কী এমন দুঃখ ছিল বৃষ্টির?

কুদরতে খোদা সবুজ
  ১২ মার্চ ২০২৪, ১৪:১৭

কী এমন দুঃখ ছিল রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে মারা যাওয়া সাংবাদিক বৃষ্টি খাতুনের। যিনি বন্ধু ও সহকর্মীদের কাছে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে পরিচিত ছিলেন। মূলত মুসলিম পরিবারের সন্তান বৃষ্টি। কিন্তু অভিশ্রুতি নামে নিজেকে পরিচয় দেওয়ার কারণে লাশ হস্তান্তর নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। মৃত্যুর পর এক পুরোহিত বৃষ্টিকে সনাতন ধর্মাবলম্বী দাবি করেন। পাশাপাশি সবুজ শেখ ও বিউটি খাতুন নিজের সন্তান বলে দাবি করেন। এরপর লাশ শনাক্ত করতে নেওয়া হয় ডিএনএ নমুনা। ১০ দিন পর রবিবার (১০ মার্চ) বৃষ্টির ডিএনএর সঙ্গে তার বাবা-মায়ের ডিএনএ মিলে যায়। 
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাকে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে পাওয়া যায়। নিজের ফেসবুকে বিভিন্ন সময় নানা দুঃখ-কষ্টের কথা লিখেছেন। তবে কী এমন দুঃখ ছিল তার সেটি নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। এমনকি স্বজনরাও তা জানাতে পারেননি। তারা শুধু বলেছেন, মেয়ের সঙ্গে সবসময় ভালো সম্পর্ক ছিল তাদের।
অভিশ্রুতির ফেসবুক ঘেঁটে দেখা যায় ২০২৩ সালের ২১ জুন লিখেছেন, ‘সবাই বলে আমি আমার জায়গা থেকে পালিয়েছি, নিখোঁজ হয়েছি। কিন্তু কেউ কখনও খোঁজ করেনি। কেউ কখনও বোঝেনি তারা আসলে কতটা খারাপ করে গেছে। আমি আসলে পালাইনি। ওই সুন্দর সম্পর্কের মানুষগুলোকে ওই খারাপ সময় থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছি। অভিমান আছে, আজীবন থাকবে। ভালো থাকুক আমার প্রিয় মানুষগুলো।’
২০২৩ সালের ২৮ জুলাই ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘তোমার ঈশ্বরকে জানিয়ে দিও, আমি যেন তোমায় ক্ষমা করতে পারি। কারণ, আমার ঈশ্বর তোমায় ক্ষমা করতে শেখায়নি।’
২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লিখেছেন, ‘তুমি বারবার কথা দিয়ে কথা রাখবে না জেনেও কেমন করে যেন, তোমায় বিশ্বাস করে ফেলি। ওই যে চোখ, কান বেঁধে ভালোবেসে ছিলুম।’
২০২২ সালের ১১ মার্চ লিখেছেন, ‘এবার যখন ফিরবে, ভীষণ রকম ভেঙে ফিরো। যেন তোমায় আমি নিজের মতো গড়ে নিতে পারি।’
একই বছরের ১৩ অক্টোবর লিখেছেন, ‘সব সময়ের জন্য নয়, তুমি না হয় হঠাৎ করেই আমার হয়ে যাও, ভোর রাতের আকস্মিক চুমু হও, গোধূলির আবছার মতো ধূপ করে জড়িয়ে, রাতের অন্ধকারের মতো আমাতে মিশে যাও, তবু তুমি হঠাৎ হঠাৎ করেই আমার হও।’
