হাসিনা, বন্যা, ভিসা: বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সংকট কী

ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৯ আগস্ট ২০২৪, ২২:৪৪

গত সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। এটি ভারতের পক্ষ থেকে খুবই ঘনিষ্ঠ অংশীদারের প্রতি উষ্ণ আতিথেয়তার একটি ইঙ্গিত ছিল।
এখন এক বছর পরে, হাসিনার সাথে সেই ঘনিষ্ঠতা ভারতের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে ১৫ বছর পর শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান।
হাসিনার পতনের কয়েক সপ্তাহ পরও বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব তুঙ্গে রয়েছে। সবকিছুতেই দৃশ্যমান হচ্ছে, শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য ক্রমবর্ধমান আহ্বান থেকে শুরু করে নয়াদিল্লি ভিসা ও পানি ব্যবহার করে বাংলাদেশকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে- এমন অভিযোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি ক্ষোভ বাড়ছে।

দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে সমস্যাগুলোর বিশ্লেষণ :

শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ দাবি বিরোধীদের
গত ৫ আগস্ট সামরিক হেলিকপ্টারে করে ঢাকা থেকে পালিয়ে নয়াদিল্লির কাছে একটি সামরিক ঘাঁটিতে অবতরণ করেন শেখ হাসিনা। তখন থেকে তিনি ভারতের রাজধানী ও এর আশেপাশে বসবাস করছিলেন বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর দাবি জোরালো হচ্ছে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারতীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, শেখ হাসিনাকে অবশ্যই বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ ও বিচার করতে হবে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরও এ দাবির প্রতিধ্বনি করেন। ৬ আগস্ট বিলুপ্ত বাংলাদেশের সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন জি এম কাদের।
মির্জা ফখরুলকে উদ্ধৃত করে ভারতীয় গণমাধ্যম বলছে, ভারতের উচিত তার (শেখ হাসিনা) কাছ থেকে জবাবদিহি আদায়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করা। কারণ তিনি স্পষ্টতই বাংলাদেশের অনেক ক্ষতি করেছেন। হত্যার তদন্তসহ একাধিক মামলা হাসিনার নামে।
সম্প্রতি নোবেলবিজয়ী মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শেখ হাসিনার কূটনৈতিক ভিসা বাতিল করে। তাছাড়া হাসিনা বৈধভাবে কতদিন ভারতে থাকতে পারবেন, তা স্পষ্ট নয়। ভারত সরকারও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রীয়াজ বলেন, ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে সংঘটিত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনতে বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চাইছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা শীর্ষ পদে আরোহণের পর থেকে নিরাপত্তা বাহিনী '৬০০ জনেরও বেশি' মানুষকে গুম করেছে।
বাংলাদেশের বন্যার জন্য কি ভারত দায়ী?
বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অংশে আগস্ট মাসে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার মানুষকে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। ৬৪টি জেলার মধ্যে ১১ জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। বন্যায় দেশের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ১০ লাখের বেশি মানুষ।
তবে বাংলাদেশের সাইবার জগতে গুজব ছড়াতে শুরু করে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গোমতী নদীর উজানে অবস্থিত দুম্বুর বাঁধ ইচ্ছাকৃতভাবে খুলে দেওয়ার কারণে এই বন্যা হয়েছে। গোমতী নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে। এই দাবির সমর্থনে এখনো পর্যন্ত কোনো প্রমাণ নেই।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও বাঁধের ভাটিতে বড় বড় জলাবদ্ধতার পানি থেকে এই বন্যা দেখা দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও কারিগরি আলোচনার মাধ্যমে পানিসম্পদ ও নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় সমস্যা ও পারস্পরিক উদ্বেগ সমাধানে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। উল্লেখ্য যে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে।
এ সপ্তাহের শুরুর দিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা ড. ইউনূসকে বলেছিলেন, পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বাঁধের পানি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছেড়ে যায়।
