দশ বছর আগে, নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার সময়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই আহ্বান তার ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ বা ‘প্রতিবেশী প্রথম’ বৈদেশিক নীতির প্রতিফলন ছিল। সেই সময় এই নীতির উদ্দেশ্য ছিল ভারতের ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক সমন্বয় গড়ে তোলা।
তবে সীমান্ত বিরোধ, দ্বিপাক্ষিক মতানৈক্য, উন্নয়ন প্রকল্পের বিলম্ব এবং এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে মোদির এই বৈদেশিক নীতি দ্রুত ব্যর্থ হয়ে যায়।
তবে বাংলাদেশকে ভারতের একটি সফল উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়েছিল। শেখ হাসিনা, যিনি এই মাসে চাপের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে চলে গেছেন, মোদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন। তাদের সম্পর্ক দুই দেশের জন্য লাভজনক মনে হয়েছিল।
কিন্তু হাসিনা গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় আসার পরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠেন। তার বিরুদ্ধে জনমনে ক্ষোভ বাড়তে থাকে এবং সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ তার পদত্যাগের ট্রিগার হয়ে দাঁড়ায়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করার পর হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, যা ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থার জন্য বড় একটি ধাক্কা।
ভারত হাসিনাকে সমর্থন করেছিল, কিন্তু হাসিনার এই পদত্যাগ ভারতীয় কূটনীতি ও নিরাপত্তার জন্য একটি বড় সংকট হয়ে উঠেছে। মোদির অধীনে নয়াদিল্লি তার বেশিরভাগ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে অসফল হয়েছে, যা ভারতের আঞ্চলিক কূটনীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির উপর প্রভাব ফেলেছে।
মোদি সরকারের হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ ভারতের আঞ্চলিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশে। ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) মুসলমানদের বাদ দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর নির্যাতিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর জন্য ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করার কথা বলা হয়েছিল, যা বাংলাদেশে সমালোচনার জন্ম দেয়। ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি বিজেপি সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণও আন্তর্জাতিক সমালোচনার কারণ হয়েছে।
বাংলাদেশে হাসিনার শাসন আমলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও তার শাসন কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে এবং এই পরিস্থিতি ভারতের কূটনীতির ওপর প্রভাব ফেলে। হাসিনার পদত্যাগ ভারতের গোয়েন্দা ও কূটনৈতিক ব্যর্থতার প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে এবং ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোর আস্থা অর্জনের সুযোগ হারিয়েছে। ভারত এখন একদিকে নিজেকে শক্তিশালী দেশ হিসেবে দেখতে চাইলেও, বাস্তবে ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি তার অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ভারতের সীমান্তে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে কঠোর আচরণের অভিযোগ রয়েছে এবং মালদ্বীপের সঙ্গে কূটনৈতিক দ্বন্দ্বও রয়েছে। মোদির রাজনৈতিক কৌশল এই অঞ্চলে বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ভারতীয় গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিরোধীরা মোদির ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্ক নিয়ে সমালোচনা করেছে।
বাংলাদেশে হাসিনার বিরোধিতা এবং বিজেপি সরকারের হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শের কারণে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। মোদি সরকারের সিএএ ও এনআরসি আইন বাংলাদেশের জনগণের ক্ষোভ বাড়িয়েছে এবং ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগ এনেছে।
মোদি সরকারের উচিত ছিল প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের পুনর্গঠন এবং কূটনীতির দিক থেকে নতুন পথ খুঁজে বের করা। নয়াদিল্লির ওপর নির্ভর করছে কিভাবে তারা এই অঞ্চলের ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে পারে।
ফরেন পলিসিতে এই নিবন্ধটি লিখেছেন সুশান্ত সিং। তিনি ইয়েল ইউনিভার্সিটির লেকচারার এবং ভারতের ক্যারাভান ম্যাগাজিনের কনসাল্টিং এডিটর। তিনি আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ডেপুটি এডিটর ছিলেন এবং দুই দশক ধরে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন।