চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ে চালুর কথা বলা হয়েছিল। নতুন করে বলা হয়েছে আগামী ডিসেম্বরের কথা। আসলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দৃষ্টিনন্দন তৃতীয় টার্মিনাল কবে চালু হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ে তৃতীয় টার্মিনাল চালুর কথা বলেছিলেন। পরে অনেকটা জোর দিয়েই বলেছেন, যেকোনও মূল্যে ডিসেম্বরে চালু হবে তৃতীয় টার্মিনাল। তবে তার বদলির কারণে ডিসেম্বরেও টার্মিনালটি চালু হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
অনেকেই বলছেন, ডিসেম্বর তো দূরের কথা, ২০২৬ সালের জুন-জুলাইয়ের মধ্যে চালু হবে কিনা সেটিও নিশ্চিত নয়।
সরেজমিন দেখা গেছে, এ পর্যন্ত টার্মিনালটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। ভবনের অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ শেষ হলেও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি স্থাপন, ক্যালিব্রেশন ও টেস্টিং বাকি রয়েছে। এছাড়াও টার্মিনালের পূর্বাংশের অবকাঠামোগত কাজ এখনও বাকি রয়েছে, যা চলমান। সর্বোপরি টার্মিনাল পরিচালনার জন্য জাইকার সঙ্গে চুক্তি হওয়ার কথা। সেই চুক্তিই এখন পর্যন্ত হয়নি। চুক্তি হলে এই টার্মিনাল পরিচালনার জন্য প্রায় ৬ হাজার জনবল প্রয়োজন হবে। চার শিফটে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা টার্মিনালটি সচল রাখতে এই জনবল প্রয়োজন। এর মধ্যে শুধু নিরাপত্তার জন্যই লাগবে প্রায় চার হাজার জনবল। বিশাল এই জনবলকে প্রশিক্ষিত করতেও কিছু সময় প্রয়োজন।
কর্মকর্তারা বলছেন, তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন সবকিছু ঠিকঠাক করেই পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করতে।
জানা যায়, তৃতীয় টার্মিনাল প্রকল্পটিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের ৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন তৃতীয় টার্মিনালের প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করার জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম দায়িত্ব পায়। তিনটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জাপানের মিতসুবিশি করপোরেশন, ফুজিতা করপোরেশন এবং কোরিয়ার স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি। এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চুক্তি হয় ২০২০ সালে ১৪ জানুয়ারি।
চুক্তি অনুযায়ী ২০২০ সালের ৬ এপ্রিল কাজ শুরু করে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। কাজ বাস্তবায়নের মেয়াদ ৪৮ মাস। চুক্তি মূল্য ২০ হাজার ৫৯৮ কোটি ৬৪ লাখ ৮৪ হাজার ৬৯৯ টাকা (সিডি ভ্যাটসহ)।
এরই মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের সফট লঞ্চিং হয় ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর।
জানা যায়, এই টার্মিনালটি তিনতলা বিশিষ্ট। আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। যাত্রী ধারণ সক্ষমতা বছরে ১৬ মিলিয়ন। তৃতীয় টার্মিনালের পার্কিংয়ে ১২৩০টি গাড়ি রাখা যাবে। উড়োজাহাজ পার্কিং বে থাকবে ৩৭টি। আগমনী যাত্রীদের জন্য লাগেজ বেল্ট থাকবে ১৬টি। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের জন্য ১ হাজার ৩০০ বর্গাকার আয়তনের ১টি কাস্টম হল থাকবে। সেখানে থাকবে ৬টি চ্যানেল। চেক ইন কাউন্টার থাকবে ১১৫টি, এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ১৫টি। ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকছে ১২৮টি। এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ইমিগ্রেশন কাউন্টার ১৫টি। বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৬৬টি। আগমনী ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৫৯টি, এর মধ্যে ভিভিআইপি ৩টি। বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে প্রথম পর্যায়ে ১২টি। পরবর্তীতে আরেকটি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় আরও ১৪টি বোর্ডিং ব্রিজ যুক্ত করা হবে। বর্তমান টার্মিনাল দুটির সঙ্গে তৃতীয় টার্মিনালের কোনও সংযোগ থাকবে না। তবে পরবর্তীতে প্রকল্পে করিডোর নির্মাণ করা হবে।
নতুন টার্মিনালে ট্রানজিট যাত্রীদের জন্য একটি বড় লাউঞ্জ থাকছে, যা বছরে ৪০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেবে। ভিআইপিদের সেবা দেওয়ার জন্য রয়েছে ৩ হাজার ৬৫০ বর্গমিটার এলাকা। টার্মিনালটি পুরোপুরি চালু হলে যাত্রীদের নির্বিঘ্নে বিমানবন্দরে আসা-যাওয়ায় হাজিক্যাম্প থেকে উত্তরা পর্যন্ত থাকবে পাতাল রেল। এ ছাড়া এয়ারলাইন্স লাউঞ্জ, ডে-রুম, মুভি লাউঞ্জ, শিশুদের জন্য প্লে-জোন এবং ফুডকোট যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য দেবে। তবে এসব কিছু এখনও কাগজে কলমে। বাস্তবে এটি চালুর কোনও দিকনির্দেশনা আপাতত কারও কাছেই নেই।
বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তৃতীয় টার্মিনালটি চালুর বাধা কোথায় এখন কিংবা এটি চালু করতে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ আদৌ নেওয়া হয়েছে কিনা তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। সাবেক চেয়ারম্যান কয়েকবার পরিদর্শন করলেও চালুর ব্যাপারে একেক সময় একেক বার্তা দিয়েছেন। চলতি বছর এই টার্মিনাল চালুর আশা শূন্য। আগামী বছর কোন সময় চালু হতে পারে সেটিও নির্ধারিত না। সব মিলিয়ে টার্মিনালটি নিয়ে এক প্রকার লেজেগোবরে অবস্থা।
তারা বলছেন, আগের পিডি পরিবর্তন হয়েছে। নতুন পিডি নিয়োগ হয়েছে। ঘন ঘন পিডি পরিবর্তন একটি প্রজেক্টের জন্য ততটা মঙ্গলজনক নয়।
তবে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তৃতীয় টার্মিনালের প্রায় ৯৮ ভাগ কাজ শেষ। বাইরের কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাকি। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে সেই কাজ। এছাড়া অপারেশনাল কার্যক্রমের জন্য এখনও অনেক কিছু বাকি রয়েছে। সেই কাজগুলো চলতি বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। এরপর বাকি থাকবে শুধু অপারেশনাল বিষয়। সেটি কর্তৃপক্ষ যখন ভালো মনে করবেন তখন চালু করবেন।
তৃতীয় টার্মিনাল কবে নাগাদ চালু হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে কাজ করছি। এখানে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার রয়েছে, যাদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা চলছে। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় তৃতীয় টার্মিনালটি চালুর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।’
সূত্র: বাাংলা ট্রিবিউন