বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। শুধু তা-ই নয়, ১২৪ টাকা দিয়েও রেমিট্যান্সের ডলার কিনেছে কয়েকটি ব্যাংক; যা কার্ব মার্কেটের চেয়ে ৫ টাকা এবং বাফেদার ঘোষিত দরের চেয়ে ১২ থেকে ১৪ টাকা বেশি। এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংকের সায় আছে।
যদিও এক বছর আগে ঘোষিত দরের চেয়ে ১ থেকে ২ টাকা বেশি দামে রেমিট্যান্সের ডলার কেনায় ছয়টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। একই অভিযোগে গত ২৭ সেপ্টেম্বর ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা জরিমানাও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ডলারের সংকট আরও তীব্র হয়ে ওঠার কারণেই ব্যাংকগুলো মুদ্রাটি সংগ্রহে এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের বিনিময় হার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি শুরু থেকেই ভুল ছিল। আমরা বহু আগে থেকেই ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছি। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনও কিছুই আমলে নেয়নি।
তিনি আরও বলেন, রিজার্ভ শক্তিশালী অবস্থানে থাকা অবস্থায় ডলার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়ত। এতে রিজার্ভের ক্ষয় না হয়ে বরং সমৃদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
শুরুতে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে গেলেও, পরবর্তী সময়ে দর সংশোধন হয়ে বাজার স্থিতিশীল হতে পারত। কিন্তু বিনিময় হার বেঁধে রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ অর্ধেকের বেশি শেষ করে ফেলেছে। এখনই ডলারের দাম ১২৪ টাকায় উঠেছে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত দর রেমিট্যান্সের জন্য ব্যাংকগুলোর ডলারপ্রতি সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। তবে দেশের অনেক ব্যাংকই এখন ডলারপ্রতি ১২৪ টাকা ৩৫ পয়সা পর্যন্ত পরিশোধ করছে। ব্যাংকগুলো এখন খুচরা বাজারের (কার্ব মার্কেট) চেয়েও বাড়তি দরে ডলার সংগ্রহ করছে। কার্ব মার্কেটে মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) প্রতি ডলার লেনদেন হয়েছে ১১৯ থেকে ১২০ টাকায়।
জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক মানি এক্সচেঞ্জগুলো প্রতি ডলার ১২২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২৩ টাকা ৬০ পয়সা পর্যন্ত প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ লেনদেনই হয়েছে ১২৩ টাকার বেশি দরে। আন্তর্জাতিক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ‘ট্রান্সফাস্টের’ কাছ থেকে সর্বোচ্চ ১২৪ টাকা দরেও রেমিট্যান্সের ডলার কিনেছে অনেক ব্যাংক। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ‘ট্যাপট্যাপ’ থেকে সংগ্রহ করা ডলারের বিনিময় হার ছিল ১২৩ টাকা ৫০ পয়সা। সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ‘জিসিসি এক্সচেঞ্জ’ থেকেও একই দরে রেমিট্যান্স কিনেছে দেশের ব্যাংকগুলো।
এদিকে ব্যাংকগুলো যে দামে ডলার কিনছে, তার চেয়ে ১ থেকে ২ টাকা বেশি দামে আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। অর্থাৎ আমদানিকারকদের প্রতি ডলারের বিনিময় বিপরীতে ব্যয় করতে হচ্ছে গ্রাহকভেদে ১২৫ টাকা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোকে যেকোনও মূল্যে রেমিট্যান্স আনার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে গত মাসে (অক্টোবর) দেশের রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলারে। এ ছাড়া চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেও প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি নভেম্বরের প্রথম পাঁচ দিনে সবচেয়ে বেশি ৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। ২ কোটি ৬৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আনার মাধ্যমে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল)। ট্রাস্ট ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ২ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে থাকা অন্য ব্যাংকগুলো হলো যমুনা ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক।
এত দিন দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের পরই অবস্থান ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলো বেশি দামে রেমিট্যান্স আনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এ ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে পড়েছে। রেমিট্যান্স সংগ্রহে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের তালিকায়ও এখন নেই রাষ্ট্রায়ত্ত কোনও ব্যাংকের নাম।
বাফেদা ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) বেঁধে দেওয়া দর অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় রফতানি ও রেমিট্যান্সের ডলার কেনার কথা। আর আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রির কথা সর্বোচ্চ ১১১ টাকায়। কিন্তু ঘোষিত এই দরের কোনও প্রতিফলন বাজারে দেখা যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, আমদানি ঋণপত্র (এলসি) পরিশোধের জন্য তারা বেশি দামে রেমিট্যান্স কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও যেকোনও মূল্যে রেমিট্যান্স আনার জন্য উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা রেমিট্যান্সের প্রায় অর্ধেকই আসে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ব্যাংকটি ডলারপ্রতি ১২৩ থেকে ১২৪ টাকায় রেমিট্যান্স কিনেছে। চলতি নভেম্বরের প্রথম পাঁচ দিনে ব্যাংকটি রেমিট্যান্স কিনেছে প্রায় পাঁচ কোটি ডলার। এই রেমিট্যান্সের পুরোটাই ঘোষিত দরের চেয়ে অনেক বেশি দরে।
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, বিদেশি মানি এক্সচেঞ্জগুলো এখন ডলারপ্রতি ১২৩ থেকে ১২৪ টাকা পর্যন্ত প্রস্তাব করছে। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী আমরা রেমিট্যান্স কিনতে বাধ্য হচ্ছি।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ
এদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের আমদানি বিল বাবদ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে (আকু) ১২১ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। ফলে মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তবে এখন গ্রস রিজার্ভ ২৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী বিপিএম-৬ মেথডের ভিত্তিতে গ্রস রিজার্ভ ২০ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন। এখান থেকে আকুর বিল পরিশোধের পর দেশের রিজার্ভ কমে ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেওয়া হয়। সেটির পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে।