বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্ক নয়; এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতির এক জটিল জাল। এই সম্পর্কের প্রতিটি স্তর বিশ্লেষণে উঠে আসে সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার দ্বৈততা, যা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান শুধু সামরিক সহায়তায় সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রায় ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া, আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক লবিং, এবং মুজিবনগর সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া ছিল যুগান্তকারী। তবে, স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী সামরিক শাসনামলে সম্পর্কে খাঁজ দেখা দেয়।
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা ও অটল বিহারী বাজপেয়ীর আমলে গঙ্গা জলবণ্টন চুক্তি (১৯৯৬) এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি দুই দেশের সম্পর্কে নতুন গতি আনে।
-২০১০ সাল থেকে বর্তমানে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মোদি-হাসিনা যুগে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পায়। ল্যান্ড বাউন্ডারি চুক্তি (২০১৫), সীমান্ত হত্যা বন্ধ, এবং COVID-19 ভ্যাকসিন সহায়তা (২০২১) উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।
দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সহযোগিতা ও বৈষম্যের দ্বন্দ্বও ব্যাপক। ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার (২০২২-২৩ সালে রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলার), অথচ ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি $১৪ বিলিয়ন। এই বাণিজ্য বৈষম্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। ভারতের সীমান্তে বাংলাদেশি পণ্য (বস্ত্র, সিরামিক) আটকে রাখা, জটিল কাস্টম প্রক্রিয়া, এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় রেলওয়ে ভাড়া অসামঞ্জস্য (বাংলাদেশি ট্রেন ভারতে বেশি ভাড়া দেয়)।
যদিও রুপি-টাকা বিনিময় চুক্তি (২০২৩) বাণিজ্য সহজীকরণে ভূমিকা রাখছে। এছাড়া, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধা (আগরতলা-আখাউড়া রেললাইন) অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশ ভারত থেকে ১,১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে (২০২৩)। অদূরভবিষ্যতে ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১,৫০০ মেগাওয়াট সংযোজনের পরিকল্পনা। ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের ১৫ বছরের LNG সরবরাহ চুক্তি (২০২৩) জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় কোম্পানিগুলো (টাটা, এশিয়ান পেইন্টস) বাংলাদেশে ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। তবে, বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের ভারতে বাধার মুখে পড়তে হয়।
সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, উত্তর-পূর্ব ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী (ULFA, NSCN) নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক প্রায়ই উঠানামা করছে। ২০২২ সালে দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থার যৌথ অভিযানে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী জঙ্গি নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া হয়। ২০১৪-২০২০ সালে গুলিবিদ্ধ হয়ে ১,২০০ জনের বেশি বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। ভারতের ৩,৩০০ কিমি সীমান্ত কাঁটা তাঁরের বেড়া নির্মাণ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
ভারতের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন না পাওয়ায় বাংলাদেশ হতাশ। মিয়ানমারের সাথে ভারতের স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক (ক্যালাডান মাল্টি-মোডাল প্রকল্প) রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভারতের ভূমিকাকে জটিল করে তুলেছে।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের অমীমাংসিত ইস্যুগুলো জটিলতার মূল কারণ হয়ে উঠেছে।
তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি ইতিহাস দেখলে আমরা দেখতে পাই, ২০১১ সালের খসড়া চুক্তি অনুযায়ী, ভারত পাবে ৪২.৫%, বাংলাদেশ ৩৭.৫%, বাকি ২০% নদীর প্রবাহ সংরক্ষিত থাকবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতায় চুক্তি স্থবির। পরিণতিতে বাংলাদেশের রংপুর ও নীলফামারীতে ৬ লাখ হেক্টর কৃষিজমি পানির অভাবে ঝুঁকিতে থাকে সবসময়য়। গঙ্গা-যমুনা-বরাক নদী নিয়ে ৫৪টি চুক্তি ঝুলন্ত পড়ে আছে। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব এখনও বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা ও নদীভাঙনের কারণ। ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA, ২০১৯) বাংলাদেশি হিন্দুদের "অবৈধ অনুপ্রবেশকারী" হিসেবে চিহ্নিত করার আশঙ্কায় ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছে।
ভূ-রাজনৈতিক খেলায় চীন-ভারত প্রভাবের টানাপোড়েনে পড়েছে বাংলাদেশ। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ অনুযায়ী বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ৪০ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর এবং কর্ণফুলী টানেল উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে চীনের শক্তিশালী উপস্থিতি (সাবমেরিন ডকইয়ার্ড নির্মাণ) ভারতকে চাপে ফেলেছে।
ভারতীয় সিরিয়াল, সংগীত ও চলচ্চিত্র বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেললেও, সাম্প্রদায়িক হিংসা (২০২১ সালে বাংলাদেশে মূর্তি ভাঙচুর) সম্পর্কে ভারতীয় মিডিয়ার নেতিবাচক কভারেজ জনমতকে ক্ষুণ্ন করে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ১০,০০০ এর বেশি শিক্ষার্থী ভারতে উচ্চশিক্ষা নেন। ভারতের হাসপাতালগুলোতে বাংলাদেশি রোগীদের সংখ্যা বছরে ৫ লাখের বেশি, যা ভারতের অর্থনীতিতে ১ বিলিয়ন ডলারের যোগান দিয়ে থাকে।
ভারতকে Anti-Dumping Duty প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশি পণ্যে জিএসপি সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। ফার্মাসিউটিক্যালস, অটোমোটিভ ও টেক্সটাইল সেক্টরে যৌথ উদ্যোগ গড়ে তুলতে পারে উভয় দেশ।
জলবায়ু সহযোগিতা,ডিজিটাল পার্টনারশিপ, ইয়ুথ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম - এসবের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধির সুযোগও রয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মূল সাফল্য নির্ভর করে সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা এবং Win-Win কৌশলের উপর। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি, জলবায়ু স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য এই সম্পর্কের উন্নয়ন অপরিহার্য। রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি, প্রাজ্ঞ কূটনীতি ও জনগণের সম্পৃক্ততাই পারে এই সম্পর্ককে সহজ করে তুলতে।