বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেন ফ্যাসিবাদ নিয়ে এত আলোচনা?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১৪:৩১

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ফ্যাসিস্ট’ এখন বহুল উচ্চারিত শব্দ। আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো শেখ হাসিনার সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট সরকার’ হিসেবে উল্লেখ করছে। যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক বা আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলেছে তাদের ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর’ হিসেবেও বর্ণনা করা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটি কেন ব্যবহার হচ্ছে? প্রকৃতপক্ষে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটি কোথা থেকে এসেছে? শেখ হাসিনার শাসনামলের সঙ্গে ফ্যাসিস্টদের কতটা মিল রয়েছে?
ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিবাদ কী?
ইতালীয় শব্দ ফ্যাসিমো এসেছে ফ্যাসিও শব্দটি থেকে। অন্যদিকে ফ্যাসিও শব্দটি এসছে ল্যাটিন শব্দ ফ্যাসেস থেকে। এর অর্থ হচ্ছে লাঠি, কাঠ বা রডের আটি যা একত্রে বেঁধে রাখা হয়।
ফ্যাসেস থেকে ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দলের নামকরণ করা হয়। ঐক্য বোঝাতে এ ধরণের প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছিল। এর অর্থ হচ্ছে, এক বান্ডেল কাঠ ও রড যখন একসাথে বেঁধে রাখা হয় তখন সেটাকে ভাঙ্গা যায়না। কিন্তু একটি রড বা কাঠ আলাদা অবস্থায় থাকলে তা ভেঙ্গে ফেলা যায়।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় বলা হয়েছে, ফ্যাসিজম হচ্ছে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং গণআন্দোলন। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই মতাদর্শের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল।
ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিবাদ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইউরোপে উগ্র-ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব ঘটে। এই মতাদর্শে বিরোধীদের কোনো জায়গা ছিল না। কর্তৃত্বময় শাসন ক্ষমতাই ছিল ফ্যাসিবাদের এর মূলমন্ত্র।
ফ্যাসিবাদ মতাদর্শে বিশ্বাসীরা সবসময় মন করতো যে রাষ্ট্রই সব, এখানে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের কোনো স্থান নেই। এর মাধ্যমে তারা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হরণ করতো, ক্ষমতাকে একটি কেন্দ্রে আবদ্ধ রাখতো।
ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি কীভাবে?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিবাদ ধারণাটির উৎপত্তি হয়। এরপর এই মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে জার্মানি এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিজম বা নাৎসিবাদের উত্থান হয়। এটি ছিল ফ্যাসিজমের একটি রূপ। ফ্যাসিবাদ উত্থানের মধ্য দিয়ে ইউরোপে হিটলার ও বেনিতো মুসোলিনির মতো বিতর্কিত নেতার উদ্ভব হয়।
ইতালি ও জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ
ইউরোপের প্রথম ফ্যাসিস্ট নেতা ছিলেন ইতালির বেনিতো মুসোলিনি। ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্য একটি আরেকটির চেয়ে আলাদা। যদিও তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য একই রকম।
যুক্তরাষ্ট্রের কলোম্বিয়া ইউনির্ভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ রবার্ট পেক্সটন তার ২০০৪ সালে প্রকাশিত এনাটমি অব ফ্যাসিজম বইতে লিখেছেন, ১৯১৯ সালের ১৫ এপ্রিল এক বৈঠকের পর মুসোলিনির একদল বন্ধু ও সহচর মিলে ইতালির মিলান শহরে অবস্থিত সমাজতন্ত্র সমর্থিত একটি পত্রিকা অফিসে আক্রমণ করে।
মুসোলিনি ১৯১২ থেকে ১৯১৪ সালে নিজেই সে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ওই হামলায় চারজন নিহত হয়। এই ঘটনা এবং তার পরবর্তীতে সমাজতন্ত্রী ও বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সহিংসতার মাধ্যমে ইতালির ফ্যাসিজম মতবাদ ইতিহাসে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়।
তাদের যুক্তি ছিল দেশের ভালোর জন্যই তারা এসব করছে। পত্রিকা অফিসে হামলার ঘটনার তিন বছর পরেই মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট পার্টি ইতালির ক্ষমতায় বসে। এর ১১ বছর পর আরেকটি ফ্যাসিস্ট পার্টি জার্মানির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে।
মুসোলিনি ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক, একজন প্রথাবিরোধী লেখক, সমাজতন্ত্রের পক্ষে একজন বক্তা এবং পত্রিকার সম্পাদক। ক্ষমতায় আসার ১৬ বছর পর্যন্ত মুসোলিনির মধ্যে ইহুদি-বিরোধী কোন মনোভাব ছিল না। বড় শিল্পপতিদের মধ্যে যারা ইহুদি ছিলেন এবং অনেক জমির মালিক ছিলেন তারা শুরুর দিকে মুসোলিনিকে সহায়তা করেছিল।
ফ্যাসিজমকে মনে করা হতো পুঁজিবাদ বিরোধী। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিস্ট পার্টি ক্ষমতা নেওয়ার পর পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে তেমন কিছুই করেনি। তারা বেশি চড়াও হয়েছে সমাজতন্ত্রীদের ওপর। ক্ষমতায় আসার পর ফ্যাসিস্টরা ধর্মঘট নিষিদ্ধ করে, শ্রমিক সংগঠনগুলো ভেঙ্গে দেয় এবং অস্ত্র বানানোর খাতে প্রচুর অর্থ দিতে থাকে।
