গুলশান থানায় আমেরিকান দূতাবাসের মামলা

আমেরিকায় আসতে বিপজ্জনক ঝুঁকি নেয় বাংলাদেশী তরুণরা

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:৪৯

ভাগ্যবদলের আশায় প্রতি বছর দুঃসাহসিক এক যাত্রায় পা বাড়ান বিপুলসংখ্যক তরুণ। সবার গন্তব্য স্বপ্নের দেশ আমেরিকা। দিনের পর দিন হেঁটে পার হতে হয় গহিন বন কিংবা দুর্গম পাহাড়। কখনো কখনো পাড়ি দিতে হয় উত্তাল সাগর। হিংস্র প্রাণীর থাবা থেকে বাঁচতে সতর্ক থাকতে হয় প্রতি মুহূর্ত। সেইসঙ্গে বিভিন্ন দেশের সীমান্তরক্ষীদের চোখ এড়াতে নিতে হয় নানা কৌশলের আশ্রয়। বিপদসংকুল এমন পথ মাড়িয়ে কেউ কেউ হয়তো পৌঁছে যান স্বপ্নের আমেরিকা। তবে দীর্ঘ যাত্রায় ক্ষুধা, ক্লান্তি আর অসুস্থতায় অনেকেরই নিভে যায় প্রাণ। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে অজানা কোনো জায়গায় আটকে রেখে নির্যাতন চালায় দালাল চক্র। মুক্তি পেতে দেশ থেকে পাঠাতে হয় বিপুল অঙ্কের টাকা।
এতকিছুর পরও অবৈধ এই যাত্রায় শামিল হন অগণিত তরুণ। বিদেশ যাওয়ার এ পদ্ধতির নাম ‘টারজান ভিসা’। এডগার রাইস বারোসের বিশ্বজয়ী ফিকশন চরিত্র টারজানের মতো দুঃসাহসিক জঙ্গলের এই জীবনকে সাফল্যের রাস্তা হিসেবে তুলে ধরে এই তরুণদের প্রলুব্ধ করে এক শ্রেণির দালাল। নানা সময়ে এ ধরনের ছোট ছোট চক্র আলোচনায় এলেও আড়ালে থেকে যায় মাফিয়ারা। তবে মানব পাচারের এই প্রক্রিয়ার মূল নিয়ন্ত্রকের নাম আশরাফুল আলম ভূঁইয়া। তার নেতৃত্বে একটি চক্র বাংলাদেশে টারজান ভিসার বড় অংশই নিয়ন্ত্রণ করে। মানব পাচার এবং দালালির অভিযোগে গত সোমবার গুলশান থানায় আশরাফুলসহ চারজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে মার্কিন দূতাবাস। জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী আঞ্চলিক নিরাপত্তা কর্মকর্তা মাইকেল লি বাদী হয়ে গত সোমবার গুলশান থানায় মামলা করেন। এতে আসামি করা হয় পাঁচজনকে। এর মধ্যে আশরাফুল আলম ভূঁইয়া ছাড়াও রয়েছেন মফিজুর রহমান, মো. নূর আলম, মোহাম্মদ জামান ও ভাসানী। মামলার নথিতে দেখা যায়, তাদের বিরুদ্ধে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২-এর ৭ ও ৮ ধারা ছাড়াও দণ্ডবিধির ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮ ও ৪৭১ ধারায় মামলাটি করা হয়েছে। এসব ধারায় অপরাধের মধ্যে রয়েছে, সংঘবদ্ধভাবে মানব পাচারের ষড়যন্ত্র, জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতারণা ও ভুয়া কাগজপত্রের ব্যবহার। গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ শাহানূর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘এ-সংক্রান্ত একটি মামলা করেছে মার্কিন দূতাবাস। মামলাটি তদন্তের স্বার্থে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) কাছে দেওয়া হয়েছে।’ কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগের উপকমিশনার মো. জসীম উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘মার্কিন দূতাবাস গুলশান থানায় একটি মামলা করেছে। মামলাটি তদন্তের জন্য সিটিটিসি আবেদন জানিয়েছে।’
জানা গেছে, আমেরিকায় মানব পাচার সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা আশরাফুল আলম। মাত্র বছর পঁয়ত্রিশের এই তরুণের সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিপুলসংখ্যক এজেন্ট। কয়েক মাস ধরে আশরাফুলের সিন্ডিকেট এবং এজেন্টদের বিষয়ে অনুসন্ধান করে কালবেলা। এতে বের হয়ে আসে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। জানা যায়, রাজধানীর কাকরাইলের হালিমুন্নেসা কোর্ট ভবনের ষষ্ঠ তলায় রয়েছে বিটিএস ট্রাভেলস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যার লাইসেন্স নম্বর-০০১২৩৮০। এই প্রতিষ্ঠানের আড়ালেই আশরাফুল গড়ে তুলেছেন মানব পাচারের ভয়াবহ এক সিন্ডিকেট। সূত্র বলছে, আশরাফুল আলমের গ্রামের বাড়ি নাটোর জেলায়। তিনি একটি রাজনৈতিক দলের জেলা শাখার শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক। গত তিন বছরে টারজান ভিসায় দুই হাজারের বেশি লোক পাঠিয়েছেন আমেরিকায়। মানব পাচার করে মালিক বনে গেছেন শত শত কোটি টাকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে আশরাফুল আলমকে তিনটি গাড়ি ব্যবহার করতে দেখা যায়। এর মধ্যে একটি গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো ঘ ১৮-২০৮১। এ ছাড়া দালালরা বিভিন্ন সময়ে অন্তত পঁচিশটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বরে টাকা পাঠাতেন। সেসব অ্যাকাউন্ট নম্বরও কালবেলার হাতে রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি অ্যাকাউন্ট স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, টারজান ভিসার নামে যুক্তরাষ্ট্রে মানব পাচারের অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় চক্রের অনেক সদস্যকে আসামি করা হলেও রহস্যজনক কারণে প্রতিবারই বাদ যান আশরাফুল। জানা যায়, বয়সে তরুণ আশরাফুল কাকরাইলের অফিসে বসেন খুব কম। বেশিরভাগ সময় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে সময় কাটান। আশরাফুলের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন দালাল কালবেলার কাছে বর্ণনা করেছেন মানব পাচারের আদ্যোপান্ত। তারা বলেন, মূলত নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণরা শুরুর দিকে আমেরিকা যেতে বেছে নিয়েছেন এই পথ। পরবর্তী সময়ে নরসিংদী এবং মুন্সীগঞ্জের অনেক তরুণও পা বাড়ান এই পথে। তবে বর্তমানে দেশের সব উপজেলা থেকেই টারজান ভিসায় লোক যাচ্ছে আমেরিকায়। নোয়াখালী জেলার বাসিন্দা আরাফাত ইসলাম (ছদ্মনাম)। এ পর্যন্ত প্রায় একশর বেশি লোক পাঠিয়েছেন আশরাফুলের মাধ্যমে। তিনি কালবেলাকে বলেন, আমরা জনপ্রতি ৪০ লাখ টাকা নিই। এতে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা পৌঁছানো পর্যন্ত সব খরচ যুক্ত থাকে। সাধারণত যারা ৪০ লাখ টাকা চুক্তিতে যাত্রা করেন, তারা ভালোভাবেই পৌঁছতে পারেন। তবে যারা কম টাকায় চুক্তি করেন, তাদের বিভিন্ন দেশে দালালরা আটকে নির্যাতন করেন। দেশ থেকে ফের টাকা পাঠাতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘টারজান ভিসায় বাংলাদেশের গুরু আশরাফুল ইসলাম। তার সিন্ডিকেটে যুক্ত রয়েছে আরও তিনজন।’
তিনি বলেন, ‘ক্লায়েন্টের কাছ থেকে আমরা ৪০ লাখ টাকা নিলেও আশরাফুলকে দেওয়া হয় ৩৮ লাখ। জনপ্রতি আমাদের লাভ থাকে দুই লাখ টাকা। এরপর বাংলাদেশ থেকে ভিসা প্রসেসিংসহ বাকি সব কাজ সম্পন্ন করেন আশরাফুল ইসলাম।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে আশরাফুলের সঙ্গে সিন্ডিকেট পরিচালনা করতেন সাইফুল্লাহ আল মামুন। এই ব্যক্তি গত বছর ব্রাজিলে মানব পাচারের অভিযোগে আটক হন। এ ছাড়া সারা দেশে আশরাফুলের অন্তত পঞ্চাশজন কমিশন এজেন্ট রয়েছে বলে জানা গেছে। জানা যায়, যেসব দেশ সহজে ভিসা দেয়, প্রথম দিকে এমন দেশ বেছে নেয় পাচারকারীরা। এরপর নানা মাধ্যমে পৌঁছানো হয় ব্রাজিলে। এরপর শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর আসল লড়াই। যে যাত্রায় ডিঙিয়ে যেতে হয় দুর্গম পাহাড় বা কয়েকশ মাইল জঙ্গল। ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সাগর পাড়ি দিতে হয় অনিরাপদ নৌযানে। এর মধ্যে বন-জঙ্গলের হিংস্র পশুপাখি কিংবা পোকামাকড়ের ভয় তো আছেই। এ ছাড়া অনেক সময় দালালরা টাকা বাঁচাতে বিভিন্ন দেশের সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে আগাম সমঝোতা ছাড়াই অগ্রসর হতে চায়। এ সময় ধরা পড়লে গুনতে হয় অতিরিক্ত অর্থ। এ ছাড়া পথে পথে ফাঁদ পেতে থাকে অপহরণকারীরা। রয়েছে অবৈধ চোরাকারবারিরাও। এত কিছুর পরও অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যান। এরপর মার্কিন ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়েন বেশিরভাগ। বছরের পর বছর কাটাতে হয় জেলে। অনেকে নানাভাবে হয়তো থেকে যেতে পারেন; কিন্তু বেশিরভাগকে ফিরে আসতে হয় দেশে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন-এমন কয়েকজন তরুণের সঙ্গে কথা হয়। তারা তুলে ধরেন দুঃসাহসিক সেই যাত্রার গল্প। এমন একজন কামাল আহমেদ (ছদ্মনাম) বলেন, ‘ঢাকা থেকে প্রথমে উড়োজাহাজে করে আমাকে দুবাই নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে যাই ব্রাজিলে। এরপরই শুরু হয় আসল লড়াই। পাড়ি দিতে হয়েছে একের পর এক দেশের সীমান্ত। ব্রাজিল, বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস ও গুয়েতেমালা হয়ে সবশেষে মেক্সিকো পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে।
তিনি বলেন, ‘এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেকে আবার আটক হন অপহরণকারীদের হাতে। অনেক সময় দালালরাই ফাঁদ তৈরি করে আটকে রাখেন নির্যাতন করেন টাকা আনার জন্য। কত মানুষ শূন্য হাতে দেশে ফেরত গেছেন। এরপর ভিটেমাটি বিক্রি করে লোনের টাকা পরিশোধ করেছেন।’ যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন শহরে বসবাস করেন আসাদ (ছদ্মনাম)। তিনি ২০১৬ সালে ব্রাজিল থেকে দালাল চক্রের মাধ্যমে আমেরিকায় ঢোকেন। আমেরিকায় পৌঁছার জন্য তাকে ব্রাজিল থেকে ১২টি দেশের পাহাড়-পর্বত, গহিন বনজঙ্গল ও উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিতে হয়েছে। ব্রাজিল থেকে আমেরিকায় যাওয়ার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘শুধু টাকা রোজগারের জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথে আমেরিকায় এসেছি। দালালরা আমেরিকায় পৌঁছে দিতে আমার কাছ থেকে ৩৫ লাখ টাকা নিয়েছে। ১২ দেশ পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় পৌঁছার আগে আমাকে অনেকবার মানব পাচারকারীদের হাত বদল হতে হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুবই ভয়ংকর প্রকৃতির। দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছি। টাকার জন্য মারধর করেছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হেঁটে জঙ্গল পাড়ি দিয়েছি। ছোট্ট একটা ডিঙি নৌকায় পাড়ি দিয়েছি খরস্রোতা নদী।’ তিনি বলেন, ‘টাকার জন্যই আমেরিকায় এসেছি; কিন্তু আমাকে যদি আপনি এখন ৩৫ কোটি টাকা অফার করে ওই পথ দিয়ে আবার আমেরিকায় আসতে বলেন, আমি কখনোই রাজি হব না। কারণ, ওই পথে আমেরিকায় আসতে বহু মানুষকে মরে পড়ে থাকতে দেখেছি।’
গুলশান থানায় মার্কিন দূতাবাসের করা মামলার বিষয়ে কথা বলতে নানাভাবে চেষ্টা করেও আশরাফুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে মানব পাচারের অভিযোগ সম্পর্কে মাস দুয়েক আগে তার সঙ্গে কথা হয় কালবেলার। সে সময় তিনি সব রকম অভিযোগ মিথ্যা এবং তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন। গার্মেন্ট ব্যবসা থেকে আসা আয়ে জীবনধারণ করেন-এমন দাবি করে আশরাফুল বলেন, ‘আমি কোনো ধরনের মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত নই।’