নববর্ষের চেতনা

সেলিম জাহান
  ১১ এপ্রিল ২০২৪, ২০:১৯

‘নববর্ষের চেতনা সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন?’, ইথার তরঙ্গে দূর থেকে ভেসে এলো সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিকটির কণ্ঠস্বর। কথা বলছিলাম ইউরোপের একটি বিখ্যাত বার্তা সংস্থার বাংলা বিভাগের প্রধানের সঙ্গে। আলোচনা হচ্ছিল বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর ওপরে।
প্রশ্নটি শুনে একটু থমকালাম। সাধারণত এ সময়ে গতানুগতিকভাবে যে প্রশ্ন করা হয়, তা হচ্ছে, ‘নববর্ষ উপলক্ষ্যে আপনার অনুভূতি কী’? কিন্তু যে প্রশ্নটি করা হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন-এখানে নববর্ষের চেতনা বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। ভাবনাগুলোকে একটু গুছিয়ে নিয়ে তাৎক্ষণিক একটা সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম।
কিন্তু ভাবনাগুলো আমায় ছাড়ল না। একটু সময় নিয়ে, চিন্তা করে দেখলাম যে বাংলা নববর্ষের চেতনা আমার মনে পাঁচটি আঙ্গিকে দেখা দেয় : একটি উৎসবের দিক, একটি ঐতিহ্যের দিক, একটি আত্মসত্তার দিক, একটি সর্বজনীনতার দিক এবং একটি মানবতার দিক।
বাংলা নববর্ষের উৎসবের দিকটি তো চিরচেনা। ওই যে মেলা গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে বিশাল মাঠে, পথের পাশের স্বল্প পরিসর স্থানে; ওই যে মাটির পুতুল, ঘোড়া, হাতি, বর-বউ, নাগরদোলা; ওই যে বাউল গান গ্রামের মেলায় আর রমনার বটমূলে ছায়ানটের আসর ঢাকা শহরে; ওই যে রঙিন পোশাকে সজ্জিত নর-নারী, বালক-বালিকা; ওই যে উচ্ছ্বসিত আর উৎফুল্লিত শিশুর দল-এসবই তো বাংলা নববর্ষের উৎসব। নানা রঙে আর ঢঙে এসব বাঙালিকে আমোদিত করে রাখে বছরের প্রথম দিনে।
বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যের দিকটিই বা ভুলি কী করে? বাঙালির চিরায়ত জীবন, জগৎ, সংস্কৃতি আর কৃষ্টির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কিছু সনাতন ঐতিহ্য। গ্রামে একবারে প্রত্যুষে এক ডুবে পুকুরের এপাড় থেকে ওপাড়ে গিয়ে জলে ঝুঁকে পড়া আমগাছের দুটো আম ছিঁড়ে নিয়ে আসা যেমন এ ঐতিহ্যের অংশ, তেমনই মাটির বাড়ি আর উঠোন নিকিয়ে তাতে আলপনা আঁকাও এ ঐতিহ্যেরই একটা দিক। ‘বছরের প্রথম দিনে সবাই মিলে ভালো-মন্দ খেলে বছরটা ভালো যাবে’-এ সরল বিশ্বাস যেমন এ ঐতিহ্যের ধারক, তেমনই ব্যবসার হালখাতা আর পিতলের ঘটিতে রাখা পাঁচটি আমপাতাও এ ঐতিহ্যেরই বাহক।
বাংলা বর্ষপঞ্জি আর বঙ্গাব্দ এ শুধু বাংলার আর বাঙালির। পৃথিবীর আর কোনো জাতিসত্তা এর অধিকার দাবি করতে পারে না। শুধু বাঙালিরাই আত্মমগ্ন হয়ে এ উৎসব উদযাপন করে-তা তারা দেশেই থাকুক, কিংবা বিদেশে। তাই তো দেশের সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাই দেশের বাইরেও পৃথিবীর আনাচে-কানাচে বাঙালি মাত্রেই উদ্বেলিত হচ্ছে বাংলা নববর্ষে। কেন এ আত্মমগ্নতা, কেন এ উদ্বেলতা? কারণ এর সঙ্গেই বাঙালি তার জাতিসত্তাকে সংযুক্ত করে, তার আত্মসত্তাকে খুঁজে পায়। বাংলা নববর্ষ তাই বাঙালির আত্মসত্তা আর জাতিসত্তার প্রতীক।