তবে বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলেছেন, অতীতের মতো ভারত তার প্রতিবেশী দেশকে পানি ছাড়ার বিষয়ে সতর্কতা জারি করেনি। এই সতর্কবার্তা মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে সহায়ক হতে পারতো।
আলী রিয়াজ বলেন, বন্যার কারণ যাই হোক না কেন, পানিবণ্টন নিয়ে অতীত অভিজ্ঞতার কারণে অনেক বাংলাদেশি তাৎক্ষণিকভাবে ভারতকে দোষারোপ করছে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তাদের অভিন্ন নদীগুলো থেকে আরও বেশি পানি সংগ্রহের দাবি জানিয়ে আসছে। এ ধরনের একটি চুক্তি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে, যা ঢাকার জন্য বেদনাদায়ক বিষয়।
তিনি বলেন, বর্ষাকালে বাংলাদেশে পানি জমে গেলেও শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ কখনোই প্রয়োজনীয় পানি পায়নি
বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসা কেন্দ্রগুলোতে কী হচ্ছে?
ঢাকা ও সাতকিরায় ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র (আইভিএসি) বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ভিসা প্রসেসিংয়ে বিলম্বের প্রতিবাদে শত শত মানুষ বিক্ষোভ করার একদিন পর এই ঘটনা ঘটে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর নিরাপত্তা শঙ্কায় ঢাকায় কূটনৈতিক উপস্থিতি কমিয়ে এনেছে ভারত। বিক্ষোভ চলাকালীন লোকজনের পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
২০২৩ সালে প্রায় ১৬ লাখ বাংলাদেশি ভারত ভ্রমণ করেছেন, যা দেশটির নাগরিকদের জন্য শীর্ষ গন্তব্য। পর্যটন ও চিকিৎসা বাংলাদেশিদের ভারতে আকৃষ্ট করার সবচেয়ে বড় কারণ।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন কেন?
নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দৃঢ় কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতীয় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তবে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে তারা ক্রমবর্ধমানভাবে হাসিনা ও তার 'ধর্মনিরপেক্ষ' আওয়ামী লীগ দলকে ভারতের স্বার্থের সঙ্গে অধিকতর সম্পৃক্ত হিসেবে দেখছে। ভিন্নমত দমন, সমালোচকদের গ্রেপ্তার এবং নির্বাচনে কারচুপির চেষ্টাসহ অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। তা সত্ত্বেও ভারত হাসিনার শাসনকে সমর্থন করেছে, সমালোচকরা এমন অভিযোগ করেছেন।
আলী রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ 'বৈধ ইস্যুতে বছরের পর বছর ধরে যে অসন্তোষ চলছে তারই প্রতিফলন'।
তিনি বলেন, হাসিনার প্রতি ভারতের নিঃশর্ত সমর্থনের অর্থ হলো- দেশটি 'তিনটি জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচন এবং মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনকে' সমর্থন দিয়েছে।
জাতীয় পার্টিকে নির্বাচন বয়কট থেকে বিরত রাখতে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এটা আওয়ামী লীগকে একটি লাইফলাইন দিয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তারের পর অধিকাংশ বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করে।
এদিকে, হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশটির বৃহত্তম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো ভারতে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। মোদী মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরেছিলেন।
৯ আগস্ট ঢাকায় শত শত বিক্ষোভকারী হিন্দুদের লক্ষ্য করে সহিংসতার বিরুদ্ধে সমাবেশ করেছে, যারা জনসংখ্যার ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে অন্তত ৫২টি জেলায় 'সাম্প্রদায়িক সহিংসতা' হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ড. ইউনূস ১৬ আগস্ট মোদিকে ফোন করে দেশে হিন্দুদের নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন। এক টুইটবার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছি।
আলী রিয়াজ বলেন, দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়ন 'যে কোনোভাবে ভারতের দায়িত্ব', কারণ হাসিনার শাসন ভারতের সমর্থনের কারণে টেকসই হয়েছিল।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের অবসানের কথা উল্লেখ করে রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশ নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। তিনি বলেন, ভারতীয়দের উচিত তাদের নীতি পুনর্বিবেচনা করা। বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে, এই বাস্তবতা মেনে নিন এবং এগিয়ে যান।