বাংলাদেশকে নিয়ে পরাশক্তিগুলোর আগ্রহে হেরফের হয়নি। সময়ের ব্যবধানে সামান্য রকমফের মাত্র। নির্বাচনের পর সরকারের প্রতি কূটনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বক্তব্য- বিবৃতিকে সরকারি তথা স্থানীয় ভার্সনে ইতিবাচকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। বলার চেষ্টা করা হয়েছে, তারা ভুল বুঝতে পেরে এখন নির্বাচকে মেনে নিয়েছে। সরকারকে কেবল মেনেই নেয়নি, দুঃখ প্রকাশও করেছে। ভারত-চীন-রাশিয়ার বক্তব্য ছিল সরকারের ঘোরতর সমর্থনে, যা ভার্সন বা তরজমা বদলে প্রচার করতে হয়নি।
ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মিতালি ঐতিহাসিক বিষয়। তা অটুট রেখেই ২০০৯ সালের পর থেকে চীনের সঙ্গে অতিমাত্রার বন্ধুত্ব। ক্ষমতাসীনদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে একাত্তরের রক্তের সম্পর্ক। আর চীন অর্থনৈতিক বন্ধু। এ সময়টায় কূটনৈতিক অ্যাজেন্ডায় চীনের দেওয়া ঋণ, বিনিয়োগে ধন্য সরকার। বাংলাদেশের ওপর ভর করে বাংলাদেশে এবং সংলগ্ন অঞ্চলে আরও ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে চীন, যা আটলান্টিকের ওপারের যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় দেশগুলোকে কেবল ভাবিয়ে তোলেনি, ক্ষুব্ধও করেছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক ‘শক্তি পরীক্ষা’র বিষয়টি ছিল ব্যাপক আলোচনায়। চীন শেখ হাসিনা সরকারকে সরাসরি সমর্থন করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিয়েই গেছে। ভারতের সমর্থন ছিল একেবারে কোমর বেঁধে প্রকাশ্যে। শেখ হাসিনার ওপর চীনা প্রভাবকে আমল দেয়নি ভারত। সেই পরিস্থিতিতে দৃশ্যত পরাজয় হয় যুক্তরাষ্ট্রের। সেই সঙ্গে দিনে দিনে দৃশ্যপটেও কিছু হেরফের আসতে থাকে।
শেখ হাসিনার চতুর্থ দফায় ক্ষমতায়নে দেশীয় পক্ষ-বিপক্ষে কিছুদিন একটি দম ধরার ভাব থাকলেও সময়ের ব্যবধানে এতে নতুন তাল-লয় যোগ হয়। সামনে আসে প্রাসঙ্গিক নানা প্রশ্ন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার সঙ্গে বৈঠক শেষে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘দিল্লি আমাদের কাছে, বেইজিং একটু দূরে।’ প্রসঙ্গে আসে তিস্তা প্রকল্পও। জানান, চীনের পরিকল্পনায় তিস্তা প্রকল্পে ভারত অর্থায়ন করতে চায়। বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাব পেলেই তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরুর বিষয়ে চীন প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। তিনি তার দেশের অবস্থানও জানান। বলেন, তিস্তা প্রকল্প কবে শুরু হবে, তা ঠিক না হলেও এটা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ চীন।
ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে জটিলতার মধ্যে চীনের তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্পের আয়োজন চলছিল অনেক আগ থেকেই। প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ভাটি থেকে তিস্তা-যমুনার মিলনস্থল পর্যন্ত নদীর প্রস্থ কমিয়ে ৭০০ থেকে ১০০০ মিটারে সীমাবদ্ধ করা হবে। আর নদীর গভীরতা বাড়বে ১০ মিটার পর্যন্ত। এত দিন আশ্বাস দেওয়ার পরও ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়ার মধ্যে চীনের সঙ্গে চুক্তিতে যাওয়া কূটনীতি-রাজনীতিতে এক নতুন উপাদান। এ রকম সময়েই মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফর। তার সফরের সপ্তাহখানেক আগে স্টেট ডিপার্টমেন্ট বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ভারত-শ্রীলঙ্কা হয়ে তার বাংলাদেশ সফর দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার করবে। যথারীতি ঢাকায় এসে সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কথা বলেন লু। কাকতালীয়ভাবে আরেক ঘটনা হচ্ছে, তিনি যখন বাংলাদেশে, তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ।