২০২১ সালের ১৫ জুলাই লিখেছেন, ‘প্রিয় আমি, তুমি ঠিক আছো তো? নাকি এখনও বেঠিক হয়েই বলো আমি একদম ঠিক আছি। শোনো নিজেকে একটু ভালোবাসো, নিজের প্রতি যত্ন নাও, আশপাশের ফালতু মানুষগুলোর জন্য নিজেকে একদম কষ্ট দেবে না। সবসময় কারও উদ্দেশ্যে কেন নিজেকে সাজবে। এবার থেকে নিজের জন্য সাজবে। চেনো না জানো না তার জন্য রাতের পর রাত কেন জেগে থাকবে, নিজের জন্য একটু ঘুমাতেও তো পারো। অন্য কাউকে যে এতো ভালোবাসি বলে স্বীকার করো কখনো নিজেকে ভালোবাসি দাবি করেছো? কেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলোনি এই যে আমি নিজেকে ভীষণ ভালোবাসি। অন্য কারও বলার ওপরে কেন তোমার সৌন্দর্য নির্ভর করবে? নিজেকে কেন বলতে পারো না আমি সুন্দর।
তোমায় এখন থেকে এসব বলতে হবে, করতে হবে। নিজেকে আগলে রাখতে হবে পৃথিবীর সব দুর্ভাগ্য থেকে, কারণ আমার ভাগ্য যে আমি। আমি ছাড়া আমার সত্তা-আত্মা যে আর কারও হতে পারে না।’

২০২১ সালের ২৭ জুলাই ফেসবুকে লিখেছেন, ‘শোনো, তোমার কি আমায় শাড়ি পরিয়ে দেওয়ার কথা মনে আছে? কি ভালো কুচি ঠিক করতে পারো। তোমার উপহার দেওয়া শাড়িটার ভাঁজ এখনও ভাঙিনি। শুধু মাঝে মাঝে একবার খুলে দেখি, কেমন আছে স্মৃতিগুলো।’
২০২১ সালের ২৮ জুলাই অভিশ্রুতি লিখেছেন, ‘অনুভব করো না, শুধু দূরত্ব আছে এটুকুই বুঝি। আচ্ছা সম্পর্কটাকে কি শেষ করে দিয়েছি? তোমার কি এখনও মনে হয় কিছু বাকি আছে। নগদ বাকিতে তো দোকান হয়, ভালোবাসা তো হয় না। সম্পর্ক বেঁচে থাকলে তোমার কখনও আমায় প্রশ্ন করতে হতো না। যে আমাদের কিছু বাকি আছে কিনা। যদি কিছু বাকি থাকে, তবে সেটা দেনা-পাওনা। জানো তো আমার আর তোমার মধ্যে বেশ কিছু দেনা-পাওনা আছে, সেগুলো মিটিয়ে নিতে হবে। পুরোনো সময়গুলো ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য তো আমার নেই। তবে স্মৃতিগুলো ফিরিয়ে দিলে মাঝে মাঝে তোমার নির্ঘুম রাত কাটবে, নেবে নাকি। একেবারে নগদ দেবো। সম্পর্কের মতো বাকি থাকবে না।’
একই বছরের ২ আগস্ট লিখেছেন, ‘হারিয়ে যাওয়ার তাৎপর্য নাকি কিছু ফিরে পাওয়ার একান্ত অনুভব ভালোবাসা হারায়, আবার জন্মায় বর্তানো সব ব্যাপারগুলো কেমন জানি প্রাণহীন লাগে, যেমন ধরো ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে, ফোন চালানোর ইচ্ছে শেষ হয়ে যায় ঠিক ওমন। এই হারিয়ে ফিরিয়ে যাওয়ার অনুভবগুলো সত্যি বড্ড মায়ার, যা কখনও শেষ হতে চায় না। চোখের অস্পষ্ট জলের মধ্যে আটকে থাকে, যেন বহুদিন ধরে ছলছল করছে। কিন্তু পড়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। শুধু বেঁচে থাকবে অনুভবের মালিকেরা আর ভালোবাসা, সে তো কবেই পালিয়েছে তার নতুন জায়গা খুঁজতে।’
২০২১ সালের ১৯ আগস্ট লিখেছেন, ‘আমাদের অনেক কিছুতেই মিল ছিল। একসঙ্গে রবী ঠাকুরের গান শোনা থেকে শুরু করে ড্রেস পর্যন্ত মিলে যেতো। তুমি মাঝে মাঝে বলতে, এটাতো আরও অনেক মানুষের সঙ্গে মিলে গেছে। তাই বলে কি ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হবে নাকি। আদতেও কি আমাদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক ছিল? আমাদের তো শুধু সবকিছুতে মিল ছিল। আমরা চাইলেই পারতাম, যেমন করে চাইতাম আমাদের সবকিছু মিলুক। শুধু নিজেদের কেন জানি মেলানোর চেষ্টা হয়নি। সবকিছু মিলেছে, শুধু নিজেদেরকে চাওয়ার ইচ্ছেটাই মেলেনি।’
