বাংলাদেশে গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে এক শ্রেণির রাজনৈতিক বিশ্বাসের লোকজন ও জনাকয়েক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট যে তথাকথিত ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা শুরু করেছেন— তা নিয়ে ভারত এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। বস্তুত, ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা মনে করছেন, ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়ে এই প্রচারণা আদৌ এমন কোনও স্তরে পৌঁছায়নি যে তা নিয়ে ভারতকে বিচলিত হতে হবে, বা এর বিরুদ্ধে পাল্টা বিবৃতি দিতে হবে।
কিন্তু বুধবার (২০ মার্চ) ঢাকায় বিএনপির অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় নেতা রুহুল কবির রিজভী যেভাবে নিজের ব্যবহৃত ভারতীয় শাল ছুড়ে ফেলে দিয়ে এই ভারতবিরোধী ক্যাম্পেইনে সংহতি জানিয়েছেন, তা দিল্লিরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তবে বিএনপির নেতা রিজভী যেভাবে চেয়েছিলেন, ঠিক সেভাবে অবশ্যই নয়! রিজভী যে ধরনের কাশ্মিরি শাল ছুড়ে ফেলেছেন তারই একটি নমুনা
বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) দিল্লির সাউথ ব্লকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন প্রথম সারির কর্মকর্তা বলেন, ‘‘ওই ছবিটা আমরাও দেখেছি। আমাদের যেটা ভালো লেগেছে, তা হলো— ওনার (রুহুল কবির রিজভী) কেনা একটা কাশ্মিরি শালকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বলে চিহ্নিত করলেন। তার মানে নিশ্চয় উনিও মেনে নিলেন কাশ্মির ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ!”
আন্তর্জাতিকভাবে যে কাশ্মিরকে অনেকেই একটি ‘বিতর্কিত ভূখণ্ড’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন, সে প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ঘোষিত অবস্থান হলো— ‘কাশ্মিরের জনগণের মতামত আমলে নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই এই সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে।’
২০১৯ সালে ভারত যখন সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করার মধ্যে দিয়ে কাশ্মিরের বিশেষ স্বীকৃতির অবসান ঘটিয়েছিল, তখনও বিএনপির জারি করা বিবৃতিতে সব পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজার কথা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ, বিএনপি এটা মানে যে, কাশ্মিরে একটা ‘বিতর্ক’ বা ‘সংকট’ অবশ্যই আছে।
সারা ভারতেই কাশ্মিরের সবচেয়ে জনপ্রিয় পণ্য হলো সেখানকার শাল
তবে ভারতের পর্যবেক্ষকরা প্রায় সবাই একমত— ১৯৯১-৯৬ এবং পরে ২০০১-০৭, এই দুই মেয়াদে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে যখন বাংলাদেশে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল, তখন তাদের কাশ্মিরনীতি ছিল পুরোপুরি ‘পাকিস্তান-ঘেঁষা’।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত জয়ন্ত প্রসাদ যেমন মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘খালেদা জিয়া যখন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন একাধিকবার সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে কাশ্মিরে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বাধা দিয়েছে।’
১৯৯৫ সালে দিল্লিতে ও ২০০২ সালে কাঠমান্ডুতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সময় দুবারই প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল।
কাঠমান্ডুর সার্ক সামিটের মাত্র মাসদেড়েক আগে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জঙ্গিরা ভারতের পার্লামেন্টে হামলা চালায়, তবে তারপরও ওই সম্মেলনে সন্ত্রাসবাদবিরোধী যৌথ বিবৃতি জারি করাতে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছিল– যার মূলে ছিল তখনকার বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতা।
বস্তুত, খালেদা জিয়ার সরকারে পাকিস্তানের প্রভাব অত্যন্ত বেশি ছিল বলেই যে ওই রকমটা হয়েছিল, এ ব্যাপারে ভারতীয় পর্যবেক্ষকদের কোনও সংশয়ই নেই।
বিএনপি এর পরে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করার জন্য একটা সময়ে নানা উদ্যোগ নিয়েছিল এ কথা ঠিকই। তাদের নেতারাও বিভিন্ন সময়ে দিল্লিতে এসে ভারতে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেছেন। তবে তাদের কাশ্মিরনীতিতে দৃশ্যত কোনও পরিবর্তন কখনোই আসেনি।
এই পটভূমিতে রুহুল কবির রিজভী পুরোপুরি নিজের অজান্তেই কাশ্মির নিয়ে একটা ‘স্টেটমেন্ট’ দিয়ে ফেলেছেন বলে ভারতে অনেকেই মনে করছেন।
কাশ্মিরি গবেষক ও ‘কে ফাইলস’ গ্রন্থের লেখক বশির আসাদ যেমন বলছিলেন, ‘কাশ্মিরি শাল হলেঅ এমন একটা প্রোডাক্ট যা সারা বিশ্বে কাশ্মিরের শিল্পীদের মুন্সিয়ানা ও প্রতিভার পরিচয় বহন করে। কাশ্মিরের পশমিনা ও বিভিন্ন ধরনের শাল হলো কাশ্মিরের অভিজ্ঞান।’
‘এখন ভারতীয় পণ্য বোঝাতে গিয়ে কেউ যখন কাশ্মিরি শাল টেনে আনেন, তখন তো ধরেই নিতে হয় কাশ্মিরকে তিনি ভারতের অংশ হিসেবেই ধরে নিচ্ছেন এবং সেটা নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই’, হাসতে হাসতে যোগ করেন বশির আসাদ।
ভারতের পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী, সমগ্র জম্মু ও কাশ্মিরকেই (যার মধ্যে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকা অংশও রয়েছে) ভারতের ‘অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বলে গণ্য করা হয়।
বুধবার ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নাটকীয়ভাবে নিজের কাশ্মিরি শাল ছুড়ে ফেলে রুহুল কবির রিজভীও সেই বক্তব্যেই নিজের অজান্তে সিলমোহর দিয়ে ফেললেন বলে দিল্লি মনে করছে।