গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকায় অবস্থান আমাদের বাংলাদেশের। ফলে দেশের উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয় বিভিন্ন উপনদীগুলো। যে কারণে বর্ষাকালে ছোট থেকে মাঝারি আকারের বন্যা হয়ে থাকে। প্রতি বছরই নিম্নাঞ্চলগুলোতে দেখা দেয় বন্যা। তবে বাংলার মানুষ বেশ কয়েকবার বন্যার ভয়াবহতার সাক্ষী হয়েছেন।
অতীতে বন্যা বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে বিশেষ করে ১৯৬৬, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৮, ২০১৭, ২০২২ সালে। অর্থ্যাৎ দেখা যায়,২০০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত প্রতি ১০ বছর পর বাংলাদেশে একটি বড় বন্যা হয়ে ছিল। এছাড়া ১৯৬৮, ১৯৬৯,১৯৭৪, ১৯৮৯, ১৯৯৩ বন্যা হয়েছিল। তবে বাংলায় বন্যা এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ইতিহাস পাওয়া যায় ১৭৮১ সাল থেকে। এরপর ১৭৮৬, ১৭৯৪, ১৮২২, ১৮২৫, ১৮৩৮, ১৮৫৩, ১৮৬৪, ১৮৬৫, ১৮৬৭, ১৮৬৯ সালেও বন্যা হয়েছে বাংলায়। বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ১৯৮৮, ১৯৯১ ১৯৯৮ ও ২০২২ সালে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক বন্যা হয়।
১৯৬৬ সালের বন্যা
ঢাকা জেলার অন্যতম প্রলয়ংকরী বন্যাটি হয় ১৯৬৬ সালের ৮ জুন। এ বছর সিলেট জেলাতেও বড় ধরনের বন্যা দেখা দেয়। বন্যা ছাড়াও ১৯৬৬ সালের ১২ জুন সকালে এক প্রচণ্ড ঝড়ে জেলার পরিস্থিতি আরও মারাত্মক হয়ে ওঠে। এতে প্রায় ২৫ শতাংশ ঘরবাড়ি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ৩৯ ব্যক্তি ও ১০০০০ গবাদি পশু মারা যায় এবং প্রায় ১২ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর ৫২ ঘণ্টা একনাগাড়ে বৃষ্টির ফলে ঢাকা শহর প্রায় ১২ ঘণ্টা ১.৮৩ মিটার পানির তলে নিমজ্জিত ছিল।
১৯৮৭ সালের বন্যা
জুলাই-আগস্ট মাসে বন্যায় বড় ধরনের বিপর্যয়। প্রায় ৫৭ হাজার ৩০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত (সমগ্র দেশের ৪০ শতাংশেরও অধিক এলাকা)। এ ধরনের বন্যা ৩০-৭০ বছরে একবার ঘটে। দেশের ভেতরে এবং বাইরে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতই বন্যার প্রধান কারণ ছিল। ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমাঞ্চল, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র একীভূত হওয়ার নিচের অঞ্চল, খুলনার উল্টরাংশ এবং মেঘালয় পাহাড়ের সংলগ্ন অঞ্চল বন্যা কবলিত হয়।
১৯৮৮ সালের বন্যা
১৯৮৮-র বন্যা ছিল বাংলাদেশে সংঘটিত ভয়াবহ বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে সংঘটিত এই বন্যায় দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবে যায় এবং স্থানভেদে এই বন্যাটি ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এটি ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক ও ক্ষয়-ক্ষতিময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এই প্রলংকারী বন্যাটি সংগঠিত হওয়ার মূল কারণ ছিল সারা দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং একই সময়ে (মাত্র তিন দিনে) দেশের তিনটি প্রধান নদীর পানি প্রবাহ একই সময় ঘটায়।
১৯৯৮ সালের বন্যা
১০ বছর পর ঠিক ৮৮-র বন্যার স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছিল প্রকৃতি। ১৯৯৮-র বন্যা ছিল বাংলাদেশে সংঘটিত ভয়ংকর বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। দুই মাসের অধিককাল জুড়ে সংঘটিত এই বন্যায় দেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যায়। সারা দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে এই বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল।
২০০০ সালের বন্যা
ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ৫টি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা বন্যায় বিধ্বস্ত। প্রায় ৩০ লক্ষ লোক গৃহহীন। বন্যাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মাটির বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণে ঘটে।
২০১৭ সালের বন্যা
বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে ২০১৭ সালের বন্যা ভয়াবহতা ছিল ব্যাপক। তবে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যার তুলনায় ২০১৭ সালের বন্যার ব্যাপকতা কম ছিল। তবে পানিপ্রবাহ ও ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় এই বন্যা মাত্রা এলাকাভেদে ভিন্নতা রয়েছে। বিশেষ করে রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বগুড়া, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারী এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চল ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। এসব জেলায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বন্যার পানির স্রোতে ভেঙ্গে যায় সড়ক, মহাসড়ক, বেড়িবাঁধ ও রেললাইন। এই বছরে ভারত, নেপাল ও ভুটানেও ব্যাপক বন্যা হয়।
২০২২ সালের বন্যা
এর পরের সবচেয়ে বড় বন্যা হয় ২০২২ সালে। বাংলাদেশ এর সিলেট বিভাগে এই বন্যা হয়। ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও অনেক বেশি ছিল। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে দেশের সিলেট,সুনামগঞ্জ,মৌলোভীবাজার,কিশোরগঞ্জ ও উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা প্লাবিত হয়। সিলেট বিভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করেন।