বৈশ্বিক রাজনীতির মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্র একসময় ছিল নিঃসন্দেহে শীর্ষ শক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় তার আধিপত্য ছিল প্রশ্নাতীত। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ‘একমেরুকেন্দ্রিক’ বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র কেবল সামরিক বা অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, নীতিগত ও সাংস্কৃতিকভাবে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এক নাটকীয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে বৈশ্বিক পরিস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে তার ঐতিহাসিক প্রভাব ও কর্তৃত্ব হারাতে বসেছে। আর এই পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় অনুঘটক হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশটির নিজস্ব নীতিগত সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সময়কালের পদক্ষেপগুলো।
‘আমেরিকা ফার্স্ট’ শ্লোগানের আড়ালে যুক্তরাষ্ট্র তার বহু দশকের গৃহীত আন্তর্জাতিক দায়িত্ব থেকে একরকম সরে এসেছে। বহুপাক্ষিক সহযোগিতা, মানবিক উদ্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণ। এসব ক্ষেত্রেই দেশটি পিছিয়ে পড়েছে। এর ফলে বিশ্বব্যবস্থায় একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে অন্যান্য শক্তিধর রাষ্ট্র ও জোট।
বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক অংশীদারিত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের স্থান ক্রমেই ছোট হচ্ছে। যেখানে চীন বর্তমানে প্রায় ১২০টি দেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ২০টির ক্ষেত্রে তা হতে পেরেছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারাচ্ছে তার পুরোনো মিত্ররাও। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় বাণিজ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপ এবং কূটনৈতিক অনীহার ফলে এই আস্থার ফাটল আরও গভীর হয়েছে। বাণিজ্য ও কূটনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ এখন আগের মতো পূর্বাভাসযোগ্য নয়, যা বিশ্ব রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে।
চীনের ক্রমবর্ধমান উত্থান এই শূন্যতাকে আরও দৃশ্যমান করে তুলেছে। একদিকে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে চীন তার ভূমিকা জোরালো করছে, অন্যদিকে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগ ও সহযোগিতার মাধ্যমে সে তার কৌশলগত প্রভাব বাড়াচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও আমেরিকান নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণে উদ্যোগ নিচ্ছে, বিশেষত বাণিজ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত আলোচনায়।
তবে এ পরিবর্তনের ধারা কেবল কৌশলগত নয়, এটি মনোভাবগতও। যুক্তরাষ্ট্র যখন তার গ্লোবাল লিডারশিপ থেকে একপাশে সরে দাঁড়ায়, তখন বাকি বিশ্ব বাধ্য হয় নতুন নকশা খুঁজে নিতে। ট্রাম্পের প্রশাসন বিশ্ববাসীকে এক ধরনের ‘নতুন বাস্তবতা’র মুখোমুখি করেছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র আর সেই আগের মতো নির্ভরযোগ্য নয়।
এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে চীন ও ইউরোপের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তাদের ভবিষ্যৎ ভূমিকানির্ধারণ। রাশিয়ার সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা, মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের নিছক অস্ত্রবাণিজ্য-কেন্দ্রিক কৌশল, কিংবা ন্যাটোর ভবিষ্যৎ। সবকিছু মিলেই গঠন করতে যাচ্ছে এক নতুন বৈশ্বিক সমীকরণ। আর যুক্তরাষ্ট্র নিজেই যখন স্বেচ্ছায় একটি ‘গোল্ডেন ডোম’ গড়তে চায়, তখন বোঝা যায়, নতুন শতকের ভূরাজনীতিতে তার অবস্থান আর আগের মতো কেন্দ্রীভূত থাকবে না।
বিশ্ব এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে একটি শূন্যতা এবং বহু আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে নতুন একটি ভারসাম্য তৈরি হচ্ছে। সেই ভারসাম্যে কে নেতৃত্ব দেবে—চীন, ইউরোপ না অন্য কোনো জোট। তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে এতটুকু স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের যুগ শেষের পথে।