‘টাইম’ ম্যাগাজিন বলেছে, “শেখ হাসিনা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচার এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চেয়ে ক্ষমতাধর ও তাদের চেয়ে দীর্ঘ মেয়াদ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকা সরকার প্রধান।
থেচার ও ইন্দিরা গান্ধীকে তাদের প্রতিটি কাজের জন্য পার্লামেন্টের কাছে জবাবদিহি করতে হতো। কিন্তু শেখ হাসিনার জবাবদিহির কোনো স্থান ছিল না; বরং তার কাছেই প্রত্যেককে জবাবদিহি করতে হতো।”
এত ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্বেও তাকে ‘চাচা আপন বাঁচা’ অথবা ‘য পলায়তি স জীবতি’” মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের জান বাঁচানোর জন্য পালাতে হয়েছে। সুদূর অতীত কালে বাংলার আরেক শাসক, বাংলার শেষ হিন্দু রাজা লক্ষ্মণ সেনকে গবাক্ষপথে পালাতে হয়েছিল। ওই আমলে হেলিকপ্টার, বুলেট প্রুফ যানবাহন ছিল না বলে শত্রুর আগমণ ধ্বনি শুনে রাজধানী গৌড়ের প্রাসাদে দুপুরে ভোজে বসা লক্ষ্মণ সেন আধপেটা খেয়ে লাফ দিয়ে ঘাটে বাধা নৌকায় উঠে চম্পট দিতে হয়। যদি তিনি “বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী” পণ করতেন তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। বখতিয়ার খিলজি তাকে পাননি। বিনা যুদ্ধে তিনি বাংলা জয় করে ফেলেন।
শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র স্বাক্ষর করে সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে উঠে যান স্বল্প দূরত্বে অবস্থিত কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটিতে এবং সেখানে অপেক্ষমান বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি পরিবহন বিমানে উঠে পালান। তার পলায়নের খবরে তার মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবর্গ, দলের নেতা এবং কর্মীরাও পালিয়েছেন। এত বড় একটি দল, মাত্র সাত মাস আগে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচনে ৮২% ভোটে জেতা এত জনপ্রিয় একজন প্রধানমন্ত্রী, অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা – কেউ তার পাশে ছিলেন না – মন্ত্রী, নেতাকর্মী একজনও না। তার ফুট-ফরমাশ খাটা পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। পদাধিকারীরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে থেকে পরবর্তী কটি জেনারেশনের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খাওয়ার মতো বিত্ত কামাই করেছেন, তা সহজে অনুমেয়। তবুও তাকে বাঁচাতে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়নি কেউ। প্রত্যেকেই হয়তো ভাবেন, “জান হ্যায় তো জাহান হ্যায়” – যতদিন জীবন আছে, ততদিন পৃথিবী আছে।
শুধু এবারই নয়। আওয়ামী লীগের এই পলায়ন চর্চা বেশ প্রাচীন। ১৯৭৫ সালের আগস্টে ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল। নেতার মৃতদেহ সিঁড়িতে পড়ে ছিল. আর তার মন্ত্রী, নেতাকর্মী সকলে সটকে পড়েছিলেন। কেউ প্রতিবাদ করতে, দু:খ করতে বা জান দিতে আসেননি।
বিএনপি নেতাদের ক্ষেত্রে অন্যরকম ঘটনা ঘটে। তারা বেকায়দায় পড়লে দৌড় দেন। দৌড় দিয়ে বিএনপি’র যেসব নেতা খ্যাতির অধিকারী হয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাবেক সেনাপ্রধান লে: জেনারেল মাহবুবুর রহমান, যাত্রাবাড়ির সালাহউদ্দিন আহমেদ এবং সাবেক সংসদ সদস্য জয়নুল আবেদিন ফারুক। প্রথম দু’জন প্রতিপক্ষের ধাওয়ায় এবং তৃতীয়জন পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতির এক পর্যায়ে পুলিশের দণ্ডাঘাত থেকে বাঁচতে দৌড় দেন। টানাহেঁচড়ায় তার শার্ট রয়ে যায় পুলিশের হাতে, তার বলিষ্ঠ দেহে ছিল কেবল গেঞ্জি। প্রথম দুজনের বস্ত্র প্রতিপক্ষ লোকজনের টানাটানিতে ছিন্নভিন্ন হয়েছিল। বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একাধিক সালাহউদ্দিন থাকায় “দৌড় সালাহউদ্দিন’ বললে তাকেই শণাক্ত করা যায়।
জাতীয় পার্টির নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীও একবার শহীদ মিনারে গিয়ে ধাওয়ার মুখে পড়েন এবং তার পরনের পাঞ্জাবি ছিন্নভিন্ন হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আরো দু’জন শাসককে জীবন রক্ষার্থে নিজ নিজ দেশ থেকে পলায়ন করতে হয়েছে। একজন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি এবং শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকশে।