৬০ বছরের জীবনের অর্ধেকটাই কাটিয়ে দিলেন সেতুর নিচে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  ১৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:২২
আপডেট  : ১৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:৩৬

নাইজেরিয়ার বৃহত্তম শহর লাগোস। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত শহরটিতে বিপুল গৃহহীন মানুষ রয়েছেন। এ রকমই একজন লিয়ায়ু সাআদু। ৬০ বছর বয়সী সাআদু তাঁর জীবনের অর্ধেকই কাটিয়ে দিয়েছেন লাগোসের একটি সেতুর নিচে।
লাগোসের ওবালেন্দে সেতুর নিচে সাআদুর সঙ্গে বর্তমানে ৬০ জনের বেশি গৃহহীন মানুষ বাস করেন। সাআদুকে তাঁরা সবাই গুরু মানেন।


অর্থনৈতিক সংকট ঘোচানোর আশায় নাইজেরিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শহরটিতে দৈনিক অনেক মানুষই আসেন। তাঁদের বেশির ভাগ ভাঙারি কুড়ানো, জুতা সেলাই বা কারখানার ছোটখাটো কাজ করেন।
নগর জীবনের ধাঁধায় পড়ে অনেকে জড়িয়ে পড়েন চুরি-ছিনতাই বা মাদক বিক্রির মতো অপরাধে। লাগোসে নবাগত ব্যক্তিদের এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়া সম্পর্কে সতর্ক করেন সাআদু।
সাআদু বলেন, ‘আমার বয়স ৬০। কয়েক মাস বা কয়েক বছর আগে এসেছেন এমন তরুণ আমার সঙ্গে রয়েছেন। তাঁদের পরামর্শ দেওয়াটা আমি নিজের দায়িত্ব মনে করি। কারণ, লাগোসে সহজেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। আর এখানে এই তরুণদের দেখভাল করার কেউ নেই।’


যাঁরা সেতুর নিচে বসবাস করেন, তাঁদের প্রায় সবাই হাউসা ভাষায় কথা বলেন। সাআদুও এ ভাষায় কথা বলেন। এটিই নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলের প্রধান ভাষা।
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিম জামফারা অঞ্চলের ছোট্ট শহর জুর্মি থেকে ১৯৯৪ সালে লাগোসে এসে আস্তানা গাড়েন সাআদু। ওই সময় আরও কিছু গৃহহীন ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। ইতিমধ্যে তাঁদের অনেকে হয়তো মারা গেছেন, নয়তো নিজ শহর বা গ্রামে ফিরে গেছেন। কিন্তু সাআদু সে আস্তানাতেই রয়ে গেছেন।

সাআদুকে যাঁরা গুরু মানেন, তাঁদের একজন তুকুর গারবা। পাঁচ বছর ধরে ওই সেতুর নিচে থাকছেন তিনি। ৩১ বছর বয়সী এ যুবক নাইজেরিয়ার উত্তর দিকের প্রায় ৬২১ মাইল দূরের কাতসিনা শহর থেকে লাগোসে এসেছেন। ভাগ্য ফেরাতে নির্বান্ধব এই শহরে আসার পর থেকে সাআদুর সঙ্গেই আছেন তিনি।

সাআদু সম্পর্কে গারবা বলেন, ‘তিনি আমাদের বড় ভাইয়ের মতো। অনেক দিন আগে থেকেই তিনি এখানে আছেন। তাঁর জ্ঞানগর্ভ কথা শোনা আমাদের জন্য জরুরি। কারণ, লাগোসে যে কেউ সহজে ‘‘লাইনচ্যুত’’ হতে পারেন।’
লাগোস শহরের যে জায়গাটায় এসব গৃহহীন মানুষ থাকেন, সেটাকে তাঁরা ‘কারকাশিন গদা’ বলে থাকেন। হাউসা ভাষায় এর অর্থ সেতুর নিচে। কারকাশিন গদার বাসিন্দাদের বিষয়ে গারবা বলেন, ‘যাঁরা এখানে আসেন, তাঁদের পরিচিত কেউ এখানে আগে থেকেই আছেন বা কারও কাছ থেকে তাঁরা কারকাশিন গদা সম্পর্কে খবর পেয়েছেন।’ পাঁচ বছর আগে তিনি যখন কারকাশিন গদায় আসেন, তখন এখানকার বাসিন্দা ১০ জন ছিলেন বলে জানান এ যুবক।
কারকাশিন গদার পাশের একটি অ্যাপার্টমেন্টে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে থাকছেন আদামু সাহারা। লাগোসে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি। এই ব্যক্তি বলেন, ‘উত্তর নাইজেরিয়ায় অর্থনৈতিক দুরবস্থার পাশাপাশি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর উত্থানসহ নানা অনিশ্চয়তা রয়েছে। তাই ওই গৃহহীনরা নিজ শহর ছেড়ে এখানে আসছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেখানে (উত্তরাঞ্চল) কী হচ্ছে, সে সম্পর্কে নাইজেরিয়ার নেতাদের সচেতন হওয়া দরকার। ওই সব সমস্যার সমাধান করা না গেলে সেতুর নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা কমানো যাবে না।’
সাআদুর নিজের অঞ্চল জামফারার অর্থনৈতিক দুর্দশা এখনো ঘোচেনি। অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও ঘটে নিয়মিত। তাই বয়স হওয়ার পরও কারকাশিন গদার সবচেয়ে পুরোনো বাসিন্দা সাআদু লাগোস ছাড়তে রাজি নন।
সেতুর নিচে একটা অংশে নিজের থাকার জায়গাটা একভাবে গুছিয়ে নিয়েছেন সাআদু। সেখানে তাঁর আসবাব ও অন্যান্য সামগ্রী বলতে একটি গদি, কিছু বিছানা, একটি কাঠের আলমারি ও একটি মশারি রয়েছে।
এসব আসবাব থাকায় কারকাশিন গদার বাসিন্দাদের মধ্যে সাআদুর অবস্থা তুলনামূলক ভালো বলতে হয়। কারণ, এ আস্তানার বাসিন্দাদের অনেকেরই কোনো আসবাব নেই। তাঁরা মেঝেতে অন্যের পাতা মাদুর ভাগাভাগি করে থাকেন।