একই বছরের ২৮ আগস্ট লিখেছেন, ‘আমি চাই আমারে আর কেউ না ডাকুক, ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক আমারে কেউ না বলুক। আমার আমি ছাড়া আর কাউরেই সাড়া দিতে ইচ্ছে করে না।’ 
বৃষ্টি খাতুনের সঙ্গে কার সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক ছিল জানতে চাইলে খালা শাবানা খাতুন বলেন, ‘বৃষ্টি বাবা-মায়ের প্রথম সন্তন। আমার বোনের বিয়ের ছয় বছর পর বৃষ্টির জন্ম হয়। বৃষ্টিকে ওর বাবা বন্ধু বলে ডাকতো। প্রথম সন্তান হিসেবে বাকি দুই মেয়ের চেয়ে বড় মেয়েটাকে খুব বেশি ভালোবাসতো। মা-বাবার জানের জান ছিল। অন্য কারও সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল কিনা, তা আমাদের জানা নেই।’ 
বৃষ্টি খাতুনের মা বিউটি বেগম বলেন, ‘আমার সঙ্গে বৃষ্টির প্রতিদিন কথা হতো। সবশেষে ২৯ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টার দিকে কথা হয়। আমি তখন খাওয়া-দাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলাম। আর ব্যাংকের একটা লোন (ঋণ) নিয়েছিলাম। সেই বিষয়ে কথা হলো সেদিন।’ 
মেয়ের পরিচয় পরিবর্তন সম্পর্কে মা বলেন, ‘পরিচয় পরিবর্তন সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আমাদের কাছে একটাই পরিচয় বৃষ্টি খাতুন। তার সব সার্টিফিকেটেও তাই। স্কুল-কলেজ সব জায়গায় এক নামে সবাই চেনে।’ 

অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর আসল নাম বৃষ্টি খাতুন। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বেতবাড়ীয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বনগ্রাম গ্রামের প‌শ্চিমপাড়ায়। বাবার নাম শাবরুল আলম সবুজ ওরফে সবুজ শেখ।
২০২১ সালের ৬ জুলাই ইস্যু করা জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম বৃষ্টি খাতুন হিসেবেই রয়েছে। সেখানে বাবার নাম সবুজ শেখ এবং মায়ের নাম বিউটি বেগম। কলেজের প্রবেশপত্র এবং রেজিস্ট্রেশন কার্ডেও একই তথ্য পাওয়া যায়। ২০২২ সালের ১২ মার্চ ইস্যু করা জন্মনিবন্ধন সনদে বৃষ্টি খাতুন নাম আছে। বাবার নাম লেখা হয়েছে সবুজ শেখ এবং মায়ের নাম বিউটি বেগম।
বৃষ্টি খাতুন রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিটের চেষ্টায় রাত ১১টা ৫০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ওই আগুনে বৃষ্টিসহ ৪৬ জনের মৃত্যু হয়।
রবিবার সিআইডি জানিয়েছিল, অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর সঙ্গে তার বাবা সবুজ শেখ ও মা বিউটি খাতুনের ডিএনএর মিল পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় অগ্নিকাণ্ডের ১১ দিন পর সোমবার দুপুরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তার লাশ বাবা সবুজ শেখের কাছে হস্তান্তর করে। রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে বনগ্রাম প‌শ্চিমপাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।