লুর ঢাকা সফরকালে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীরকরণের সঙ্গে মার্কিন-বাংলাদেশ সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হলেও মুক্ত-উন্মুক্ত ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য বাংলাদেশের সমর্থনের কথাই আসল কথা। সফরে আসার আগে ক্ষমতাসীন মহল থেকে চলেছে অতিকথন। গত ১৩ মে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, ডোনাল্ড লুর সফরে ভিসানীতি ও র্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার দাবি করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী চতুর্থবার নির্বাচিত হওয়ার পর জো বাইডেন চিঠি লিখে সম্পর্ক এগিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। একই দিন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক, হেভিওয়েট মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মুখে আরেক কথা। সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের মতো ডোনাল্ড লুকে দুই আনার মন্ত্রী না বললেও একেবারে কমও বলেননি। লু একজন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তা উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কথা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণই যেখানে শোনেন না, সেখানে তার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকার শুনতে বাধ্য নয়। সারা বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে দাপট দেখাত, তা মধ্যপ্রাচ্যেই সংকুচিত হয়ে গেছে বলেও মন্তব্য করেন ওবায়দুল কাদের। একপর্যায়ে বলেন, লুর বাংলাদেশ সফরের উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগ জানে না।
এমন সন্ধিক্ষণে এলেন লু। আবার যথানিয়মে যথাসময়ে চলে যাচ্ছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। তার জায়গায় আসছেন ডেভিড স্লেটন মেল। বলা হয়ে থাকে পেশাদার-ক্যারিয়ারিস্ট কূটনীতিকদের মধ্য থেকে মাইলাম, হ্যারি কে টমাস, হাস, মেল, মিলার, মজিনার মতো বাছাইকৃতদেরই বাংলাদেশে পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। ডেভিড মেল এখন আছেন চীনের বেইজিংয়ে মার্কিন দূতাবাসে ডেপুটি চিফ অব মিশন হিসেবে। সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নীতি ও বাস্তবায়ন ব্যুরোর পরিচালকও ছিলেন। বাংলাদেশে তিনি নতুন নন। একসময় ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশনের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সূত্রে বাংলাদেশের পথঘাট, রাজনীতির নানা গলি, বিভিন্ন দলের নেতাদের রগ-শিরা ভালোমতোই চেনেন মেল। কূটনীতির ময়দানে একজন চীনা বিশেষজ্ঞ তিনি। প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রশাসন একজন চীনা বিশেষজ্ঞকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত মনোনীত করল-এ নিয়ে কূটনীতিক ও রাজনীতিক মহলে নানা বিশ্লেষণ আছে। বিশেষ বিশেষ জায়গায় কথার খই ফুটতেও শুরু করেছে।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনাকে চীনের সঙ্গে গাঁটছড়া কমাতে ভারতের মাধ্যমে বার্তা দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। ভারত এতে ব্যর্থ হলে, বাংলাদেশ চীনের দিকে আরও ঝুঁকতে থাকলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা অপেক্ষার বিষয়। ভারত তার কূটকৌশলমতো হাত-পা গুটিয়ে রাখলে চীন-রাশিয়া যৌথ শক্তিকে আয়ত্ত করতে হবে শেখ হাসিনাকে। যুক্তরাষ্ট্রই-বা তখন কোন তুরুপ ফেলে আগাম ধারণা করা যায় না। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাক-ভারত যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের যৌথ শক্তির কাছে হার মানে যুক্তরাষ্ট্র। চীন-রাশিয়ার সমর্থনে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওস মার্কিনিদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়। রাশিয়ার সঙ্গে পুরোনো খাতিরকে কেবল ঝালাই নয়, আরও পোক্ত করেছেন শেখ হাসিনা। তার আমলে দেশটির সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কও উচ্চ পর্যায়ে। যার কিছু কিছু প্রকাশ পায় রূপপুর প্রকল্পে বিশাল দুর্নীতি-চুরির মতো অঘটন চক্রে। সম্প্রতি পাইলট জাওয়াদ আসিমের বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর নতুন করে জানা হয়েছে, জাওয়াদ যে বিমানটি চালাচ্ছিলেন, সেটি রাশিয়া থেকে কেনা হয়েছিল অত্যাধুনিক বিমান হিসেবে। এ দুর্ঘটনার আগে আরও তিনটি ইয়াক-১৩০ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনার শিকার ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যদিও সেগুলোতে কারও মৃত্যু হয়নি। রাশিয়া থেকে এই সরকারের আমলে ১৬টি ইয়াক-১৩০ জেট প্রশিক্ষণ ও গ্রাউন্ড অ্যাটাক বিমান আনা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ বিমানগুলোর খুচরা যন্ত্রাংশ ঠিকমতো আনা যায়নি, অন্যান্য সার্ভিসিংয়েও সমস্যা।