান। সেখানে কোম্পানিটি সোনা অনুসন্ধান করছে। অন্যান্য মূল্যবান খনিজ সম্পদের জন্য আশপাশের পার্বত্য এলাকা ও উপত্যকায়ও অনুসন্ধান চালাচ্ছে তারা। ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি জায়গাজুড়ে অনুসন্ধান চালানোর অনুমতি আছে তাদের।
ওলাফসন বলেন, ‘আমরা এখানে তামা, নিকেল ও বিরল মৃত্তিকা ধাতুগুলো খুঁজছি। এগুলোর অবস্থান অজানা এবং এখনো মনে করা হচ্ছে, এগুলো একাধিক জায়গায় সঞ্চিত আছে।’
খনি কোম্পানিটির বেজক্যাম্পে অস্থায়ীভাবে কিছু ভবন তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া কিছু তাঁবুও খাটানো আছে। এসব ভবন ও তাঁবুতে কোম্পানির শতাধিক কর্মী থাকেন। তাঁদের কেউ গ্রিনল্যান্ডের, কেউ অস্ট্রেলিয়ার, আবার কেউ যুক্তরাজ্যের সাবেক খনিশ্রমিক। বেজক্যাম্প থেকে একটি সড়ক উপত্যকার দিকে উঠে গেছে। সেখান থেকে গাড়িতে করে বিবিসির প্রতিবেদক সোনার খনিটিতে যান।
সাদা রঙের খনিজ পদার্থ কোয়ার্টজের একটি স্তর এবং একটি রেখা দেখিয়ে ওলাফসন বলেন, ‘এখানে দেখুন, পুরো জায়গায় সোনা, সোনা আর সোনা। এটা কি অস্বাভাবিক নয়?’
আমারক ২০১৫ সালে এ খনি কিনেছে। এরপর গত দশকের বেশির ভাগ সময় তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। তবে তখন সোনার দাম কমে যাওয়ায় এবং খনি পরিচালনার খরচ বেড়ে যাওয়ায় এটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। আমারক কর্তৃপক্ষের দৃঢ়বিশ্বাস, খনিটি এখন লাভজনক হবে। চলতি বছর উত্তোলন বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে তারা। কোম্পানিটি ইতিমধ্যে সেখানে আকরিক চূর্ণ করা ও মূল্যবান ধাতু পরিশোধন করে সোনার বারে পরিণত করার জন্য একেবারে নতুন একটি প্রক্রিয়াকরণকেন্দ্র তৈরি করেছে।
ওলাফসনের আশা, প্রতি মাসে তাঁরা এখান থেকে স্যুটকেসভর্তি সোনা অথবা জাহাজে করে আকরিক পাথর নিয়ে যেতে পারবেন।
ওলাফসন মনে করেন, গ্রিনল্যান্ডের প্রচুর খনিজ সম্পদ এখনো অব্যবহৃত থাকায় দ্বীপাঞ্চলটি এক অতুলনীয় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের আগামী কয়েক দশকে যে পরিমাণ খনিজ সম্পদের প্রয়োজন হবে, তার সবটাই সরবরাহ করতে পারবে গ্রিনল্যান্ড। এমন সক্ষমতার ক্ষেত্রে এর ধারেকাছে কেউ নেই।
কেন সেখানকার সম্পদের প্রতি আগ্রহ
স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের অংশ। তবে গ্রিনল্যান্ড কর্তৃপক্ষ নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর ব্যবস্থাপনা নিজেরাই করে থাকে। বর্তমানে পুরো দ্বীপ এলাকায় মাত্র দুটি সক্রিয় খনি আছে।
বিরল মৃত্তিকা ধাতুর অষ্টম বৃহত্তম মজুত এ দ্বীপে। এ বিরল ধাতুগুলো মুঠোফোন থেকে শুরু করে ব্যাটারি ও বৈদ্যুতিক মোটর তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া লিথিয়াম ও কোবাল্টের মতো অন্য গুরুত্বপূর্ণ ধাতুরও বিশাল মজুত এখানে। আছে তেল ও গ্যাসও। তবে দ্বীপটিতে নতুন খননকাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেখানকার গভীর সমুদ্রে খননকাজ চালানোর অনুমতিও নেই।
গ্রিনল্যান্ডের ব্যবসায়িক সংগঠন বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ক্রিশ্চিয়ান কিল্দসেনের মতে, বর্তমান বিশ্বের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিই গ্রিনল্যান্ডের প্রতি আগ্রহ বাড়াচ্ছে।
চীনে বিরল মৃত্তিকা ধাতুর সবচেয়ে বড় মজুতের অবস্থান থাকার কথা উল্লেখ করে কিল্দসেন বলেন, পশ্চিমারা বিকল্প সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায়। আর এ কারণে গ্রিনল্যান্ডের খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। চীনও এখানে জড়াতে চায়, তবে এখানে তাদের উপস্থিতি সীমিত।
সম্প্রতি রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রিনল্যান্ডের বিরল মৃত্তিকা ধাতুগুলো চীনা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি না করতে অস্ট্রেলিয়ার একটি খনি কোম্পানির কাছে তদবির করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
গ্রিনল্যান্ডের ব্যবসা, বাণিজ্য ও কাঁচামালবিষয়ক মন্ত্রী নাজা নাথানিয়েলসেন বলেন, পাঁচ বছর বা এর বেশি সময় ধরে অঞ্চলটির খনিজ সম্পদের প্রতি আগ্রহ বাড়তে দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা জলবায়ু সংকটের একটি কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছি। আমরা এর সমাধানেরও অংশ হতে চাই।’
গ্রিনল্যান্ডজুড়ে ১০০টি কোম্পানিকে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের মজুতগুলো অনুসন্ধানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যেসব বিদেশি কোম্পানি অনুমতি পেয়েছে, তার বেশির ভাগই ব্রিটিশ, কানাডীয় ও অস্ট্রেলীয়। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শুধু একটি কোম্পানি আছে। তবে মজুতের স্থানগুলো সম্ভাব্য খনিতে পরিণত করতে আরও অনেক পদক্ষেপ নিতে হবে।
গ্রিনল্যান্ডবাসীর চাওয়া
নিজ সম্পদসমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও গ্রিনল্যান্ডের অর্থনীতি এখনো সরকারি খাত ও মৎস্যসম্পদনির্ভর। ডেনমার্ক সরকারের ৬০ কোটি ডলার মূল্যের ভর্তুকির ওপরও নির্ভর করে থাকে অঞ্চলটি। গ্রিনল্যান্ডের বার্ষিক জিডিপির পরিমাণ ৩০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি।
গ্রিনল্যান্ডের রাজনীতিবিদদের আশা, খনি থেকে তাঁদের যে রাজস্ব আয় হবে, তা ডেনমার্ক থেকে পাওয়া বার্ষিক ৬০ কোটি ডলারের ভর্তুকির ওপর তাদের নির্ভরতা কমিয়ে দেবে, তাঁদের স্বাধীন হওয়ার প্রচেষ্টাও জোরাল করতে সাহায্য করবে; যদিও গ্রিনল্যান্ড এখন পর্যটন খাত থেকেই বেশি অর্থ উপার্জন করছে।
গ্রিনল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কটিক সোশ্যাল সায়েন্সের প্রধান হাভিয়ে আরনট বলেন, ‘গ্রিনল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে খনি পরিচালনা করাটা জরুরি। তবে প্রায়োগিক দিক বিবেচনা করলে আপনারা দেখবেন, খুব কমসংখ্যক খনি কোম্পানি ছাড়পত্র পেয়েছে।’
গ্রিনল্যান্ডের ব্যবসা, বাণিজ্য ও কাঁচামালবিষয়ক মন্ত্রী নাজা নাথানিয়েলসেনও কথাটি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘যদিও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউর সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠছে, তবে আমরা এখনো এ খাতে (খনিজ অনুসন্ধান, খনন ও খনিজ সম্পদ উত্তোলন) প্রচুর পরিমাণে অর্থের প্রবাহ দেখিনি।’ তিনি আশা করেন, আগামী এক দশকের মধ্যে আরও তিন থেকে পাঁচটি খনি চালু হবে।
অবশ্য দুর্গম অবস্থান ও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে গ্রিনল্যান্ডে খনির কার্যক্রম চালানো সহজ নয়। এ দ্বীপের ৮০ শতাংশই বরফের চাদরে ঢাকা। এখানকার পর্বতগুলো দুর্গম ও বসতি এলাকাগুলোর মধ্যে কোনো রাস্তা নেই।
এ ছাড়া খনি পরিচালনার খরচের তুলনায় বিশ্ববাজারে ধাতুর মূল্য কম হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের অনেকে পিছু হটেছেন। কেউ কেউ অবশ্য এ খাতে অগ্রগতির ধীরগতির জন্য আমলাতন্ত্রিক জটিলতা দায়ী বলে মনে থাকেন। এ অঞ্চলে পরিবেশসংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধ জারি আছে ও কাজের অনুমতি পেতে অনেক সময় লাগে।
মন্ত্রী নাথানিয়েলসেনের মতে, স্থানীয় মানুষের বেশির ভাগই খনিশিল্পকে সমর্থন করেন। এতে স্থানীয় অর্থনীতি জোরদার হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। কারণ, খনিগুলোয় কাজ করা বিদেশি কর্মীরা স্থানীয় দোকানপাটে বাজারসদাই করেন, খনিতে স্থানীয় লোকজন নিয়োগ পান, খনি কর্তৃপক্ষ তাদের কাজের জন্য স্থানীয় নৌকা বা হেলিকপ্টার ভাড়া করে।
অবশ্য দক্ষিণের বড় শহর কাকোরতোকের বাসিন্দা হেইদি মোরতেনসেনের কণ্ঠে সংশয়ের সুর শোনা গেল। নতুন খনিতে স্থানীয় লোকজন নিয়োগ পাবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
স্থানীয় শ্রমিক সংঘ এসআইকের প্রধান জেস বেরথেলসেনও স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, স্থানীয় লোকজন মনে করেন, খনি থেকে আয় হওয়া অর্থ দেশে থাকবে না। গ্রিনল্যান্ড এতে লাভবান হবে না।
তবে বেরথেলসেন নিজে চান এ শিল্পের প্রসার হোক। এমনটা চাওয়ার কারণ হিসেবে বলেন, ‘গ্রিনল্যান্ডের আরও আয় হওয়া দরকার। মাছ ধরা ছাড়া অন্য উৎস থেকে আয় হওয়া দরকার।’
গ্রিনল্যান্ড বিষয়ে ট্রাম্প চালটা কীভাবে চালবেন, তা নিশ্চিত নয়। তবে চলতি মাসের শুরুর দিকে গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিউট এগেদে বলেছেন, ‘আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করা দরকার।’ খনিশিল্পে যুক্ত হওয়া প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গ্রিনল্যান্ডের দরজা খোলা আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।