 


কারকাশিনের বাসিন্দারা পার্শ্ববর্তী একটি গণশৌচাগারে গোসল ও শৌচকার্য সারেন। এই সেবা নেওয়ার জন্য প্রতিবার তাদের ১০০ নাইরা (নাইজেরিয়ার মুদ্রা) দিতে হয়।
কারকাশিন গদায় কালেভদ্রে রান্না হয়। তাই সেখানে কাউকে চুলা জ্বালাতে দেখতে পাওয়া দুর্লভ। এমনকি শীতকালেও নয়। কারণ, এখানকার সব বাসিন্দা ভাসমান বিক্রেতাদের তৈরি করা খাবার খান।
লাগোস শহরের এ অংশে আয়েশা হাদি নামের একজন নারী তৈরি খাবার বিক্রি করেন। নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলের মানুষের কাছে তাঁর রান্না বেশ জনপ্রিয়।
হাদি বলেন, ‘লাগোসের এ অংশ উত্তরের অনেক মানুষ থাকেন। আমি তাঁদের কাছে ফুরা (গাঁজানো দুধের সঙ্গে ভুট্টা মিশিয়ে তৈরি একধরনের খাবার) বিক্রি করি। অনেক মানুষ আমার থেকে খাবার কেনেন।’
লাগোসে প্রথম জীবনে মুচির কাজ করতেন সাআদু। বড়সড় শহরটিতে তিন দশকের জীবনে ভাগ্যোন্নয়ন ঘটিয়ে এখন ভাঙারি বিক্রির কাজ করেন তিনি।
ভাঙারি বিক্রি থেকে তাঁর দৈনিক গড়ে পাঁচ হাজার নাইরা (তিন ডলার) আয় হয়। দেশটির কোনো ব্যক্তির দৈনিক আয় ১ দশমিক ৯০ ডলারের কম হলে তাঁকে চরম দরিদ্র বলে ধরা হয়। কিন্তু নাইজেরিয়ার ব্যয়বহুল শহরটিতে দৈনিক তিন ডলার আয় দিয়ে জীবন ধারণ করা সাআদুর জন্য বেশ কষ্টের।
কিন্তু এ আয় থেকে নিজের পরিবারের কাছেও নিয়মিত অর্থ পাঠান সাআদু। তাঁর ভাষায়, ‘ভুলবেন না, আয় থেকে প্রতি সপ্তাহে আমাকে অর্থ পাঠাতে হয়। তো এখানে (লাগোসে) থাকাটা একটা অবিরাম সংগ্রামের ব্যাপার।’
লাগোসে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ঠিক কত, জানা যায় না। বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের (এনজিও) তথ্যমতে, এ সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ।
অভিযোগ রয়েছে, এসব গৃহহীন মানুষের দিকে নাইজেরিয়া সরকারের তেমন কোনো মনোযোগ নেই; বরং সম্প্রতি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নানাভাবে কারকাশিন গদার বাসিন্দাদের হয়রানি করছে। মাঝেমধ্যেই মধ্যরাতে এসে তাঁদের দু-একজনকে ধরে নিয়ে যায় তারা। দুই হাজার নাইরা দিলে ছেড়ে দেয়।
এদিকে লাগোসে একটি ছোট্ট খুপরির বার্ষিক ভাড়াও প্রায় এক লাখ নাইরা। আর শ্রমিক শ্রেণির মানুষ বসবাস করেন এমন এলাকায় একটি ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টের বার্ষিক ভাড়া প্রায় সাড়ে তিন লাখ নাইরা। ভাড়ার এ ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে সাআদুদের ওবালেন্দে সেতুর নিচে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
মাথার ওপর গাড়ির শব্দের মধ্যে সেতুর নিচে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে সাআদু বলেন, ‘(এত কম আয় নিয়ে) আমি কীভাবে বেঁচে আছি, একবার ভেবে দেখুন। (লাগোসে) একটু ভদ্রস্থ জায়গায় থাকার জন্য অর্থ জমা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। গাড়ির এ শব্দের মধ্যে আমি থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দিনের ক্লান্তি শেষে এসব শব্দ আমার ঘুমে কোনো বিঘ্ন ঘটাতে পারে না।’