ক্ষমতায় আসার পর ফ্যাসিস্টরা রাজনৈতিক বিরোধী, বিদেশি এবং ইহুদিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ ধারণ করা ইউরোপের বড় রাজনৈতিক দলগুলো ভেঙ্গে যায়। ইতালি এবং জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। হিটলারের ন্যাশনাল সোশালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পাটিও ফ্যাসিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিতি ছিল।
ফ্যাসিস্টদের বৈশিষ্ট্য
অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন ফ্যাসিজমের সার্বজনীন কোনো সংজ্ঞা নেই। ফ্যাসিস্টরা মার্ক্সবাদীদের বিরোধী ছিল। শুধু বিরোধিতা নয়, মার্ক্সবাদীদের রীতিমতো ঘৃণা করতো ফ্যাসিস্টরা। এই দুটোর মধ্যে বিরোধ থাকলেও অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, ফ্যাসিস্ট এবং সোভিয়েত কমিউনিজমের মধ্যে অনেক মিল ছিল।
ফ্যাসিজম এবং সোভিয়েত কমিউনিজমি উভয়ই এসেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ভঙ্গুর অর্থনৈতিক দশা, গণআন্দোলন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে। ক্ষমতা গ্রহণের পর তারা উভয়ই একচ্ছত্র আধিপত্য সৃষ্টি করেছিল। তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এ দুটির মধ্যে খুব বেশি মিল খোঁজার চেষ্টা করা ঠিক হবে না।
ফ্যাসিস্টরা সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরোধী ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় আসার আগে হিটলার ও মুসোলিনি দুজনেই নির্বাচনের রাজনীতিতে জড়িত হবার আগ্রহী ছিলেন। ফ্যাসিস্টরা চায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ। যেমন হিটলার ক্ষমতা নেওয়ার পর শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতাই নিয়ন্ত্রণ করতে চাননি এর পাশাপাশি তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিলেন। এসব প্রতিষ্ঠান একসময় স্বাধীন হিসেবে বিবেচিত হতো। চার্চ, আদালত, বিশ্ববিদ্যালয়, সামাজিক ক্লাব, খেলাধুলার প্রতিষ্ঠান সবকিছুতেই নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিলেন হিটলার।
ফ্যাসিস্ট দলগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো জনসমাবেশ করে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করা। এর মাধ্যমে তারা দেখাতে চাইতো যে জনগণ তাদের পাশে আছে। সেজন্য তারা প্রায়ই বড় আকারের জনসমাবেশ, প্যারেডের আয়োজন করতো।
ইতালির মুসোলিনি, জার্মানির হিটলার এবং পর্তুগালের সালজারকে এ ধরনের জনসভার আয়োজন করতে দেখা যায়। ফ্যাসিস্ট দলগুলো সবসময় এক ব্যক্তির সর্বময় কর্তৃত্ব ও শাসনে বিশ্বাস করতো। তারা মনে করতো যে, রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং রাষ্ট্রের প্রধান একই ব্যক্তি থাকবেন যার হাতে সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব থাকবে। যেমন হিটলার ও মুসোলিনি যেটা মনে করতেন সেটাই সবাইকে মানতে হতো।
তরুণদের শক্তি সামর্থ্যকে সবসময় প্রশংসা করতো ফ্যাসিস্টরা। তারা তরুণদের বোঝাতে চাইতেন যে সবকিছু দেশের জন্য হচ্ছে। তারা নানা বিষয় নিয়ে তরুণ প্রজন্মকে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। ফ্যাসিস্টরা সবসময় তাদের সমালোচনার জবাব দিতেন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে।
দেশে যে কোনো ধরণের সমস্যার জন্য ফ্যাসিস্টরা অন্যের ওপর দোষ চাপাতে পছন্দ করতেন। এজন্য তারা কাউকে না কাউকে বলির পাঠা বানাতেন। যে কোনো সমস্যার উদ্ভব হলেই সেটি মার্ক্সবাদী বা অভিবাসীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতো। মার্কিন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী লরেন্স ব্রিটের মতে, ফ্যাসিবাদের ১৪টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিম্নরূপ-
ক্রমাগত জাতীয়তাবাদের প্রচার
ফ্যাসিস্ট শাসনামলে দেখা যায় দেশাত্মবোধক এবং জাতীয়তাবাদী গান, শ্লোগান কিংবা প্রতীক ক্রমাগত ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে তারা মানুষকে দেখাতে চায় যে দেশকে তারা কতটা ভালোবাসে।
মানবাধিকার হরণ
রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ফ্যাসিস্টরা মানবাধিকারকে অবজ্ঞা করে। তারা মনে করে ‘প্রয়োজনের স্বার্থে’ মানবাধিকার উপেক্ষা করা যায়।
গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ
অনেক সময় তারা গণমাধ্যমকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এক্ষেত্রে সরাসরি চাপ প্রয়োগ করা হয় এবং বিভিন্ন আইন-কানুনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ চাপানো হয়।
কর্পোরেট স্বার্থ
ফ্যাসিস্টদের শাসনামলে দেখা যায় ,সরকারে সঙ্গে কিছু ব্যবসায়ী ও শিল্পপতির বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হয়। তারা একে অপরের স্বার্থ বিবেচনা করে। অনেক ব্যবসায়ী সরকারের ভেতরে এমন নেতা বা মন্ত্রীদের ক্ষমতায় বসায় যারা তাদের স্বার্থ দেখবে।
প্রতারণার নির্বাচন
যারা ফ্যাসিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাস করে তারা প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে গ্রাহ্য করে না। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা এমন নির্বাচনের আয়োজন করে যেখানে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনা।
গত ৫ আগস্ট দেশব্যাপী তুমুল বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। দীর্ঘ সময় ধরে চলা তার শাসনামলে ফ্যাসিবাদের অনেক বৈশিষ্ট্যই লক্ষ্য করা গেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই তাই দেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদ শব্দটি বহুল আলোচিত শব্দে পরিণত হয়েছে।