মিত্রদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অস্থির হয়ে উঠতে পারে!

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৮ মার্চ ২০২৫, ২১:৪২

ট্রাম্পের হাতে নতুন এক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত দেশগুলোর অঘোষিত নেতা হয়ে উঠেছিল। টানা আধিপত্য বহাল রাখতে আগ্রাসী ভূমিকায় ছিল আমেরিকা। বিশ্বের অঘোষিত মোড়ল হয়ে উঠা দেশটি খবরদারি করতে গিয়ে মূল্য দিতে হয়েছে। ইউরোপের বহু দেশ খবরদারীর অংশীজন হয়ে উঠলেও মাশুল গুনতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষকে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতি বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছেন। যেখানে নিজেরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, জোট ও মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে চলার জন্য আর ব্যক্তিগত মাশুল দিতে রাজী নয় ট্রাম্পের আমেরিকা।  

শুধু যুদ্ধই নয়, সামাজিক , রাজনৈতিক ও মানবিক কাজে আমেরিকা গত প্রায় এক শতক জুড়ে নিজেদের অর্থ অকাতরে ব্যয় করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের করের অর্থে ঘটে যাওয়া এ ধারাবাহিক নীতিমালার পরিবর্তন আসছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে এমন অবস্থানে ক্রমশ নিয়ে যাচ্ছেন, যা এ পরিবর্তনের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট করছে।

বৈশ্বিক নীতিতে বড় ধরনের এ পরিবর্তন আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, ভূরাজনীতি এবং কূটনীতির ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। এই পরিবর্তনগুলোর মূল লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা, প্রতিযোগিতা বাড়ানো এবং নিরাপত্তা নীতিকে শক্তিশালী করা।  

যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে নতুন শুল্কনীতি গ্রহণ করছে, যা প্রথমে চীনের ওপর আরোপিত হয়েছে। কানাডা, মেক্সিকো সহ  বিশ্বের বহু দেশই আমেরিকার সাথে শুল্ক সুবিধা পেয়ে ভারসাম্যহীন বাণিজ্যের সুবিধা গ্রহণ করে আসছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের সাথে শুল্কনীতি পুনঃনির্ধারণ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে  ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অনেকটাই বাধ্য করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশকে।

মার্কিন এই নীতির ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অস্থিরতা বাড়তে পারে এবং বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলায়  পরিবর্তন আনতে পারে। গবেষকদের মতে, সংরক্ষণবাদী নীতি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন শিল্পকে সহায়তা করতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে তা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাবও ফেলতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।  

মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমানোর পরিকল্পনা করছে, যা বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন কর হ্রাস নীতির ফলে কিছু আমেরিকান কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হবে, তবে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।  

নতুন প্রশাসন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক অবস্থান শক্তিশালী করছে। জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে, যা চীনের বিরুদ্ধে কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে। এছাড়া, ভারত এবং ইউরোপের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বের দিকেও নজর দেওয়া হচ্ছে ।  

নতুন অভিবাসন নীতির ফলে উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীদের জন্য অভিবাসন ব্যবস্থা সহজ হতে পারে, তবে সীমান্ত নীতি কঠোর হওয়ায় সাধারণ অভিবাসীদের জন্য চ্যালেঞ্জও বাড়তে পারে। মার্কিন প্রশাসনের এসব পরিবর্তন শ্রমবাজারে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা বাড়াতে পারে।  

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বৈশ্বিক নীতির ফলে অর্থনীতি, বাণিজ্য ও ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসছে। বিশেষ করে শুল্ক বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ শিল্প সুরক্ষা, সামরিক অংশীদারিত্ব এবং অভিবাসন নীতির পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে। এই নীতিগুলো একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে, অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতি এবং কূটনীতির ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।  

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তিনি পানামা খাল, গ্রিনল্যান্ড এবং এমনকি কানাডা সম্পর্কেও বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন, যা আমেরিকার ঐতিহ্যগত পররাষ্ট্রনীতির তুলনায় অনেক বেশি আগ্রাসী বলে মনে হচ্ছে।
ট্রাম্প দাবি করেছেন যে, পানামা খাল চীনের হাতে চলে গেছে এবং এটি মার্কিন স্বার্থের জন্য হুমকি। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এটি পানামাকে দিয়েছিল, চীনকে নয়, এবং এখন চীন এটি `অপব্যবহার' করছে।


গ্রিনল্যান্ড নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থান নতুন কিছু নয়। তিনি ২০১৯ সালেও এটি ক্রয় করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এবার তিনি বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এটি প্রয়োজন এবং সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, ডেনমার্কের এটি নিয়ন্ত্রণ করার বৈধতা আদৌ আছে কিনা।

তিনি এমনও বলেছেন, ডেনমার্ক যদি এটি না দেয়, তবে তিনি কোপেনহেগেনের ওপর উচ্চমাত্রার শুল্ক আরোপ করবেন। ট্রাম্প বলেছেন, কানাডা মার্কিন নিরাপত্তার ওপর নির্ভরশীল এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের জন্য শত শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। তিনি অভিযোগ করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র কানাডার কাছ থেকে বেশি কিছু পায় না, এবং তারা যা উৎপাদন করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তার কোনো প্রয়োজন নেই।


ট্রাম্পের এই মন্তব্যগুলো মূলত পুরনো মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটি সংস্করণ, যা ১৯শ শতকের মনরো ডকট্রিনের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এতে যুক্তরাষ্ট্র নিজের অঞ্চলে একচ্ছত্র প্রভাব বজায় রাখতে চায় এবং বৈশ্বিক বহুপাক্ষিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করতে চায়। এই অবস্থান আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বৈধ নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এবং এটি ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মিত্রদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে অস্থির করতে পারে।  

এই ধরনের বক্তব্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে এবং এটি বৈশ্বিক মিত্রদের কাছে মার্কিন নীতির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের এই মন্তব্যগুলো আন্তর্জাতিক কৌশলের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে এবং ঐতিহ্যগত জোটগুলোর ওপর কম নির্ভরশীল হতে চাইছে।