বাংলা নববর্ষের চেতনা তো সর্বজনীন। এ চেতনাকে বুকে ধারণ করেই তো বর্ণ, ধর্ম, দল, মত নির্বিশেষে আমরা সবাই এক কাতারে মিলিত হই। আমাদের বুকের মাঝে নিরন্তর অনুরণিত হতে থাকে ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি।’ সর্বজনীনতার সেই চেতনাই তো আমাদের উদ্বুদ্ধ করে সেই মন্ত্রে ‘যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ।’ নববর্ষের সর্বজনীনতাই আমাদের সবাইকে যুক্ত করে; আবার সে সর্বজনীনতাই আমাদের মুক্তও করে-মুক্তবুদ্ধি আর মুক্তচিন্তা নিয়ে আমরা সংযুক্ত হই সবার সঙ্গে।
এসব মিলিয়েই বাংলা নববর্ষের চেতনা ‘বাঙালির’ সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ‘মানুষ’ পরিচয়টিকেও অগ্রগণ্য করে তোলে-আমরা নিজেদের চিহ্নিত করি বিশ্ব মানবতার অংশ হিসাবে। মানবতার সেই প্রেক্ষিত থেকে ‘অন্তর মম বিকশিত করো’-এ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আমরা বলি, ‘আমরা মানুষ-চূড়ান্ত বিচারে সেই আমাদের আদি এবং একমাত্র পরিচয়।’
আজকের বাংলাদেশে নববর্ষের এসব চেতনা আর প্রাসঙ্গিকতা অপরিসীম। আমাদের সমাজে আজ মৌলবাদ বিপজ্জনকভাবে ক্রমবর্ধমান। আমাদের ভূখণ্ডের চিরায়ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আজ অপসৃত প্রায়। আমাদের সনাতন মূল্যবোধ-যার কেন্দ্রবিন্দু সর্বজনীন মানবতা, তা আমরা দ্রুত বিস্মৃত হচ্ছি। আমাদের বাঙালি আত্মসত্তাকে ভুলিয়ে দিয়ে এক অনাবশ্যক বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াসে তৎপর শত্রুরা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার চেতনা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। এসব কিছুকে প্রতিহত করে পুরো জাতিকে ঘুরে দাঁড়াতে নববর্ষের চেতনার বড় বেশি প্রয়োজন।
এ নববর্ষের প্রথম প্রভাতে যখন ১৪৩০ ধীরে ধীরে অপসৃত হবে, যখন পুবের আকাশ আলোর প্রভায় রঙিন হয়ে উঠবে, যখন নীলাকাশ আর শান্ত পৃথিবী উন্মুখ হয়ে থাকবে, তখন যেন নমিত হয়ে সবাই মিলে বলতে পারি, ‘আমাদের মন সব হীনতা, সব দীনতা, সব গ্লানির ঊর্ধ্বে উঠে কলুষমুক্ত হোক, আগামী পৃথিবী সুন্দর আর উজ্জ্বল হোক, তৈরি হোক এক ‘শান্তির পারাবার’। মঙ্গল হোক সবার। আজকে বাংলা নববর্ষের প্রথম প্রভাতে এটাই আমাদের সবার বাসনা, সবার কামনা, সবার সাধনা। চেতনার সিঁড়ি বেয়ে আমাদের পথচলা অক্ষয় হোক। জয়তু বাংলা নববর্ষ, ১৪৩১।
ড. সেলিম জাহান : অর্থনীতিবিদ; ভূতপূর্ব পরিচালক,  মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি
[email protected]